ক্রিকেট পাড়ায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে গর্বিত কোচ কে, বলতে পারেন? আপনার ভাবনায় অনেক কটা নামই আসতে পারে। বর্তমানে ক্রিকেটের ঠাসা সূচিতে দলের সফলতায় কত কোচই তো নিজেকে সাফল্যের শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন। গর্বিত কোচের সংখ্যাটা তাই নির্দিষ্টতায় বন্দী করা সম্ভব না।
তবে এই মুহূর্তে মুম্বাইয়ের জোয়ালা সিং নামের এক কোচ ভীষণ গর্বিত। না। নিজের তৈরি মুম্বাই ক্রিকেট ক্লাবকে নিয়ে নয়। তিনি গর্বিত তাঁরই ছায়াতলে বেড়ে ওঠা এক ক্রিকেটারের সাফল্যে। তাঁর সান্নিধ্যে ক্রিকেটে হাতেখড়ি হওয়া সেই ছেলেটাই যে এখন নিজেকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছেন, ভারতের আগামীর গল্পে যাকে খুঁজে নিচ্ছে পুরো দেশ। জোয়ালা সিংকে গর্বিত করা সেই ক্রিকেটার হলেন জশস্বী জয়সওয়াল।
রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে এবারের আইপিএল রীতিমত রান ফোয়ারা ছোটাচ্ছেন এ ব্যাটার। রেকর্ড গড়েছেন, শতক হাঁকিয়েছেন, ম্যাচের পর ম্যাচে রান করে অরেঞ্জ ক্যাপ পাওয়ার দৌঁড়েও রয়েছেন। এবারের আইপিএলটা যেন জয়সওয়ালেরই। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে পারফর্ম করার নিমিত্তে প্রতিভাবান তকমা আগেই পেয়েছিলেন। তবে এবার যেন আরো পরিণত পরিচয়ে নিজেকে ফুটিয়ে তুলছেন।
এই আসরেই ১৩ বলে অর্ধ-শতক পূরণ করে আইপিএলের ইতিহাসের আগের সব দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড ভেঙ্গেছেন। এরপর হাঁকিয়েছেন সেঞ্চুরিও। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে খেলেছেন ৬২ বলে ১২৪ রানের ইনিংস। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৫৭৫ রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় রয়েছেন তিনে।
শিষ্যের এমন চমকপ্রদ পারফরম্যান্সে গুরু জোয়ালা সিং তো গর্বিত হবেনই। তারপরও জোয়ালা সিংয়ের তৃষ্ণাটা ঠিকঠাক মিটছে না। জয়সওয়ালের এমন ব্যাটিং ঠিকই উপভোগ করছেন, কিন্তু মনের কোণে কোথায় যেন কিছু একটা না দেখতে পারার আক্ষেপ এ কোচের। কারণ সেই পিচ্চিকাল থেকে যে জয়সওয়ালকে তিনি দেখে এসেছেন, সেই রূপটা তো তিনি দেখতে পারছেন না। কারণ ব্যাটার পরিচয়ে লাইমলাইটে আসা জয়সওয়াল যে তাঁর কাছে পুরোদস্তুর একজন অলরাউন্ডার!
