ক্ষুধার তাড়নাই ক্ষুধার্ত সিংহের জন্ম দেয়!

বিজয় শঙ্কর গুজরাট টাইটান্সের ইনিংসে বিজয়ের সুর তুলেছিলেন। রশিদ খান হ্যাটট্রিক করে সেই সুরই আরো পোক্ত করে কলকাতার জয়যাত্রা থামিয়ে দিয়েছিলেন। এক ওভারের আনুষ্ঠানিকতায় চেয়ে রয়েছিলেন শুধু। এক ওভারে ২৯ রান, আর শেষ ৫ বলে ২৮!

এমন সমীকরণে কেই-বা জয়ের পথে হাঁটবেন? কিংবা হাঁটলেও সফল হওয়ার সম্ভাব্যতাটাই বা কতটুকু? রশিদ খানরা তাই নির্ভার থেকেই ম্যাচ জয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু গুজরাটের ক্রিকেটাদের সেই প্রায় ঘটতে যাওয়া জয়োৎসবেই পানি ঢেলে দেন রিঙ্কু সিং। টানা ৫ বলে ৫ ছক্কা হাঁকিয়ে অবিশ্বাস্যভাবে কলকাতাকে ম্যাচ জয়ের আনন্দে ভাসান বাঁ-হাতি এ ব্যাটার।

টানা দুই ছক্কায় জয়ের ঘটনার উত্থান হয়েছিল এই গত বছরের আইপিএলেই। রাহুল তেওয়াতিয়ার সেই ক্ষণিকের তাণ্ডবে অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচ জিতেছিল রাজস্থান রয়্যালস। ৭ বছর আগে বেন স্টোকসকে গুণে গুণে চার ছক্কা মেরে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন কার্লোস ব্রাথওয়েট।

কিন্তু টানা ৫ বলে ৫ ছক্কা মেরেও ম্যাচ জেতা যায়! বিস্ময়ের ক্রিকেট ইতিহাসেও যে এমন ঘটনার দেখা মেলেনি কখনোই। সেখানে কিনা আলিগড়ের এক অখ্যাত ক্রিকেটার নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে সেই নজিরই ঘটালেন। দ্বিতীয় বলে ছক্কা, তৃতীয় বলে ছক্কা এভাবে নিষ্ফল দৃষ্টি কিংবা দর্শকদের নখ কামড়ানো মুহূর্তে সকল স্নায়ুবিক চাপ জয় করে গড়লেন ইতিহাস।

৫ বলে ৫ ছয় এবং ঐ ৫ বলেই ইতিহাস। হেরে যাওয়া ম্যাচের সম্ভাব্য লড়াকু সৈনিক থেকে বীরদর্পে ম্যাচ জেতার নায়ক হিসেবে সতীর্থদের কাঁধে করে মাঠ প্রস্থান। একই সাথে, গ্যালারিভর্তি দর্শকদের চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ, মুহূর্তটা বাস্তবিক নাকি কল্পলোকে, তা ঠাউর করার চেষ্টা।

রিঙ্কু সিং যে ৫ বলে ৫ বার সীমানা ছাড়া করিয়ে ইতিহাস তৈরি করলেন, সে সময় তাঁর মাঝে ভাবনায় কী ছিল? চাপের মুহূর্ত কি একটুও গ্রাস করেনি তাঁকে? কিংবা আদৌ কি ম্যাচজয়ের দিকে চোখ রেখেছিলেন? নাকি অনেকটা প্রকৃতির ঐশ্বরিক শক্তির বদৌলতেই এমন অবিশ্বাস্য মুহূর্তের গল্প রচিত হলো? জিজ্ঞাসু মনে ক্রিকেট অনুরাগীদের কত শতই না প্রশ্ন! হবেই বৈকি! যা কখনোই হয়নি, তা তো ঐতিহাসিকই বটে। ঐতিহাসিক মুহূর্ত রচনার মূলে থাকা সেই ইতিহাসবেত্তাকে নিয়ে বাড়তি প্রশ্ন তো থাকবেই।

তবে বিস্ময়ের মাত্রা যোগ করার মতো ব্যাপার হলো, ৫ ছক্কায় ম্যাচজয়ী এই ইতিহাসবেত্তা রিঙ্কু সিংয়ের নাকি বিশ্বাস ছিল এই ম্যাচটা জেতানোর! শুধু বিশ্বাস নয়, চাপের সেই মুহূর্তে নাকি এ ব্যাটারের আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে। আর সেই বিশ্বাসই রিঙ্কু জিতেছেন, জিতেছে কলকাতা নাইট রাইডার্স।

