বাজপাখি জিকো তবুও বিষাদগ্রস্ত

একটা সেমিফাইনাল, একটা ফুটবল পাগল জাতির জেগে ওঠা। ১৪ বছর পর সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের সেমিতে জায়গা করে নেয়া বাংলাদেশের মৃতপ্রায় ফুটবলকে জাগিয়ে তুলেছিল। উচ্ছ্বাস আর প্রত্যাশার মিশেলে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল এ দেশের কোটি ফুটবল ভক্ত।

যদিও সেমিফাইনালে শক্তিমত্তায় যোজন যোজন এগিয়ে থাকা কুয়েতের বাধা টপকে যেতে পারেনি টিম টাইগার্স। অতিরিক্ত সময়ে করা এক গোলই দুই দলের ব্যবধান গড়ে দিয়েছে।

বহুল প্রত্যাশিত সেমিফাইনালের শুরুটা অবশ্য দারুণ করেছিল বাংলাদেশ। ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটেই বিশ্বনাথ ঘোষের লম্বা থ্রো দারুণ ভাবে নিয়ন্ত্রণে আনেন ইন ফর্ম উইঙ্গার রাকিব হোসেন। এরপর নিজের স্পিডে কুয়েতি প্রতিপক্ষকে ছিটকে ফেলে এগিয়ে যান বক্সের দিকে, এরপর ক্রসও করেন দুর্দান্ত আর ফাঁকায় দাড়িয়ে থাকা মোরসালিনের কাছে আসে দলকে এগিয়ে নেয়ার সুবর্ণ সুযোগ।

যদিও টানা দুই ম্যাচে গোল পাওয়া এই ফরোয়ার্ড এবার পাননি জালের দেখা, সরাসরি গোলকিপারের গায়ে বল মেরে হতাশা উপহার দেন দর্শকদের। ততক্ষণে অবশ্য বাংলাদেশের ওজন বুঝে গিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের অতিথিরা। তাই তো তেড়েফুঁড়ে যাওয়ায় বদলে তাঁরা খেলতে থাকে গোছানো ফুটবল; দুই উইং বিশেষ করে বাংলাদেশের ডিফেন্সের ডানদিক লক্ষ করে কয়েকবারই আক্রমণ হানিয়েছিল দলটি।

বাংলাদেশের গোলমুখেও শট নিয়েছে কুয়েত। তবে গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকোর দৃঢ়তায় পিছিয়ে পড়তে হয়নি লাল-সবুজ বাহিনীকে। এদিন জিকো যেন বনে গেলেন বাংলাদেশের প্রাচীর। একের পর এক আক্রমণ প্রতিহত করেছেন শক্ত হাতে। রক্ষণ বেশ আঁটসাঁট ছিল বাংলাদেশের। তবুও শক্তিমত্তার বিচারে এগিয়ে থাকা কুয়েত গোল অভিমুখে আঘাত হানার চেষ্টা করেছে বহুবার।

তবে প্রতিবার হতাশ হতে হয়েছে কুয়েতের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের। রীতিমত বাজপাখি বনে যান জিকো। ছোঁ মেরে বল লুফে নিয়েছেন। কখনও একহাতে গতিশীল শট রুখেছেন তো কখনো, আলতো টোকায় বল জালে জড়ানো এড়িয়েছেন। জিকোর এমন দুরন্ত দিনে বাংলাদেশ যেন টাইব্রেকারে যাওয়ার স্বপ্ন বুনছিলো।

তাইতো বাংলাদেশও কাউন্টার অ্যাটাকে পরীক্ষা নিয়েছিল কুয়েতের রক্ষণভাগের। তবে গোল করার সুযোগ আর খুব একটা আসেনি প্রথমভাগে। শেষপর্যন্ত সমতায় থেকেই বিরতিতে যায় দুই দল।

দ্বিতীয়ার্ধেও একই ইন্টেন্সিটিতে খেলা শুরু করে বাংলাদেশ এবং কুয়েত। ছোট ছোট পাসে বাংলাদেশের গোলপোস্টের দিকে এগুতে থাকে আরব দেশটি; অন্যদিকে রাকিব, মোরসালিনদের গতি ব্যবহার করে নিজেদের শক্তির জানান দিচ্ছিলো ২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নরা। বাংলার রক্ষণে চিড় ধরাতে না পারলে রাকিব কিন্তু ঠিকই কুয়েতের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

ভুটানের ম্যাচের মত এদিনও মোরসালিনের বাড়ানো বল ধরে ডি-বক্সে ঢুকে যান রাকিব হোসেন। এরপর জোরালো শটও নেন তবে ভাগ্য বিধাতা এবার মুখ তুলে তাকায়নি। উপরের পোস্টে লেগে ফিরে আসে বল; আর ইঞ্চিখানেক নিচে লাগলেই হয়তো লাল সবুজের বুকে উদযাপনের ঢেউ নামতো।

কুয়েতের ফরোয়ার্ড আবদুল্লাহও অবশ্য পরীক্ষা নিতে ভুল করেননি বাংলাদেশের। ম্যাচের সত্তর মিনিটের সময় তাঁর দু্র্দান্ত ভলি এক হাতে আটকে দিয়ে সেবার রক্ষা করেছিলেন জিকো। এখানেই শেষ নয়, ম্যাচের শেষদিকে অলআউট এটাকে উঠে আসা কুয়েত বারবার আটকে যাচ্ছিলো বসুন্ধরা কিংসের এই গোলরক্ষকের গ্লাভসে।

শেষপর্যন্ত কোন দলই গোল করতে না পারায় নির্ধারিত নব্বই মিনিট শেষে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। এরপরের গল্পটা শুধুই কুয়েতের ফরোয়ার্ড আর বাংলাদেশের ডিফেন্ডারদের। টানা আক্রমনে তপু তারিকদের ব্যস্ত রেখেছিল তারা। তবে জিকোর দৃঢ়তায় সফল হতে পারেনি কখনো।

অবশেষে ১০৬ মিনিটের সময় আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ক্লান্ত বাংলাদেশি ফুটবলারদের ফাঁকি দিয়ে ঠিকই বল জালে জড়ান কুয়েতি রাইটব্যাক আবদুল্লাহ আম্মার। আর তাতেই স্বপ্নভঙ্গ হয় রাকিবদের, স্বপ্নভঙ্গ হয় বাংলাদেশের মানুষের।

শেষ পনের মিনিট শুধুই আক্রমণের ক্ষণ গুনেছে বাংলাদেশের ফুটবলাররা তবে কাজের কাজ হয়নি কিছুই, কুয়েতের শক্তিশালী রক্ষণের কঠিন পরীক্ষা তেমন একটা নিতেই পারে নি তাঁরা। দলের বাকিদের ব্যর্থতায় নিজের সবটুকু দিয়েও বিষন্ন মুখে মাঠ ছেড়েছেন আনিসুর রহমান জিকো। ম্যাচ পরবর্তী সময়ে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা শুনিয়ে গেছেন। আগামী সাফের চ্যাম্পিয়ন হতে চান জিকো। এই দলটা নিশ্চয়ই সেই প্রতিক্ষার অবসান ঘটাবে নিশ্চয়ই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link