Social Media

Light
Dark

আমাদের ফুটবল স্টাইল কী!

ক’দিন আগেই বাংলাদেশ কাতারের বিপক্ষে ৫-০ হেরেছে। সামান্য লড়াই করতে পারেনি, শিক্ষানবিশ পারফর্মেন্স করেছে দল। এইসব আসলে আগে থেকেই অনুমিত।

কথা হচ্ছে কেন? আমাদের ফুটবলে ঠিক কোন জিনিসটি আসলে মিসিং? কেন আমরা পারি না?

দুর্নীতি, অপেশাদার পৃষ্টপোষকতা, ফুটবল মাঠে সবসময় না থাকা, তৃণমুল পর্যায় থেকে ফুটবলের বিকাশ না ঘটা, ক্লাব গুলোর একাডেমি না থাকা; মোটা দাগে এইসব বিষয়কে বাংলার ফুটবলের অন্তরায় হিসাবে ধরা হয়।

ধরে নিলাম রাতারাতি এসব সমস্যা দূর হয়ে গেল। তারপরও আমাদের ফুটবল কি দশ অথবা বিশ কিংবা ত্রিশ বছর পর বিশ্বমানের হতে পারবে? এক কথার উত্তর হচ্ছে – না!

কারণ কী? আমাদের সমস্যাটা কী তাহলে অন্য কোথাও? সেটা খুঁজে দেখা যাক।

সর্বশেষ কিছু ম্যাচের চিত্র দেখা যাক। কাতার থেকে শুরু করি। কাতারের বিপক্ষে বাংলাদেশ ফ্রন্ট লাইনে দুইজন রেখে বাকিদের ডিফেন্সিভ সেইপে খেলালো। মিডে ক্রাইড করে সেন্টার থেকে ব্লক করার ট্রাই করেছিল সব কিছুই যেন হেন্সি ফ্লিকের বায়ার্ন!

তার আগে নেপালের সাথে মিডে ট্রায়াংগেল ক্রিয়েট করলো। ছোট ছোট পাসে বিল্ড আপ করে উইং কিংবা মিডল দিয়ে আক্রমণ করার প্রচেষ্টা। আরে এই তো পেপ এর বার্সার টিকিটাকা!

জেমি ডের আগে মারুফুল হকের সময়েও মোটামুটি ছোট কিংবা আমাদের কাছাকাছি মানের ফুটবল দল হলে নিজেরা পাসিং ট্রাই করি। আবার বড় দল তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান দের বিপক্ষে কাউন্টার এট্যাক ফুটবল।

এখানে আমাদের ফুটবলের স্টাইল কোনটি? এক ম্যাচে পাসিং ফুটবল আরেক ম্যাচে ডিফেন্সিভ শেইফে কাউন্টার এট্যাক ফুটবল। তার মানে কী, আমাদের নিজস্ব কোনো ফুটবল স্টাইল নেই?

আর এটাই বাংলাদেশের ফুটবলের মূল সমস্যা। আমরা কোনো একটা স্টাইলে ধারাবাহিক ফুটবল খেলে যাচ্ছি না।

দুইটি ভিন্ন ঘরানার ফুটবল খেলতে গিয়ে বাংলাদেশের অবস্থা হয়েছে না ঘার কা না ঘাঠ কা!

এভাবে ম্যাচ খেলতে খেলতে না আমরা পাসিং ফুটবল টা রপ্ত করতে পারতেছি, না আমরা কাউন্টার এট্যাকে পারফেক্ট হতে পারতেছি। এখন কথা হচ্ছে আমাদের ফুটবল খেলার ধরন কেমন হওয়া উচিত?

এই প্রশ্নের উত্তর আসলে আমাদের মনের উপর। আমাদের হৃদয়ে ঠিক কোন ধরনের ফুটবল খেলাটা ধারণ করে? তৃণমুল পর্যায়ে যে ছেলে বড় হয়ে মেসি কিংবা রোনালদো হবার স্বপ্ন দেখে, সে ঠিক কোন ধরনের ফুটবলটা খেলে থাকে তার উপর নির্ভর করে।

