এক তারকার জন্ম হয়েছে

২৬ জানুয়ারি, ১৯৮৫। টেস্ট ক্রিকেটের অন্য যেকোনো দিনের মতই স্বাভাবিক একদিন ছিল সেটা। সবার অলক্ষ্যেই সেদিন ১৮ বছর বয়সী লিকলিকে এক পাকিস্তানি পেসারের অভিষেক হয়ে গেল সাদা পোশাকে।

আশপাশ থেকে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি উঠল। কারণ, পাকিস্তান যার ওপর সেদিন ভরসা করছিল তাঁর ঝুলিতে আছে মোটে মাস দুয়েক আগে খেলা একটা মাত্র প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। যাই হোক, আগের বছর ওয়ানডেতে অভিষিক্ত সেই তরুণ সেবার একটা ইনিংসেই বল করার সুযোগ পেলেন।

১০৫ রানে নিলেন দুই ‍উইকেট। আরেক ইনিংস বোলিং করার সুযোগ পাবেন কি করে! তাঁর চেয়েও যে সেই টেস্টে পাকিস্তানের পারফরম্যান্সই ছিল আরও সাদামাটা। সেই ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অকল্যান্ডে ইনিংস ও ৯৯ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরেছিল পাকিস্তান। জন রিডের সেঞ্চুরি, রিচার্ড হ্যাডলি-ল্যান্স কেয়ার্ন্সদের দাপুটে বোলিংয়ে নিজেদের মাটিতে সহজ জয় পায় স্বাগতিকরা।

তবুও টেস্টটাকে মনে রাখতে বাধ্য পাকিস্তান ক্রিকেট। কারণ, সেদিন অভিষিক্ত সেই বাঁ-হাতি তরুণ পেসারই ক্যারিয়ার শেষ করেন ২৫ বার ইনিংসে পাঁচটি করে উইকেট নিয়ে। আর তাঁর প্রথম দু’টো হয়েছিল ওই সিরিজেরই পরের টেস্টে।

ডানেডিনের দুই ইনিংসেই তিনি নেন পাঁচটি করে উইকেট। যদিও, নিউজিল্যান্ড হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর জিতেছিল দুই উইকেটে – তবে, ম্যাচ সেরার পুরস্কার দেওয়ার সময়ই কারোরই দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি। সেই নামটা হল – ওয়াসিম আকরাম। শুধু নিউজিল্যান্ড নয়, আশির দশকে গোটা বিশ্বই সেদিন বলে উঠেছিল – ‘নতুন এক তারকার জন্ম হয়েছে!’

অবশ্য তাঁর সত্যিকারের জন্ম হয়েছে আরো ১৮-১৯ বছর আগেই – ১৯৬৬ সালের তিন জুন, পাকিস্তানের লাহোরে। তাঁর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন আরেক গ্রেট ইমরান খানের অভিষেক হয়। পরে এই ইমরানের নেতৃত্বে খেলেছেনও। দু’জনে মিলে ইতিহাস গড়েছেন। ১৯৯২ সালের ফাইনালে এই ওয়াসিমই তো পরপর দুই বলে ফেরান অ্যালান ল্যাম্ব ও ক্রিস লুইসকে – যাতে ইমরানের হাতে ওঠে পাকিস্তানের প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফি।

ক্যারিয়ারের শুরুর চাপে ভাঙেননি ওয়াসিম, বরং লাহোর থেকে উঠে আসা ছেলেটি আরও মজবুত হয়েছে। টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ৪০০’র ওপর উইকেট নিয়ে। ৪১৪ টি উইকেট নিয়ে তিনি টেস্টে আজও বাঁ-হাতিদের মধ্যে সবার ওপরে আছেন। তিনি ওয়ানডের ইতিহাসে ৫০০’র বেশি উইকেট দু’জনের একজন। তিনি হলেন রিভার্স স্যুইংয়ের সুলতান।