লিস্ট এ ক্রিকেটে ৭ উইকেট আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে উইকেটহীন জয়সওয়ালকে অলরাউন্ডার বলা এ কোচকে এমন পরিসংখ্যান দিয়ে হয়তো ‘বোকা’ তকমা দিয়েই ফেলা যায়। কিন্তু যিনি জয়সওয়ালের গোটা ক্যারিয়ারটা কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ তো পুরোটাই ভুল হওয়ার কথা নয়।
একদম তাই। মূল ব্যাপারটা হলো, জয়সওয়াল নিজেও অলরাউন্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠিত করতে চান। কিন্তু অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ থেকেই এ ব্যাটার তাঁর লেগস্পিনে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। মূলত টিম ম্যানেজমেন্টের চাওয়াতেই তাঁর লেগস্পিনশৈলী আর পরবর্তীতে চোখে পড়েনি। অথচ, ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি কী দারুণ স্পিনটাই না তিনি করেছেন! ব্যাটার জেসওয়ালের স্পিনার রূপে সে সব কীর্তির অবশ্য প্রামাণ্য দলিলও রয়েছে।
বছর ছয়েক আগের কথা। প্রতিবারের ন্যায় মুম্বাই স্কুল অ্যাসোসিয়েশন সেবার ‘হ্যারিস শিল্ড’ নামে একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করলো। যশস্বী জয়সওয়াল খেললেন রিজভী স্প্রিংফিল্ডের হয়ে। তো সেই টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে বালমোহন বিদ্যামন্দিরের বিপক্ষে ১৩২ রানের ইনিংস খেলেন দলকে ফাইনালে নিয়ে যান তিনি। এরপর ফাইনালে গিয়ে দেখান বল হাতে চমক। ৭ ওভার বল করে তুলে নেন ৫ টি উইকেট। তাতে জয়সওয়ালের দলও জিতে নেয় সেবারের হ্যারিস শিল্ড ট্রফির শিরোপা।
জয়সওয়ালের বোলিং দ্যুতি ছড়ানোর গল্পটার শুরু আবার তারও ৩ বছর আগে। ২০১৩ সালে জোয়ালা সিংয়ের ক্লাবে ভর্তি হন জয়সওয়াল। এরপর একটি ম্যাচে ব্যাট হাতে ৪৭ রানের ইনিংস খেলার পর বল হাতে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। আর গিলস শিল্ডের একটি ম্যাচে জয়সওয়ালের কীর্তি তো রাতারাতি তাঁকে তারকা বানিয়ে দিয়েছিল। ১৪ বছর বয়সী জয়সওয়াল সে ম্যাচে ৩১৯ রানের পাশাপাশি দুই ইনিংসে তাঁর বোলিং ফিগার শেষ করেছিলেন ৯৯ রানে ১৩ উইকেট প্রাপ্তিতে।
এখানেই শেষ নয়। ২০১৫/১৬ মৌসুমে অন্ধ্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন চার দল নিয়ে একটি অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিল। তো সে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটার হওয়া জয়সওয়াল ৭ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বোলার।
এর এক বছর পর বিজয় মার্চেন্ট ট্রফিতেও (যেটি মূলত অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেটারদের জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় টুর্নামেন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়) বল হাতে চমক দেখিয়েছিলেন জয়সওয়াল। পুরো মৌসুমে ৩ টা ফাইফারসহ সেবার মোট ৩০ টা উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।
নিজের এমন বোলিং দক্ষতার রেশ জয়সওয়াল টেনে এনেছিলেন ২০১৮ সালের মুম্বাই টি-টোয়েন্টি কাপেও। সেবার পার্ট টাইমার হয়েও ৭.৭৬ ইকোনমিতে ৫ টি উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। মজার ব্যাপার হলো, এবারের আইপিএলে পার্পল ক্যাপের দৌঁড়ে থাকা তুষার পাণ্ডের চেয়েও সে টুর্নামেন্টে বেশি উইকেট নিয়েছিলেন জয়সওয়াল।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলে থাকার সময়ও প্রায় নিয়মিতই বোলিং করতেন জয়সওয়াল। ২০২০ এর সে যুব বিশ্বকাপের আগেই দক্ষিণ আফ্রিকা যুব দলের বিপক্ষে সিরিজ খেলেছিল ভারত যুব দল। অবাক করা ব্যাপার হলো, সে সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার ছিলেন এই জয়সওয়াল।
