অজয় জাদেজা, মিস্টার কুল

জাদেজা আমার দেখা প্রথম ‘কুল’ ক্রিকেটার। চিরতরুন লুকস, ক্যাজুয়াল হাঁটাচলার ধরন, সারাক্ষন মুখে একটা লোপ সাইডেড হাসি লেগে রয়েছে। নিজেকে, ক্রিকেটকে, জীবনকে – কোনকিছুকেই খুব বেশি সিরিয়াসলি নিতেন না। কিন্তু সেদিন সম্ভবত কুম্বলের শটদুটি দেখে কিছুটা তার ইগোয় লেগেছিল। কুম্বলে চার মারছে আর আমি পারবো না?

ক্রিকেটের রাজসূয় যজ্ঞ আরম্ভ হতে আর অল্প কটা দিন বাকি। যারা আমাদের বয়সী, অর্থাৎ ৫০-এর আশেপাশে, তাদের বিশ্বকাপের স্মৃতি সম্ভবত ১৯৮৩ থেকে আরম্ভ। আমি অবশ্য ১৯৮৩র বিশ্বকাপ সরাসরি দেখিনি। কিছুটা শুনেছি, অনেক বেশি পড়েছি। তারপর ইদানিং ইউটিউবের কল্যানে এবং ওই বিষয়ে একটা সিনেমা হওয়ায় মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে সেই বিশ্বকাপ সম্বন্ধে।

সেই হিসেবে আমার প্রথম দেখা বিশ্বকাপ ১৯৮৭। তবে সেই বিশ্বকাপের স্মৃতি তেমন সুখের নয়। কপিল – মোরের একটা পার্টনারশিপ, সানির জ্বর নিয়ে সেঞ্চুরি – এর বাইরে আর তেমন কিছু ডিটেলে মনে নেই। কোনও পারফর্মেন্সও তেমন মনে দাগ কাটে নি।

১৯৯২’ও তাই। তারপর ১৯৯৬। সেইবার শচীন ঐশ্বরিক ফর্মে। তবে শচিন নয়, সেই বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে এমন একজনের পারফর্মেন্স মনে রয়ে গেছে যা দেখে আমি নিজেই কিছুটা অবাক। কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত – পাকিস্তান মুখোমুখি। একরাশ উদ্বেগ নিয়ে আমরা টিভির সামনে বসলাম কারণ কাগজে কলমে পাকিস্তান অনেকটাই বেশি শক্তিশালী।

তবে ম্যাচ আরম্ভ হওয়ার আগেই একটা মন ভালো করে দেওয়া খবর – ওয়াসিম আকরাম অসুস্থতার কারনে খেলছেন না। সেই নিয়ে অবশ্য পরে বিস্তর জলঘোলাও হয়েছিল। সে যাকগে!

তবে আক্রাম না থাকলেও ওয়াকার রয়েছেন, আকিব জাভেদ রয়েছেন। এবং শচিন – আজহার সহ ভারতের মূল ব্যাটিং অলরেডি প্যাভিলিয়নে। উইকেটে রয়েছেন ‘বিটস এন্ড পিসেস’ ক্রিকেটার অজয় জাদেজা – যাকে অনেকটা তাসের জোকারের মতো যখন খুশি যে কোন অর্ডারে ব্যাট করতে পাঠানো হত। এবং অনিল কুম্বলে – যার বিগ হিট মানে লঙ অনের হাতে লোপ্পা ক্যাচ। ৪৭ ওভার অব্দি হিসেব বলছে যে দুজনে মিলে যদি বলপ্রতি এক রান করেও তোলে তাহলেও ভারতের স্কোর ২৫০ পেরোবে। কিন্তু পারবে কি?

