আবার বলব, শুধু তোমাকেই চাই

মৃত্যুর ছোবল সামনে থেকে দেখার দুর্ভাগ্য সকলের হয় না। করালগ্রাস বড় ভয়ঙ্কর। শোকাবহ তৈরি করার সামান্যতম সুযোগটুকুও সে দেয় না। নিমেষে ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায় সেই মানুষটাকে, যাকে একটু আগেও হাসতে দেখা গেছে।

চলে ফিরে বেড়াতে দেখা গেছে। কোথাও যেন এক হয়ে গেল পৃথিবীটা। কোথাও যেন আপামর মানবজাতির মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠল কোপেনহেগেনের ফুটবল স্টেডিয়াম। শুধু ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনের পড়ে যাওয়া। এরিকসেনের হৃদযন্ত্রে গোলযোগ। এরিকসেনের অসুস্থতা।

নাহ্। আজ এই প্রথম খেলা সম্পর্কিত এমন একটা ঘটনা নিয়ে লিখতে হচ্ছে যা আসলেই আকস্মিক। যার তীব্রতা বড় ভয়ানক, বেদনার পরাকাষ্ঠা। কে জানত, অমনভাবে খেলতে খেলতে হঠাৎ মৃত্যুর দরজা চোখের সামনে দেখে ফেলবেন এরিকসন?

ঠিক যেভাবে ভারতবর্ষে একদা এরকম দরজা দেখে ফেলেছিলেন জুনিয়র। আমারই কয়েকজন চেনা-পরিচিতদের মুখে বারবার ফিরে আসলো জুনিয়রের কথা। সূদূর প্রাচ্যের একটি ক্লাবে খেলতে খেলতে যার জীবনাবসান ঘটে গিয়েছিল মাঠেই। এরিকসেন আর জুনিয়র, দু’জন দু’জনকে চেনে না। তবু তারা কোথাও মিলে গেল এক ছত্রে। কেউ জানল না, অলক্ষ্যে কেউ এক ঝলক হাসি দিয়ে গেল।

এরিকসেন পড়ে যাওয়ার পর সারা পৃথিবীতে নিমেষে মনখারাপের খবর ভেসে এল। রুপায়ণ ভট্টাচার্যের লেখা পড়ছিলাম। সেখানে জানলাম, বিবিসি’র ধারাভাষ্যকার হিসেবে সেস্ক ফ্যাব্রেগাস, গ্যারি লিনেকারদের পাশে বসে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন মহিলা ফুটবলের তারকা অ্যালেক্স স্কট।

তিনি কেঁদে ফেললেন লাইভ সম্প্রচারে এবং পরক্ষণেই নিজেকে সামলে তাঁর মাকে টেক্সট করলেন, ‘মা, আমি তোমাকে ভালবাসি।’ সারা পৃথিবী জুড়ে আজ এভাবে সবাই নিজের প্রিয়জনের খবর নিয়েছেন। সে ভাল আছে তো? রাতের খোলা জানলায় বসে ভেবেছে ব্যর্থ প্রেমিকা।

এরিকসেনের মাটিতে পড়ে যাওয়া মিলিয়ে দিয়েছে গোটা পৃথিবীকে। পরের বেলজিয়াম-রাশিয়া ম্যাচে শুরুর দশ মিনিটে গোল করে সে গোল রোমেলু লুকাকু উৎসর্গ করলেন ইন্টার মিলানে তাঁর সতীর্থ ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেনকেই। এরিকসেন একা শুধু অসুস্থ হন নি, সঙ্গে একজোট করে দিয়ে গেলেন গোটা একটা অসুস্থ পৃথিবীকে। দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে এটাই সোনার লিখন হয়ে রইল।

আজই লিখেছিলাম, ’৯২-এ ইউরোতে ডেনমার্কের চমক। লিখেছিলাম তাদের লড়াই, তাদের স্বপ্ন। খুব অবিশ্বাস্য লেগেছিল পরে। সে লেখার চব্বিশ ঘণ্টা কাটতে না কাটতে সেই ডেনমার্কের তারকা মিলিয়ে দিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের প্রার্থনা। ক্যাপ্টেন সাইমন কেজার মুখে মুখ রেখে এরিকসেনের জিভ সচল রাখছিলেন, কারণ জিভ গিলে ফেললে এরিকসেনকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়ত। প্রত্যেক টিমমেট এসে হার্ডল করে দাঁড়ালেন।

এরিকসেনের ক্রন্দনরতা স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন ক্যাপ্টেন। বিবিসি ক্ষমা চেয়ে নিল সেই সময় ক্যামেরা বাইট করার জন্য। ফেসবুক জুড়ে শুরু হয়ে গেল গোটা বিশ্বের প্রার্থনা। দু’দিকে দুটো সাদা কাপড়ে আড়ালে এরিকসেন চললেন হাসপাতালে। সঙ্গে তাঁকে ঘিরে রয়েছেন তাঁর ক্যাপ্টেন, তাঁর প্রতিটি সতীর্থ।

এরিকসেন বেরিয়ে যাওয়ার পর রেফারি যখন খেলা স্থগিত রাখার নির্দেশ দিলেন, গোটা মাঠ ফাঁকা। আর তখন একদিন থেকে সমস্ত ফিনিশগণ একত্রে চেঁচিয়ে উঠল – ক্রিশ্চিয়ান! উল্টোদিক থেকে সমস্ত ডেনিশ একযোগ কণ্ঠ মেলালো – এরিকসেন! পালা করে চলল গোটা মাঠ জুড়ে এরিকসেনের জন্য এই প্রার্থনা। এই অসম্ভব মন খারাপ করা পৃথিবীতে আবার নতুন সূর্যোদয়ের সন্ধান বোধহয় সেই ডেনমার্কই দিয়ে গেল।

প্রথম ম্যাচে হারা, পয়েন্ট লস হওয়া – এই শুকনো পরিসংখ্যান নিয়ে আজ আর তেমন কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। ডেনমার্ক আজ আক্ষরিক অর্থে জিতে গেছে। জিতে গেছে তারা গোটা পৃথিবীর মন। যে যেখানে পেরেছে, এক টুকরো মেসেজ দিয়েছে, দিতে চেষ্টা করেছে তার প্রিয়জনকে। ‘কেমন আছ? ভাল?’ – শুধু এইটুকু কথা আমরা বলার সুযোগই পাই না। এরিকসনের মৃত্যুছোবল, সে সুযোগ করে দিল এক নিমেষে। শুধু প্রার্থনা, যারা হয়তো কখনও ফুটবল দেখেও না, তারাও সে প্রার্থনায় সামিল হয়েছে।

আমি বারবার তাই ফুটবলের প্রেমে পড়েছি। সুমন লিখেছেন না – ‘আবার আসব, আবার বলব, শুধু তোমাকেই চাই।’ লং লিভ ফুটবল। লং লিভ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link