দৈত্যর কী ঘুম ভাঙছে!

যদি প্রশ্ন করা হয়, ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর ফুটবল খেলেছে কোন দল? অনেকের জবাব নিশ্চিতভাবে হবে আরিগো সাচ্চির এসি মিলান।

সম্ভবত, ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবল ইতিহাসে সফল দলের কথা বললেও সাচ্চির মিলানের কথা অনেক উপরেই আসবে। পাওলো মালদিনি, বারেসি, কোস্টাকুর্তা আর টাসোত্তিকে নিয়ে গড়া সাচ্চির ডিফেন্স লাইনআপ ছিল নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সর্বকালের সেরা। ততকালীন ম্যান মার্কিংয়ের যুগে ইতালিতে তিনিই প্রথম জোনাল মার্কিং এনে এসি মিলানের ইতিহাস বদলে দিয়েছেন।

২ মৌসুমে ২০০ ম্যাচে মাত্র ২৩ গোল হজম করা সাচ্চির সেই এসি মিলান দলের ডিফেন্সে প্রভাব প্রতিপত্তির জানান দেয়। একটি সিরি ‘এ’, তিনটি ডমিস্টিক কাপ, দুটি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ, দুটি উয়েফা সুপার কাপ এবং দুটি ক্লাব বিশ্বকাপ জয়ী দল হিসেবে সাচ্চির এসি মিলান কতটা সফল ছিল তার স্বপক্ষেও প্রমাণ দেয়। ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনে সর্বকালের সেরা দলের তালিকায়ে সাচ্চির এসি মিলান দলের অবস্থান এক। ফ্রাঙ্কো রাইকার্ডও যাদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘মিলানের সেই দল কিছু ভালো মিউজিক প্লে করত।’

আচ্ছা, এবার যদি প্রশ্ন করা হয়, একবিংশ শতাব্দীর ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবল ইতিহাসের সেরা দল কোনটি? হ্যাঁ, এবারও অনেকের জবাব কার্লো আন্সেলত্তির এসি মিলানই হবে। কেনইবা হবে না? দিদা, মালদিনি, নেস্তা, কাফু, গাত্তুসো, পিরলো,কাকা, আন্দ্রে শেভচেঙ্কোদের নিয়ে গড়া সেই এসি মিলান তো ফুটবল ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা দল। একটি সিরি ‘এ’, দু’টি ডমেস্টিক কাপ, দু’টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, দু’টি উয়েফা সুপার কাপ এবং একটি ক্লাব বিশ্বকাপ; কি জিতে নাই এই দলটি? দ্য মিরাকল অব ইস্তাম্বুলে লিভারপুলের ‘পাগল করা ৫ মিনিট’-এর সম্মুখীন না হলে এই দলের নামের পাশে আরও একটি চ্যাম্পিয়নস লিগও থাকত।

এমন দুটো ভিন্ন প্রজন্মের সেরা দল পেয়েও বর্তমানে মিলানের যায় যায় অবস্থা।

ক্রমাগত অর্থনৈতিক মন্দা আর ক্লাব ব্যবস্থাপনার অপরিণামদর্শিতায় অতীতের মিলানের সে জৌলুস বলা চলে এখন বিলীন প্রায় ! এক সময় ইউরোপে একচ্ছত্র যাদের আধিপত্য ছিল, তারা বর্তমানে ইউরোপ সেরার লড়াইয়ে জায়গা পায় না। ইতালির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লিগ জয়ী দল গেল দশক শেষ করে শূন্য লিগ নিয়ে। ক্লাবের এই ব্যর্থতার সাথে সাথে অবনমন ঘটে তার ফ্যানবেইজেও!

