ফ্লোরেন্সের দেবদূত

বাতিগোল ছিলেন একেবারে টিপিক্যাল নাম্বার নাইনের মতন চতুর, সুযোগ সন্ধানী। অন্যের জন্যেও সুযোগ তৈরি করে দিতেন। ছিল ক্ষিপ্র গতিতে ছোটার মনোভাবও। নিতে পারতেন দারুণ সব ফ্রি-কিকও। বাতিস্তুতাকে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। নাইলে জ্যাপ স্টামকে বোকা বানিয়ে ইউনাইটেডের বিপক্ষে করা ওই লং রেঞ্জ গোলটাকে কী বলা উচিত!

শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েট নাটকের জায়গাটা ছিল ইতালির ভেরোনা। এই রোমান্টিক ট্র‍্যাজিক নাটকের নাম শুনেনি বা এটার উপরে নির্মিত ছবি দেখেনি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। ভেরোনার মতন ইতালির আরেক রাজ্যেও এমন রোমাঞ্চ পরবর্তীতে ট্র‍্যাজিক ঘটনা ঘটেছিল। ওই জায়গার নাম ফ্লোরেন্স।

আর সেই নাটকের (পড়ুন বাস্তব) রোমিও ছিলেন এক আর্জেন্টাইন আর জুলিয়েট ফ্লোরেন্সের এক ফুটবল ক্লাব।গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা আর ফিউরেন্টিনার কথা বলছি আমি। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু সেই প্রেমকাহিনী। সম্পর্কটা ছিল এক দশকের। টানাপোড়েনের মধ্যেও ভেঙে যায়নি।

বাতিস্তুতা ফুটবলে আমার প্রথম প্রেম।আর্জেন্টিনা ভক্ত হবার কারণটাও সেই বাতিগোলই। বাতিস্তুতার একটি অদ্ভুত কীর্তি আছে। আর্জেন্টিনার তিনটি বিখ্যাত ক্লাবেই খেলেছেন। এর মধ্যে রিভার প্লেট-বোকা জুনিয়র্সও ছিল। দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী। এমনকি রিভার থেকে বোকাতে যাবার হার্কুলিয়ান টাস্কটাও রয়েছে।

নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজে বাতিগোলকে নিয়ে আসেন মার্সেলো বিয়েলসা। তখন বাতিস্তুতা ছিলেন বেশ মোটা।বৃষ্টির মধ্যে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল অনুশীলন করতে আর খাদ্যাভ্যাস বদলাতে। বাতি জীবনেও ফুটবলার হতে চায়নি। ছয় ফুটের বেশি লম্বা ছিলেন বিধায় বাস্কেটবলে মন দিয়েছিলেন আর পড়াশোনায়ও ভালো দেখে ভেবেছিলেন ডাক্তারি পড়বেন।

কিন্তু সব উলটপালট করে দেয় মারিও কেম্পেস আর ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ। ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জয় দেখে নেমে পড়লেন ওই বিখ্যাত আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে জড়ানোতে।

নিউওয়েলস থেকে রিভার ঘুরে বোকায় গেলেন। ১৯৯১ সালের কোপা আমেরিকায় নজরকাড়া পারফরম্যান্স আর বোকায় দারুণ সব গোল করে ইউরোপের নজরে আসলেন এবং গেলেন নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, গ্যালিলিও, লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির শহর ফ্লোরেন্সে। আর বাকিটা, হ্যাঁ ওই গতানুগতিক লাইন ইতিহাস।

ফিউরেন্টিনার সেই বেগুনি রঙের জার্সি গায়ে বাতিগোল প্রথম মৌসুমেই নিজেকে চেনালেন এবং ক্লাবকে বাঁচালেন রেলিগেশনের হাত থেকে। কিন্তু পরবর্তীতে ঠিকই ক্লাব চলে যায় দ্বিতীয় বিভাগে। সবাই ভেবেছিল বাতিও ক্লাব ছেড়ে দিবেন, এমন তারকা কে না চায়!

কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে বাতিস্তুতা রয়ে গেলেন ফ্লোরেন্সেই আর তাঁরই নৌকায় পাড়ি জমিয়ে ফিউরেন্টিনা ফিরে আসল সিরি ‘এ’-তে। কিংবদন্তি কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন বাতিস্তুতার বিশেষ ভক্ত ছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন ইউনাইটেডেও। তাঁকে চেয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদও কিন্তু ফিউরেন্টিনা তো তার জুলিয়েট।

ফিউরেন্টিনাকে দিয়েছেন নিজের সবকিছু উজাড় করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্লাব ছাড়লেন, গেলেন রোমাতে। জিতলেন পরম অধরার স্কুদেত্তো। রোমার শিরোপা জয়েও অবদান বাতির। করেছিলেন ২০ গোল আর তাই পরের মৌসুমে তাঁর জার্সি নাম্বার ছিল ২০। এরপরের সিজনে পরেছিলেন আবার ৩৩, কারণ বয়সটা তার তখন ৩৩!

বাতিগোল ছিলেন একেবারে টিপিক্যাল নাম্বার নাইনের মতন চতুর, সুযোগ সন্ধানী। অন্যের জন্যেও সুযোগ তৈরি করে দিতেন। ছিল ক্ষিপ্র গতিতে ছোটার মনোভাবও। নিতে পারতেন দারুণ সব ফ্রি-কিকও। বাতিস্তুতাকে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। নাইলে জ্যাপ স্টামকে বোকা বানিয়ে ইউনাইটেডের বিপক্ষে করা ওই লং রেঞ্জ গোলটাকে কী বলা উচিত!

এমন অসংখ্য অসংখ্য গোল করেছেন যা শুধু চোখের শান্তি। বাতির ভলিতে করা গোলগুলোও চোখে ভাসে আমার। এমন এক গোল করেছিলেন ফিউরেন্টিনার বিপক্ষে রোমায় হয়ে। গোল করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সেদিন। ফিউরেন্টিনার দর্শকদের চোখেও ছিল জল। মানতে পারেনি তারা কিংবা বাতিগোল নিজেই।

ক্ষমাও চেয়েছিলেন পরে, আর আগে করেছিলেন তাঁদের দূর থেকে আলিঙ্গন। লম্বা চুলের বাতিস্তুতার গোল করে দুদিকে হাত ছড়িয়ে উৎযাপন ছিল ফুটবলের অন্যতম আকর্ষণীয় দৃশ্য। দেখতে সুদর্শন বাতি হতে পারতেন সিনেমার নায়কও। শেক্সপিয়ারের রোমিওর সাথে তুলনা তো আর এমনি এমনি করিনি।

পরপর দুই বিশ্বকাপে দুই হ্যাট্ট্রিক যে রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। হয়তো সামনে কেউ ভেঙে ফেলবে কারণ রেকর্ডস আর মেন্ট টু বি ব্রোকেন। কিন্তু ভক্তদের মনে বাতিগোলের যে জায়গা সেটি কস্মিনকালেও কেউ নিতে পারবে না। পৈত্রিকসূত্রে বাতিস্তুতার অরিজিন অ্যারাবিয়ান। মাঝের নাম ওমর আসে সেখান থেকেই। শুরুর গ্যাব্রিয়েল তো অ্যাঞ্জেলিক নাম। ফুটবল স্বর্গ থেকে আসা বাতিস্তুতা আসলেই ছিলেন একজন অ্যাঞ্জেল যিনি আমাদের মুগ্ধ করেছিলেন তার খেলা দিয়ে আর দিয়েছিলেন শান্তি-মুক্তিও।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...