শৃঙ্খলার এক অনন্য নজীর

ব্যক্তিজীবনে আমি উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির একজন মানুষ। উচ্ছৃঙ্খল বলতে আবার আর দশটা মানুষের মতো গুন্ডা-বদমাইশ ভেবে বসবেন না যেন। এই উচ্ছৃঙ্খলতা হলো শৃঙ্খলার বিপরীত, বেপরোয়া কিছু নয়। আর আমার উচ্ছৃঙ্খলতা অত্যন্ত নিপুণভাবে নিয়ন্ত্রিত যাতে অন্য কারোর কোনোপ্রকার ক্ষতি না হয়।

লিখতে বসলে আমার এই একটা সমস্যা। নানা পয়েন্ট অব ভিউ চিন্তা করে অনেককিছু ভাঙাতে হয়। যে কারণে অনেকসময় মূল বিষয় থেকে পথচ্যুত হয়ে যাই। আজও হলাম। ফিরি তাহলে আসল কথায়।

তো ব্যক্তিগতভাবে উচ্ছৃঙ্খল হওয়ায় শৃঙ্খল কাউকে দেখলেই আমার ‘মেসি’ মনে হয়। মানে ভীনগ্রহের প্রাণী। এক্ষেত্রে আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সেরা ‘মেসি’ হলেন আমাদের মুশফিকুর রহিম।

ব্যক্তিজীবনে মুশফিক যে কী পরিমাণ শৃঙ্খল তা কমবেশি সবারই জানা। তাই তাঁর সবকাজ সময়মতো করা কিংবা সবসময় সুবিন্যস্ত থাকার উদাহরণগুলা টেনে লেখাটাকে ক্লিশে বানানোর দরকার পড়ছে না। তবে একটা উদাহরণ আজ না টেনেও পারছি না। মুশফিকের একটা ঘটনা সেই মাধ্যমিক থেকে এখন পর্যন্ত আমাকে অনেকবার ভাবিয়েছে, অবাকও করেছে। সেটা নিয়েই বকবক করতে যাচ্ছি আজ।

২০০৫ সালের কথা। মুশফিক তখন জাতীয় দলে ঢুকবে ঢুকবে অবস্থা। তাঁর চোখেমুখে তখনও কৈশোরের ছাপ। মুখে পবিত্র হাসিতে যেন একটা নিষ্পাপ চেহারা দোল খেয়ে যায়। ঠিক এমন সময়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইতিহাসের নবম সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট অভিষেক হয় তাঁর।

মুশফিকের টেস্ট অভিষেক ঘটে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সিরিজটা ছিল ব্রিটিশ মুল্লুকে। যখন ইংল্যান্ড সফরের জন্য জাতীয় দলে ডাক পান মুশি তখন তিনি সবেমাত্র উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়া একজন ছাত্র। কিন্তু জাতীয় দলের অনুশীলন থাকার কারণে শুরু থেকেই টানা ক্লাস মিস করে বসেন তিনি।

তাই সময় করে ইংল্যান্ড যাবার আগে একদিন ক্লাসে গিয়ে সব সিলেবাস, নোট-টোট জোগাড় করেন মুশি। পরিকল্পনা একটাই। যে করেই হোক খেলার পাশাপাশি পড়াটাও ভালোমতো চালিয়ে যেতে হবে। পিছিয়ে পড়া পড়াগুলা সিরিজের মাঝেই আয়ত্ত করতে হবে।

যেই ভাবা, সেই কাজ। ইংল্যান্ড সফরে তাই মুশির কিটব্যাগে শুধু ব্যাট, প্যাড ও গ্লাভসেরই জায়গা হয়নি, জায়গা হয়েছিল ইংরেজি, ইতিহাস ও ভূগোল বইয়েরও।

আমি শুধু ভাবি, এত অল্প বয়সে জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার পর তাঁর তো শুধু ঘোরের মধ্যেই থাকার কথা। নয়তো ওই সিমিং কন্ডিশনে হগার্ড-হার্মিসনদের ছোড়া বুক বরাবর ধেয়ে আসা বাউন্সারগুলা সামলানোর দু:স্বপ্নে বিভোর থাকার কথা। আর তিনি কি না এক গাঁটরি বই সঙ্গে নিয়ে বিমানে চড়ছেন।

সবাই যখন বিমানে দুষ্টামি করছেন কিংবা লম্বা ঘুম দিচ্ছেন তখন তিনি বসে বসে প্রাতিষ্ঠানিক বই পড়ে সিলেবাস গুছাচ্ছেন। এমনকি অনুশীলনের মাঝেও একটু দম ফেলার ফুরসত মিললেই তিনি ঠায় বই নিয়ে বসছেন। কী অদ্ভুত কাণ্ড, তাই না?

আজ বগুড়ার মিতু থেকে সমগ্র দেশের মুশি হওয়ার পেছনে বড়ো ফ্যাক্টর মুশফিকের এই শৃঙ্খল জীবনযাপন, কাজের প্রতি আত্মনিবেদন ও পরিশ্রম। বর্তমানে মাঠে মুশফিকের একটা বাজে সময় যাচ্ছে। এরকম দু:সময়ের মধ্য দিয়ে তিনি কতই তো গিয়েছেন। আবার সেখান থেকে বেরিয়েও এসেছেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি দ্রুত এই দু:সময়টা কাটিয়ে ওঠবেন। এই বিশ্বাস অন্তত আমার আছে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’এর ওপর, বাংলাদেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটারটার ওপর। আর যদি না পারেন, তাহলে বিদায় বলা ছাড়া বিকল্প পথ তাঁর খোলা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link