এর মধ্যে একটি ম্যাচে প্রোটিয়াদের ১২০ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়েও ম্যাচটা নিজেদের করে নিয়েছিল ভারত। আর তাঁর নেপথ্যে ছিলেন লেগস্পিনার জয়সওয়াল। সে ম্যাচে ৪ উইকেট নেওয়া এ স্পিনারের স্পিন ঘূর্ণিতেই মাত্র ৮৯ রানে অল আউট হয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
তারপর ২০২০ সালের যুব বিশ্বকাপে এক প্রকার পার্টটাইমার স্পিনার হিসেবেই খেলেছিলেন জয়সওয়াল। গোটা টুর্নামেন্টে মাত্র ৯ ওভার বল করেছিলেন। উইকেটও তুলে নিয়েছিলেন ৩ টা। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে টিম ম্যানেজমেন্টের চাওয়া ছিল শুধুই ব্যাটিং।
কারণ ঐ দলে রবি বিষ্ণয়, অর্থব আঙ্কোলকার, শুভং হেজের মতো স্পিনার ছিল। তাই জয়সওয়ালের উপর বোলিংয়ের বাড়তি চাপ দিতে আপত্তি ছিল ম্যানেজমেন্টের। আর এর পর থেকেই দলে তাঁর রোলের ক্ষেত্রে একটা বাঁকবদল ঘটে। পুরোস্তুর অলরাউন্ডার থেকে জয়সওয়াল হয়ে যান শুধুই ব্যাটার।
আর এটি নিয়েই যত আক্ষেপ জোয়ালা সিংয়ের। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, জয়সওয়ালের মাঝে একজন বিশ্বমানের অলরাউন্ডার হওয়ার সক্ষমতা আছে। তবে দলকে সেটি বিশ্বাস করতে হবে। তাঁর মতে, জয়সওয়াল নিজেও অলরাউন্ডার হিসেবেই ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। এ ব্যাপারে জোয়ালা সিং গণমাধ্যমেও নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেছেন, ‘আমি সব সময় ওর লেগস্পিন উপভোগ করি। আজ থেকে ১০ বছর আগে ও যখন আমার অধীনে আসে, তখন থেকেই আমি ওর বোলিং নিয়ে আলাদা কাজ করেছি। আর লেগস্পিন বোলিংয়ে সে সেই সক্ষমতা দেখিয়েছেও। কিন্তু পরে টিম ম্যানেজমেন্টের চাওয়ায় সে অনিয়মিত হয়ে পড়লো। এই সেদিনও বললাম, বল করিস না কেন? ও বলে, ‘স্যার আমি তো চাই, কিন্তু দল চায় না। এরপর আর কী বলব ওকে? আমি শুধু বলি, সুযোগ আসবে। আর সেই সুযোগটাই লুফে নিতে হবে।’
অবশ্য ভারতীয় দলেই পার্ট টাইমারদের খুব একটা ব্যবহার করার নমুনা নেই। একটা পরিসংখ্যান এখানে যুক্ত করা যেতে পারে। ২০২০ এর পর টেস্ট ক্রিকেটে ভারত তাদের সিংহভাগ ম্যাচই ৫ বোলার দিয়েই কাজ চালিয়েছে। এর বাইরে অবশ্য ১৪ জন বোলারকে বিভিন্ন সময় ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু কেউই ৭ উইকেটের বেশি পাননি। ওয়ানডে ফরম্যাটের ক্ষেত্রেও পরিসংখ্যানটা প্রায় একই। এ সময়কালে ৯ জন অতিরিক্ত বোলার ব্যবহার করলেও কেউ ৮ উইকেটের বেশি পাননি।
যশস্বী জয়সওয়ালের বোলিংয়ের অতীত পরিসংখ্যান তাঁর হয়েই কথা বলে। তবে স্বীকৃত ক্রিকেটে এসে অনিয়মিত বোলিংই মূলত তাঁর পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এখান থেকে, জয়সওয়ালের অলরাউন্ডার হয়ে ওঠাটা কিছুটা অসম্ভবই বটে। তবে জোয়ালা সিংয়ের বিশ্বাস, বাইশ গজের ময়দানে তাঁর শিষ্য আরেকটু প্রতিষ্ঠিত হলেই বোলিংয়েও ‘জয়সওয়াল চমক’ দেখা যাবে। আর এভাবেই তাঁকে প্রমাণ করতে হবে, তাঁর জন্মটা শুধু ব্যাটিং করার জন্যই নয়, লেগস্পিনের কারিকুরিও তাঁর রন্ধ্রে বিদ্যমান।
গুরুর এমন উচ্চাশা জয়সওয়াল পূরণ করতে পারবেন কিনা, তা সময়ই বলে দিবে। তবে তিনি যে আগামীর ভারতের ব্যাটিং স্তম্ভের একজন হতে যাচ্ছেন, সেই ভবিষ্যদ্বাণী এখনই করা যায়, নির্দ্বিধায়, নি:সঙ্কোচে।