ম্যাচ জয়ের পর এমন সব আড়ালের গল্প নিয়েই রিঙ্কু সিংয়ের কণ্ঠে শোনা গেল বেশ কিছু কথা। অকপটেই বলে গেলেন, ‘আমি জানতাম আমি পারব। অধিনায়ক নিতিশ রানা আমাকে বলেছিল নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে। যা হওয়ার হবে বলে, অভয় বাণী দিয়েছিলেন তিনি। আর আমার মাথায় শুধু ছক্কা হাঁকানোর কথাই ছিল। উমেশ যাদব অপর প্রান্ত থেকে দারুণ সাপোর্ট দিয়েছে। আমি নিজে তেমন কিছু ভাবছিলাম না। প্রত্যেকটা বল হিট করতে চেয়েছি। বল যেভাবে এসেছে, সেভাবেই খেলেছি। ভাগ্য ভাল, প্রতিটা বলই আমার ব্যাটের মাঝখানেই লেগেছে। আমি নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছিলাম। আর সেই বিশ্বাসেই জয় পেলাম।’

রিঙ্কু সিংয়ের জীবনের গল্পটাই আবার এমন ৫ বলে ৫ ছক্কা হাঁকানোর মতো। আলীগড়ের সাধারণ এক পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা খানচন্দ্র সিং কাজ করতেন পেট্রোলিয়াম গ্যাসের এক কোম্পানিতে। বড় ভাই চালাতেন অটোরিকশা। এমন পরিবার থেকে পড়াশোনাটাও তেমন করে উঠতে পারেননি। অবশ্য পড়াশোনায় মনই তো ছিল না রিঙ্কু সিংয়ের। তাঁর পৃথিবীটা জুড়েই ছিল ক্রিকেট।

অমনোযোগী রিঙ্কু নবম শ্রেণির পরীক্ষায় ফেল করলেন। ব্যাস। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সেখানেই যবনিকাপাত। এরপর পুরোদমে বেছে নিলেন ক্রিকেট। কিন্তু অমন একটা পরিবারে ক্রিকেট কে নিয়েই কি শুধু চলা যায়। রিঙ্কু কাজ নিলেন একটা, পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ। কিন্তু রিঙ্কুর মনোযোগ তো শুধু ঐ ক্রিকেটেই। প্রশান্তিটা তো শুধু বাইশ গজের বোলারদের বল পিটিয়ে।

তাই ক্রিকেটটা আর ছাড়লেন না। ধরে রাখলেন স্থায়ী ভাবে। সুযোগও পেলেন। ২০১৪ সালে বিজয় হাজারে ট্রফি দিয়ে পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু। এরপর ২০১৭ তে আইপিএল। সেবার অবশ্য ছিলেন কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের (বর্তমানে পাঞ্জাব কিংস) ডেরায়। কিন্তু সুযোগ পাননি একটি ম্যাচেও। তাই রিঙ্কু সিংয়ের আইপিএল অভিষেক কলকাতার হয়েই, পরের বছরে। সেবার ১০ লাখের রিঙ্কু সিংকে ৮০ লাখ রূপিতে দলে ভিড়িয়েছিল কলকাতা নাইট রাইডার্স।

কেকেআর-এ এসে একাদশে নিয়মিত সুযোগ পাওয়া শুরু করলেন রিঙ্কু সিং। কিন্তু সেই আস্থার প্রতিদানটা তেমন একটা দিতে পারছিলেন না। তবে তাঁর ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট একটা বিজয়ের গল্প লেখার আশু সম্ভাবনা এঁকেছিল। প্রায় ১৪০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করা সেই রিঙ্কুর নায়ক হওয়ার গল্প তৈরি হলো এ ম্যাচ দিয়েই। যে ম্যাচের গল্প হবে অনেক দিন। ঠিক ততদিন, যতদিন না কেউ ৬ বলে ৬ ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ জেতার ইতিহাস তৈরি করে!

রিঙ্কু সিংহের উঠে আসার গল্পটা যে বড্ড প্রতিকূলতায় পূর্ণ, তা এখন বলাই বাহুল্য। জীবনের গল্পে কতশত পথ ডিঙিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। জীবন নামক সেই সংগ্রামের অধ্যায়ে স্বপ্ন পূরণের জন্য ক্ষুধার্ত রিঙ্কু সিং স্বপ্নের পথে ঠিকই পা বাড়িয়েছেন। বাইশ গজের গল্পেও সম্ভবত সেটিই টেনে আনতে চেয়েছেন তিনি। হতে চেয়েছেন ক্ষুধার্ত এক সিংহ। কারণ, ক্ষুধার তাড়নাই যে ক্ষুধার্ত সিংহের জন্ম দেয়।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link