বাংলাদেশের হৃদয়, তাওহীদ হৃদয়

টেম্পারমেন্ট, দৃঢ়তা, পরিপক্কতা, দক্ষতা, আরও বেশ কিছু বিশেষণ চাইলেই জুড়ে দেওয়া যায়। তাওহীদ হৃদয়কে বিশেষণের একটা পরিধিতে আটকে ফেলা যায়। তবে গতিপথ বলছে তিনি আটকে থাকতে আসেননি। তিনি থেমে যেতে আসেননি। তিনি এক ডানাখোলা পাখি হয়ে উড়ে বেড়াতে এসেছেন। তিনি চান বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশের শুভ্র পায়রা হয়ে উড়ে বেড়াতে।

খানিকটা বিষম খেতেই পারেন। এত প্রশংসার কি এমন করে ফেললেন তাওহীদ হৃদয়! না, তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বকাপ এনে দেননি। ও, না দিয়েছেন তো, যুব বিশ্বকাপ। সেটাও তো লাল-সবুজের জার্সিতেই জয় করা। সেটাই তো বাংলাদেশ ক্রিকেটের এখন অবধি সবচেয়ে বড় সাফল্য। সেই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তো হৃদয়ই ছিলেন।

সেই যাই হোক, লোকে যে সাফল্যকে মানদণ্ড ধরে, সেই সাফল্য থেকে হৃদয় এখনও বহুদূরে। তবে হৃদয় দেখিয়ে দিচ্ছেন যে তিনি সেই পথটুকু পাড়ি দিতে চান। তার সেই আগ্রহ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে প্রচণ্ড চেষ্টা। নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার তীব্র ক্ষুধা তার চোখে-মুখে যেন প্রতিফলিত হয় প্রতিনিয়ত।

সাদা বলের ক্রিকেটে বিশাল এক সম্ভাবনার সূর্য হয়েই উদয় হয়েছে তার। হৃদয়ের ক্যারিয়ারের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ সম্ভবত ২০২২ সালের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। সবার ধারণা হয়ত ২০২৩ বিপিএলই তাওহীদ হৃদয়কে দিয়েছে উড়ে বেড়ানোর ডানা। সেটা কোন কোন ক্ষেত্রে সত্য। তবে ২০২২ বিপিএলের ফাইনালই আসলে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে হৃদয়কে নিজের সন্ধান করতে।

সেবার ফরচুন বরিশালকে শিরোপা জেতাতে পারতেন তিনি। শেষ স্বীকৃত ব্যাটার হয়েও শেষ ওভারে ১০ রান তুলতে হয়েছিলেন ব্যর্থ। সেই ধাক্কাটাই সম্ভবত নাড়িয়ে দিয়েছে তাওহীদ হৃদয়কে। ধাক্কায় মুষড়ে পড়েননি তিনি। বরং দ্বিগুণ শক্তিকে নিজের সাথেই লড়াই করেছেন। আর তার পরের বিপিএলেই নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ রেখেছেন।

এখন তো রীতিমত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে মেলে ধরছেন সদ্য ফোঁটা রক্তজবার মত করে। নিজের সাথে লড়াইয়ে হৃদয়কে হারানো দায়। তিনি নিজের ভুল গুলো থেকে সত্যিকার অর্থেই শিক্ষা নেন। ভুল গুলো শুধরে নেওয়ার প্রচন্ড চেষ্টা তিনি করেন। সিলেটে হওয়া জাতীয় দলের ক্যাম্প কিংবা মিরপুর হোম অব ক্রিকেটে, সবখানেই হৃদয় চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিজেকে শুধরে নিতে।

সে প্রক্রিয়াতেই হৃদয় তার পুল শটকে আরও বেশি পরিণত করেছেন। মূলত তার পুল শট খেলার ধরণে ছিল বেশ গুরুতর সূক্ষ্ম ভুল। সেই ভুলটা তিনি শুধরে নিয়েছেন। কখনো সিলেটে গ্রানাইট স্ল্যাপে, তো কখনো থ্রোয়ারের ছোড়া বল খেলে। কোচদের দেওয়া টোটকাও তিনি মাথায় গেঁথে নিতে পারেন খুব ভালভাবেই। চেষ্টা করলে যেন ভুল শুধরে যায়, সেটার প্রমাণ আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই রেখেছেন।

ম্যাচের ১৭ তম ওভারের তৃতীয় বলে একেবারে চোখের প্রশান্তি জোগানো এক পুল শটই খেলেন তাওহীদ হৃদয়। ফজল হক ফারুকির স্লো-বাউন্সারের জন্যে অপেক্ষা করেছেন হৃদয়। এরপর পেছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে, কব্জির দারুন মোচড়, সে সাথে পেশিশক্তির সাথে ব্যাটের দারুণ সুইং। ব্যাস, বল গিয়ে আছড়ে পড়ে মিডউইকেট অঞ্চল দিয়ে সীমানার বাইরে।

অথচ কিছুদিন আগেও হৃদয় সামনের পায়ের সাহায্যে পুল শট করতেন। বেশ আগেভাগেই নিজের শট খেলে ফেলার প্রবণতা ছিল তার। তাতে টাইমিংয়ে গড়মিল হলেই, ক্যাচ উঠে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। হৃদয় নিজের সেই দূর্বলতা শুধরে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন অনেক আগেই। অল্প-স্বল্প ফলাফল পেতে শুরু করেছেন। তবে তিনি এখনই পুরোপুরি ‘সলিড’ ব্যাটার বনে গেছেন সেটা বলা উচিত হবে না।

হৃদয়ের বয়স একেবারেই অল্প। কাগজের হিসেবে ২২ বছর। এখনও বেশ সময় বাকি তার। তবুও তিনি ভরসা দিচ্ছেন। তার উপর আস্থা রাখতে শুরু করছে টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে গোটা দেশ। করবেই বা না কেন? এখন অবধি সাদা বলে ১৪টি ইনিংস খেলেছেন তাওহীদ হৃদয়। যার মধ্যে একটিতেও দশের কম রান নেই তার। ওয়ানডেতে গড় ৪৮।

বাংলাদেশের ব্যাটারদের জন্যে যা, চমকপ্রদ গড়। টি-টোয়েন্টিতে তিনি ব্যাট করছেন প্রায় ১৪০ স্ট্রাইকরেটে। এই যে সংখ্যার হিসেব। শেষ কবে এতটা পুলকিত করেছে কোন ব্যাটারের পরিসংখ্যান? মনে করতে দ্বিধা হওয়াই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমন ‘জেনারেশনাল ট্যালেন্ট’ তবে বলে কয়ে আসে না। হৃদয় তাইতো একটু হলেও ‘স্পেশাল’।

এখন বাকিটা হৃদয়ের হাতে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের হাতে। হৃদয় বাংলাদেশের পক্ষে দীর্ঘ সময় সার্ভিস হয়ত দেবেন। কিন্তু সেজন্য বিসিবিকে একটু বাড়তি পরিচর্যা করতেই হবে হৃদয়ের। আর হৃদয়কে ভোগা যাবে না আত্মতুষ্টিতে। অবশ্য তাওহীদ হৃদয় তো চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link