ওয়াকার ইউনুসের সাথে তিনি গড়ে তুলেছেন নব্বই দশকের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পেস বোলিং জুটি – টু ডব্লিউজ। পাকিস্তান ক্রিকেট দেখেছে পেস বোলিংয়ের নয়া বিপ্লব – একে একে এসেছেন শোয়েব আখতার, আজহার মেহমুদ কিংবা আব্দুল রাজ্জাকরা। ওই সময়ের ব্যাটসম্যানরা আজও স্বপ্নে ওয়াসিম আকরামকে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তাঁকে অবশ্য টেল এন্ডার বললে অসম্মান করা হবে।

শুধু কি বোলিং, ওয়াসিম ছিলেন খুবই কার্যকর একজন অলরাউন্ডার। ইমরান খান পরবর্তী যুগে পাকিস্তানের সেরা পেস বোলিং অলরাউন্ডারদের একজন তিনি। প্রায়ই রীতিমত ব্যাটসম্যান সুলভ ইনিংস খেলতে তিনি। ছক্কা হাঁকিয়েছেন ৫৭ বার। এটা বিস্মকর ব্যাপার, অধিকাংশ নামকরা ব্যাটসম্যানেরও টেস্টে ছক্কার হাফ সেঞ্চুরি করতে ঘাম ছুটে যায়!

প্রায় তিন হাজার রান করেছেন তিনটি সেঞ্চুরি ও সাতটি হাফ সেঞ্চুরি নিয়ে। এর মধ্যে একবার ২৫৭ রানে অপরাজিত ছিলেন, নাহ একদম ভুল পড়েননি – ২৫৭! আকাশ ছোঁয়ার সেই ইনিংসে ওয়াসিম একাই ২২ টি চার ও ১২ টি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। আট নম্বরে নেমে খেলা সেই ইনিংসটি আজও সেই পজিশনে টেস্টের রেকর্ড!

শুধু অলরাউন্ডার হিসেবে নয়, নেতা হিসেবেও তিনি ছিলেন ইমরান খানের উত্তরসূরি। ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ – দু’টো বিশ্বকাপে তিনি পাকিস্তান দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তান ফাইনালও খেলেছে।

ওয়াসিম প্রথম দিককার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটারদের একজন। ইংল্যান্ডে যখন ফরম্যাটটির প্রচলন হয় তখন ওয়াসিম খেলতেন হ্যাম্পশায়ারের হয়ে। সেখানে পাঁচ ম্যাচে আটটি উইকেট নিয়েছিলেন ১৫.১২ গড়ে!

ক্যারিয়ারে হ্যাটট্রিক চারটা। ওয়ানডেতে দু’টো। দু’টোই শারজাহতে। যথাক্রমে ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে। টেস্টে হ্যাটট্রিক আসে এর নয় বছর বাদে, মানে ১৯৯৯ সালে। এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পরপর দুই ম্যাচে তিনি হ্যাটট্রিক করেছিলেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

এর বছর তিনেক আগে ধরা পড়ে ডায়াবেটিস, বয়স তখন মাত্র ৩০। দেখা যায়, সুগার লেভেল আকাশচুম্বী। হাল ছাড়েননি ওয়াসিম, খেলে গিয়েছেন আরও ছয় বছর, নিজেকে আরও ওপরে তুলেছেন। সেই চূড়া থেকে তাঁকে নামাতে পেরেছেন খুব কয়েকজন।

সেই নামানোটা হয়তো কেবলই পরিসংখ্যানে, তবে আধুনিক ক্রিকেটে ওয়াসিম আকরামের যে সৌন্দর্য্য, যে দাপট – সেটা ছোঁয়ার সাধ্য কারো নেই। এখানে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তাঁকে বিতর্কও ছুঁয়ে গেছে, ফিক্সিংয়ের বিষ ছুঁতে ছুঁতেও ছোঁয়নি। আবার দলের আন্তরাজনীতির সাথে জড়িয়েছিলেন বলেও কেউ কেউ দাবী করেন। তবে, টানা ২০ বছর একটানা পারফর্ম করে যাওয়াটা মুখের কথা নয়। এজন্য সুইংয়ের সুলতানকে স্যালুট না করার কোনো বিকল্পও নেই!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link