আগে একটা সময়ে বাংলদেশের মতো ভূখণ্ডেও প্রচুর মিলানের সমর্থকের দেখা যত্রতত্রই মিলতো। কিন্তু এখন আর নাই বললেই চলে। অথচ এসি মিলান ক্লাবটি ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবল ইতিহাসের সেরা দল। ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের আসরে এসি মিলানের চেয়ে সফল কেবল একটি দল। স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। এসি মিলান ইউরোপ সেরার আসরে যতবার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পড়েছে; ইতালির অন্যসব ক্লাব মিলিয়েও এখন পর্যন্ত  তার সমান ইউরোপ সেরা হতে পারেনি।

১৬ ডিসেম্বর, ১৮৯৯ সাল ।

১২১ বছর আগে ইতালির বিখ্যাত মিলান শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় এসি মিলানের। প্রতিষ্ঠাতা আলফ্রেড এডওয়ার্ডস ও হার্বার্ট কিলপিন নামক দুই ব্রিটিশ ভদ্রলোক। এসি মিলানের ডাকনাম হলো রোজোনেরি! ইংলিশে যার অর্থ, রেড অ্যান্ড ব্ল্যাক! ঐতিহাসিকভাবে এসি মিলান ক্লাব দক্ষিণ ইতালীর শহরের শ্রমিক শ্রেণী সমর্থিত ক্লাব! বিপরীতে তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টার-মিলান ছিল উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী সমর্থিত দল!

ক্লাব প্রতিষ্ঠার মাত্র ২ বছর পর ১৯০১ সালে প্রথমবার লিগ শিরোপা জেতে মিলান। কিন্তু ১৯০৬ ও ১৯০৭ সালে পরপর ব্যাক টু ব্যাক লিগ শিরোপা জয়ের পরের বছরে বিদেশি খেলোয়াড় সাইন করা নিয়ে ক্লাবে অভ্যন্তরীণ বিভেদ তৈরি হয়!

যার ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় একই শহরের আরেক মিলান, ইন্টার মিলান। ক্লাবের এই বিভেদের ফলে এসি মিলান ১৯৫০-৫১ মৌসুম পর্যন্ত আর কোনও লিগ শিরোপা জিততে পারেনি। পরের এক দশকে ৫ বার ‘স্কুডেট্টো’ জিতে নেয় এসি মিলান। বলা যায় তখন থেকে বিখ্যাত ‘রোজোনেরি’দের উত্থান শুরু হয়। এরই মাঝে ১৯৬৩ সালে জিতে নেয় ইতিহাসে প্রথমবার চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আরো দুটি স্কুডেট্টো আর একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা ঘরে তোলে ক্লাব এসি মিলান।

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু, আশির দশকের শুরুতেই নতুন এক মহা দুর্যোগের মুখে পড়ে মিলান। স্বপ্নের ক্লাবটির উপর নেমে আসে নিষেধাজ্ঞাতা এর খড়গ। ১৯৮০-৮১ সালে ম্যাচ ফিক্সিং-  অভিযোগে সেরি ‘বি’তে অবনমন ঘটে। অত:পর সিরি ‘বি’-তে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে পুনরায় সিরি ‘এ’-তে ফিরে আসে।

১৯৮৬ সালের এক অন্যরকম সন্ধ্যায় ইতালির বিখ্যাত ধনকুবের বার্লোসকুনি কিনে নেন রোজানারিদের। তার স্পর্শে আবারও বদলে যেতে থাকে ক্লাব। যেন পুর্নজন্ম  হয় এসি মিলানের। ১৯৭৮ সালে বার্লোসকুনি পার্মা থেকে উড়িয়েন নিয়ে আসেন আরিগো সাচ্চিকে। সাচ্চি এসেই দলে ভেড়ালেন নেদারল্যান্ডসের দুই তরুণ মার্কো ফন বাস্তেন এবং রুদ খুলিতকে। ফলাফলও এলো যেন হাতেনাতে। সেবারের মৌসুমেই সাচ্চি এসি মিলানকে এনে দিলেন বহু আরাধ্য সেই স্কুডেট্টো। কিন্তু সেটি ছিল কেবল গল্পের শুরু।

তারপরে জিওভান্নি গাল্লি, ফ্রাঙ্কো বারেসি, তরুণ মালদিনি, আলেহান্দ্রো কুস্তাকুর্তা, কার্লো আনসেলত্তি, রাইকার্ড, রুড গুলিত ও ভ্যান বাস্তনদের নিয়ে আরিগো সাচ্চি যা করেছেন, তাকে এসি মিলানের কালজয়ী উপন্যাসের রচয়িতা তো বটেই ক্লাব ফুটবল ইতিহাসেরও সবচেয়ে যুগান্তকারী কোচ হিসেবে হিসেবে সবাই মেনে নিবেন।