সবাই এক বাক্যে এইটা মেনে নেবেন যে আমাদের ফুটবলে লাতিনদের একটা জায়গা আছে। আমাদের ফুটবল মানেই বড় একটা অংশের কাছে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা। আর স্যাটেলাইট চ্যানেলের সহজলভ্যতা, মন মাতানো ফুটবল এবং লিওনেল মেসির কারণে বার্সেলোনার প্রতি বাংলাদেশের একটি আলাদা স্থান তৈরী হয়ে গেছে। উপরের এই তিনটি দলের খেলার ধরন বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে তাঁদের মধ্যে যে বেসিক মিল রয়েছে, সেটি হলো – পাসিং ফুটবল।

এই পাসিং ফুটবল টাই আসলে আমরা আমাদের হৃদয়ে ধারণ করি।

আমাদের ছোট বাচ্চারা ফুটবল মানে বোঝে যে-কাটিয়ে (ড্রিবলিং) সামনে যাও, আর পাস দাও। আমাদের বেসিক ফুটবল টাই হচ্ছে এটি। এইসব জোনাল মার্ক, কাউন্টার ফুটবল আসলে একাডেমিতে আসলে কিংবা একাডেমি পার হলেই তরুণরা জানতে পারে। এখন তাদের যদি এতদিন শিখে আছে ফুটবলটা রপ্ত না করে আরেকটা দেয়া হয় তাহলে সেটি বুমেরাং হবার চান্সই বেশি।

এইবার আসা যাক শারীরিক দক্ষতা কেমন। কাউন্টার ফুটবলে যে শারীরিক গঠন দরকার সেটা জেনেটিক কারণেই আমরা ফুলফিল করতে পারবো না। ইউরোপিয়ানদের মত আমরা হাটুকাটা কিংবা লম্বা শরীরের অধিকারী না। তাদের মত গতিও আমরা কোন কালেই জেনারেট করতে পারবো না। কাউন্টার অ্যাটাকের ফুটবলের জন্যে স্পিডি ৪-৫ টা পাস প্রপার হওয়ার সাথে দ্রুতগামী খেলোয়াড় হওয়াও জরুরি; যারা বাতাসের সাথে দুর্দান্ত। আমরা না জেনুইনলি স্পীডি জাতি, না আমরা লম্বা। যেখানে আমাদের ফুটবলাররা ছোট ছোট ৮-১০ টি পাসই টানা খেলতে পারে না, সেখানে এই টাইপের ফুটবল নিয়ে সফল হওয়ার চিন্তা ভাবনা করা ভুল।

তাই আমাদের ফুটবল টা হওয়া উচিত ‘পাসিং ফুটবল’।  সেটা দিয়েই আমাদের মাথা উচু করে দাড়াতে হবে।

আন্ত:স্কুল টুর্নামেন্ট, পাওনিয়ার লিগ, একাডেমি লিগ, জুনিয়র ফুটবল লিগ, ক্লাব ফুটবল সব জায়গাতে একই ফুটবলের চর্চা হওয়া জরুরি।

হ্যা, কাজটা অনেক কঠিন মানতে হবে। এতে প্রচুর সময়ও দরকার। কিন্তু এটা ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ ও নেই।

এই যে ব্রাজিল জোগো বনিতো, আর্জেন্টিনা ট্যাঙ্গো, ইতালি কাতানোচ্চিও, হল্যান্ডের টোটাল ফুটবল বা বার্সেলোনার টিকিটাকা।

এসব ঘরনার ফুটবল কি একদিনে হয়েছে?

তারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একটা নির্দিষ্ট ধারার ফুটবল খেলে গেছে। আমাদেরও  ঠিক একই কাজ করতে হবে সফল হতে হলে।

ব্রাজিল যে জোগো বনিতো খেলতে পারে এর কারণ তাদের ক্লাব গুলো সান্তোস হোক কিংবা ফ্লামিংগো এরা এই স্টাইলে খেলে। ঠিক তেমনি আর্জেন্টিনার ট্যাঙ্গো সময়টা বোকা হোক কিংবা রিভারপ্লেট একই স্টাইলে খেলতো। ইতালিতে প্রত্যেক বাচ্চা ডিফেন্সিভ ফুটবল ট্যাক্টিস ‘কাতানোচ্চিও’ খেলে বড় হয়। এজন্য তাদের ক্লাবগুলো তাদের টিকিটাকা কিংবা কাউন্টার এট্যাকে খেলায় না। তারা শিকড়টি আগলে ধরে সেটাই মজবুত করার ফলে আজ তারা মহিরুহ জায়ান্ট!