ওয়াকারের সামনে কুম্বলে। আমরা ভাবছি কোনরকমে একটা রান নিয়ে কুম্বলে স্ট্রাইক দিন জাদেজাকে। কুম্বলেরও সম্ভবত সেরকমই কিছু প্ল্যান ছিল। কিন্তু টো ক্রাশিং ইয়র্কারের জায়গায় পরপর দুটো ওভারপিচ বল করে বসলেন ওয়াকার, একদম আদর্শ স্লটে। যাকে বলে জ্যুসি হাফ ভলি। আমরা মাথায় হাত দিয়ে হাসছি – শেষে কুম্বলে কিনা ওয়াকারকে পরপর দুটো চার মেরে বসল! এবং তারপর নিজের রোল খেয়াল হওয়ায় অজয় জাদেজাকে স্ট্রাইক ফেরত দিল।

জাদেজা আমার দেখা প্রথম ‘কুল’ ক্রিকেটার। চিরতরুন লুকস, ক্যাজুয়াল হাঁটাচলার ধরন, সারাক্ষন মুখে একটা লোপ সাইডেড হাসি লেগে রয়েছে। নিজেকে, ক্রিকেটকে, জীবনকে – কোনকিছুকেই খুব বেশি সিরিয়াসলি নিতেন না। কিন্তু সেদিন সম্ভবত কুম্বলের শটদুটি দেখে কিছুটা তার ইগোয় লেগেছিল। কুম্বলে চার মারছে আর আমি পারবো না?

ওয়াকারের পরপর চারটে বলে ২০ রান নেন জাদেজা সেদিন (সেই ওভার ও পরের ওভারের প্রথম দুই বল মিলে)। তার মধ্যে দুটো শট আজও চোখে লেগে রয়েছে। একটা লং অন আর মিড উইকেটের মাঝখান দিয়ে ছোট্ট কব্জির মোচড়। দর্শকদের মাঝখানে উড়ে গেছিল ওয়াকারের বল। পরেরটা মাখনের মধ্যে দিয়ে ছুরি চালানোর ঢঙ্গে পয়েন্টের পাশ দিয়ে স্লাইস – আমাদের মুখ দিয়ে কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই ‘আঃ’ শব্দ বেরিয়ে এসেছিল।

সেদিন ২৫ বলে ৪৫ করেছিলেন জাদেজা। আজকের স্ট্যান্ডার্ডে ওটা বড়জোর ‘বেশ ভালো’ ইনিংসের দলে পড়বে। কিন্তু তখনকার দিনে ওয়াকারের বলে এরকম মারকাটারি ব্যাটিং জাস্ট অকল্পনীয় ছিল। তাও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জাদেজার কাছ থেকে (এবং কিছুটা কুম্বলে)।

তবে ভারতের বড় স্কোরের বিরুদ্ধে পাকিস্তানও খারাপ আরম্ভ করে নি। আর করবে নাই বা কেন? আমির সোহেল, সইদ আনোয়ার, ইঞ্জামাম, সেলিম মালিক, জাভেদ মিয়াদাদ – রীতিমত স্টার স্টাডেড ব্যাটিং লাইন আপ পাকিস্তানের। ব্যাট হাতে মস্তানি আরম্ভও করে দিয়েছিলেন সোহেল। প্রসাদকে চার মেরে স্কুল মাস্টারের ঢঙ্গে আঙুল তুলে শাসন করলেন। এবং তারপরের বলেই নিজের অফ স্ট্যাম্প খোয়ালেন।

অবশেষে ভারত জিতল। পাড়ায় পাড়ায় পটকা ফাটল। পরে শুনলাম কয়েকজন বন্ধু নাকি বাইক নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করে বেড়িয়েছিল ভোররাত অব্দি। তার মধ্যে একজন পরে বলেছিল, ‘মা কালী বলছি, আমার তো জামাকাপড় খুলে নাচতে ইচ্ছে করছিল। শালা এই বুড়া আমাকে আটকাল – না হলে সেদিন আমি ……’ বুড়া হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘সত্যি বে! মালটার মাথায় সিওর ছিট আছে!’

আমরা খুব হেসেছিলাম। ছেলেটার আবেগ কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...