সাচ্চির বিদায়ের পরও মিলানের জয়রথ চলতে থাকে। ১৯৯৪ সালে ফ্যাবিও ক্যাপালো বেশ দাপটের সাথেই বার্সেলোনাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। এই সময়ে এসি মিলান টানা ৫৬ ম্যাচ আনবিটেন থাকার রেকর্ড গড়ে। যদিও সেই রেকর্ডটি কার্লো আনসেলত্তির আগমণে ছায়া হয়ে রইল!  মিলানও সাচ্চি পরবর্তীতে সবচেয়ে বেশি সফল হয় ডন কার্লোর অধীনে। বলা হয়ে থাকে, গ্রেট সাচ্চিকে এসি মিলানের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ কার্লো আনসেলত্তিই করেছে। ২০০১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর মিলানকে চার বার ইউরোপ সেরার লড়াইয়ে ফাইনালে তুলেন। ২০০৩ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে ইউরোপ সেরার ক্ষুদ্র তালিকায় নিজের জায়গা করে নেন। ২০০৭ সালেও এসি মিলানকে আরও একবার এনে দেন ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। ২০০৩-০৪ মৌসুমে জেতান সিরি ‘এ’ শিরোপা।

দিদা, মালদিনি, নেস্তা, কাফু, গাত্তুসো, পিরলো, কাকা, আন্দ্রে শেভচেঙ্কোদের নিয়ে গড়ে তুলেন এক সর্বজয়ী এসি মিলান।

এই প্রজন্মের অনেকের কাছে এসি মিলান নামটি খুব অচেনা; অথচ ফুটবল রোমান্টিকদের কাছে এসি মিলান  ছিল এক আজন্ম লালিত স্বপ্ন। আরিগো সাচ্চির কিংবা ডন কার্লো আনসেলত্তির মিলান এখন অতীতের একটি ছায়া মাত্র। মূলত, গেল দশকের শুরুতেই মিলান তার চিরচেনা রুপ হারাতে শুরু করে। প্রতিটি ক্লাব একটা সময় স্বাভাবিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। পুরাতনরা  গেলে নতুনরা এসে জায়গা নেয়। যে কোন ক্লাবের জন্য এই ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে, ক্লাবের ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ড যারা কাজে লাগিয়েছে, তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটও ধরে রাখতে পারে। ঠিক এই জায়গায় ক্লাব হিসেবে এসি মিলান ব্যর্থ। পুরনো অনেক খেলোয়াড়ের দল ত্যাগ,নতুন কোন বড় প্লেয়ার দলে আনতে না পারা, কিংবা বয়স্ক প্লেয়ারদের সাইন করানো -এসব নানামুখী কারণে স্বপ্নের এসি এসি মিলানের পতন শুরু হয়। তারপর ইতালির অর্থনৈতিক ধ্বস ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এসি মিলানের সর্বনাশের চূড়ান্ত পেরেকও ঠুকে দেয়!

সম্প্রতি ইব্রামোভিচের প্রত্যাবর্তনে নতুন করে আশা দেখছে রোজানারি। তার পেছনের কারিগর অবশ্যই কোচ স্টেফানো পিউলি। ডোনারুম্মা, রোমানোলি, কেসি, থিও, কায়ের ও হাকানদের পারফরম্যান্সে এসি মিলান তাদের হারানো প্রতাপশালী রুপে ফিরছে। ইতালিয়ান সিরি ‘এ’ ১২তম রাউন্ড শেষে ২৮ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট তালিকার চূড়ায়- দীর্ঘ এক যুগ পর আবারও স্কুডেট্টো জয়ের সুবাস পাচ্ছে রোজানারি। দেখা যাক, স্টেফানো পিউলির হাত ধরে কতটুকু এগোতে পারে স্বপ্নের সেই এসি মিলান। ততদিন আমরা অপেক্ষা করি। দেরিতে হলেও ১২১ তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link