আমাদের দেশের ফুটবলেও একই কাজ করা উচিত এতে কোন সন্দেহ নেই। দেশের বড় ক্লাব গুলোর সঠিক সময়ের খেলার পাশাপাশি একটি নির্দিষ্ট ঘরাণার ফুটবলের চর্চা করা উচিত। তাহলেই ফল আসবে।

না হলে কিছু দিন ব্রাজিল জিতলে তাদের ফুটবল, বায়ার্ন ট্রেবল জিতলে তাদের স্টাইলের ফুটবল, এভাবে কোন ধরনের ফুটবলই রপ্ত করা সম্ভব নয়। আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকেই তার শিক্ষা নিতে পারি। কেউ সারা জীবন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, পাইলট, সবকিছুই হবার চেস্টা করতে গেলে দিন শেষে সে কিছুই হতে পারবে না। সে কিছু একটা হতে পারে যদি ধৈর্য ধরে নির্দিষ্ট কিছু একটার চেষ্টা করে যায় দিনের পর দিন।

এভাবে কিছু দিন পর পর স্টাইল চেঞ্জ করে খেললে ২০০ বছরেও আমরা কোন স্টাইলের ফুটবলেও মানিয়ে নিতে পারবো না।  যদি একটা স্টাইলে দিনের পর দিন, জেনারেশনের পর জেনারেশন একই ধরানার ফুটবলের চর্চা করে যাই। তাহলেই সাফল্য আসবে। ফুটবলে কোন শর্টকার্ট সফলতার রাস্তা নাই, ফুটবল একটি সায়েন্স। নির্দিষ্ট ফর্মুলা মেনে না চললে এক্সপেরিমেন্ট এখানে দিনের পর দিন করলেও ফলাফল হবে জিরো।

তাই আমরা যে ঘরানার ফুটবলটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করি, যে ঘরানার ফুটবলটা আমাদের ফিজিক্যাল এবিলিটির সাথে যায়, সেই ঘরানার ফুটবলটাই আমাদের চর্চা করাই উচিত। আজ না হোক কাল,বছরের বছর চেষ্টা করলেই একদিন আমরা এতে সফল হবোই হবোই। সে জন্য আমাদের ফুটবলের আগে একটা ডায়াগ্রাম সেট করা উচিত। আমাদের সাথে এই ফুটবল খেলার ধরনটি যায়, আমরা এই ফুটবলটাই খেলবো। পৃথিবীতে হাজার হাজার ফুটবল টিমের হাজার রকমের ফুটবলের স্টাইল। দিন শেষে তারাই সফল যারা তাদের নিজেদের ফুটবল টাকে ভাল ভাবে রপ্ত করেছে।

এখন যুক্তি দেওয়া যাবে টাকা বিনিয়োগ করলেই তো হয়, এতো স্টাইলের কি দরকার?

যদি টাকা বিনিয়োগ করলেই সব হতো তাহলে চীন, কাতার, আমিরাত কবেই বিশ্বকাপে রেগুলার হতো এবং নিয়মিত সেমি কিংবা ফাইনালে খেলতো! কিন্তু তারা এশিয়ান কাপেই সীমাবদ্ধ। কেন? কারণ তাদের নির্দিষ্ট কোন ফুটবল খেলার স্টাইল নেই। এই যে কাতার এখন নিজস্ব স্টাইল খুজে পেয়েছে সে হিসেবেই তারা নিজেদেরকে প্রস্তুত করেছে ফলাফল এখন তারা বর্তমান এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন! নিয়মিত ব্রাজিল,আর্জেন্টিনার মতো দলের সাথে টক্কর দিচ্ছে!

পরিশেষে বলা যায়, বিশ্ব ফুটবলে আমাদের নাম কামাতে চাইলে, আগে আমাদের ফুটবল খেলার একটি নাম থাকা জরুরি! আমাদের নিজেদেরেই একটি নির্দিষ্ট স্টাইলের ফুটবলে শিকড় গেঁড়ে বসতে হবে। তাহলেই একদিন আমাদের ফুটবল টা মহিরুহ হবে। ফুটবলের এই রমরমা সময়েই আমাদেরকে  একটি ভিত্তি স্থাপন করা জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link