– কল্পনাশক্তি যদি কারো ক্রিকেটপ্রেমের সঙ্গে মিশে যায়, কি হয় বলতো ভাই?
– ওকিফি?
– দূর ! রবীন্দ্রনাথ।
– মানে টা কি? বোঝা ঠিকঠাক। নইলে স্ট্রেট ক্যাল খাবি আমার হাতে।
শোন তবে। প্রবল কল্পনাশক্তি ক্রিকেটপ্রেমের সঙ্গে মিশিয়ে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, রবীন্দ্র জাদেজার স্পিনে পরপর চারটে ছয় মারলেন অরবিন্দ ডি সিলভা আর তারপর তাকে প্রণাম করছেন রবীন্দ্র জাদেজা।
– সে আবার কি? কিসে বুঝলি?
– ঐ যে তারপরে তিনি লিখলেন ‘অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার।’ বোঝা গেল ভাই?
– ভাই, মাথাটা স্পিন করছে কেমন! আমাকে ছেড়ে দে তুই এখন।
অনেকদিন আগে একটা সময় এইসব ছাইপাঁশ লিখতাম, যা হয়ত যে কেউ লিখতে পারতেন। তখন জানতাম না, বড় হয়ে সত্যিই যাকে তাঁকে (পড়ুন, সেরা স্পিনারদের) চার-ছয় মেরে দিতেন ছোটবেলায় বেঢপ ব্যাট নিয়ে ব্যাট করা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির অরবিন্দ ডি সিলভা – বিশ্ব ক্রিকেটের ‘ম্যাড ম্যাক্স’।
১৯ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ার আর ২০ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ার ছিল ভদ্রলোকের। ১৯৬৫ সালে জন্মানো অরবিন্দ ডি’সিলভা ১৮ বছর বয়সে প্রথম টেস্ট খেলেছিলেন ১৯৮৪ সালে লর্ডসে, যে টেস্টে দিলীপ মেন্ডিস তুলোধোনা করেছিলেন ইয়ান বোথামকে। শুরুর টেস্টে অরবিন্দ করেছিলেন ১৯। এর ২ বছর বাদে, ২০ তম জন্মদিনের দিন ফয়সলাবাদে তিনি ৯৩ রানে অপরাজিত ছিলেন।
পরদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এসেছিল তার প্রথম টেস্ট শতক, সাড়ে আট ঘন্টায় বানানো ১২২। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যাটিং প্রদর্শন তাকে এনে দিয়েছিল ‘ম্যাড ম্যাক্স’ ডাকনাম, নামটা থেকে গিয়েছে পরের দিকের উজ্জ্বলতর খেলা সত্ত্বেও। ১৯৯৫ সালে নিচের সারির কেন্টের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলে সাতটি শতরান সমেত ৫৯.৩৬ গড়ে করেছিলেন ১৭৮১ রান। ১৯৯৬-এর ‘উইজডেন ক্রিকেটার অফ দ্য ইয়ার’ ছিলেন তিনিই।
ছয়টি টেস্টে আর ১১ টি ওয়ানডেতে অধিনায়ক ছিলেন শ্রীলঙ্কার, ১৯৯২ বিশ্বকাপেও শ্রীলঙ্কার অধিনায়কের নাম ছিল ২৬ বছর বয়সী অরবিন্দ ডি সিলভা। ১৯৯২ সালে কলম্বো টেস্টে অজিদের কাছে ১৬ রানে হেরেছিল শ্রীলঙ্কা, সে টেস্টে উইকেট ছুঁড়ে দেবার জন্য আজও নিন্দিত হন তিনি। আবার ১৯৯৪ সালে অস্ট্রালশিয়া কাপে তাকে দলে না রাখার প্রতিবাদে অর্জুন রণতুঙ্গাসহ অনেক সিনিয়র খেলোয়াড় নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন।
তার চার বছরের মধ্যেই অর্জুনা রানাতুঙ্গার অধিনায়কত্বে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সম্মান এনে দেবার টুর্নামেন্টে আসল ‘নায়ক; ছিলেন তখন তিরিশ অতিক্রান্ত তিনিই। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ৮৯.৬০ গড়ে আর ১০৭.৬৯ স্ট্রাইকরেটে তার ৪৪৮ রানের (সর্বোচ্চ রান ছিল শচীন টেন্ডুলকারের) মধ্যে ছিল ফাইনালে অজিদের বিরুদ্ধে লাহোরে অসাধারণ শতরান (অপরাজিত ১০৭) ও ৯ ওভারে ৪২ রানে ৩ উইকেট (মার্ক টেলর, স্টুয়ার্ট ল আর ইয়ান হিলি) আর টুর্নামেন্টে ২১.৭৫ গড়ে ৪টি উইকেট। ইডেনে ভারতের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালেও ২ উইকেটে ১ অবস্থায় ব্যাট করতে নেমে ৪৭ বলে তার ৬৬ শ্রীলঙ্কার জয়ের মুখ্য কারণ ছিল।
উইজডেন ২০০২ সালে ওয়ানডে নিয়ে বাছাই সংকলন করেছিল। তাতে ভিভ রিচার্ডসের সাতটি এন্ট্রির পাশে অরবিন্দ ডি সিলভার এন্ট্রিসংখ্যা ছিল ছয়টি। ওই সংকলনে তার ১৯৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের শতরান ছিল অষ্টম সেরা ওয়ানডে শতরান। ১৯৯২, ১৯৯৬, ১৯৯৯ ও ২০০৩ – মোট চারটি বিশ্বকাপ খেলেছিলেন তিনি, শ্রীলঙ্কার হয়ে। তার শেষ বিশ্বকাপ ইনিংস ছিল ২০০৩ এর সেমিফাইনালে, সেই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই, তার রান ছিল ১১, রান আউট হয়ে যাওয়ার আগে। তিনি নির্বাচক কমিটির প্রধান থাকাকালীন শ্রীলঙ্কা আবার বিশ্বকাপ ফাইনালে পৌঁছেছিল, ২০১১ সালে।
সারা জীবন তার আত্মজীবনীর নামের মতই – ‘অরবিন্দ: মাই অটোবায়োগ্রাফি’। সাধারণ থেকেও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে অসাধারণ এক মাইলফলক হয়েই তিনি ছিলেন, আছেন আর থাকবেন। তাঁর মত ক্রিকেটারকে নিছক পরিসংখ্যানে মাপতে যাওয়া তার চার-ছয় মারা আটকানোর মতই অসম্ভব ব্যাপার।
তবু রেকর্ড বই জানায় যে তার রান সংখ্যা ৯৩টি টেস্টে ৬৩৬১ আর ৩০৮টি ওয়ানডেতে ৯২৮৪। ওই ক্রমেই বাউন্ডারি মেরেছেন ৭৫৬ টি আর ৭১২ টি। আর ওভার বাউন্ডারি মেরেছেন ৪৮ আর ১০২ টি, ওই একই ক্রমে। ওই ক্রমেই শতরান ২০টি (যার মধ্যে দুটি দ্বিশতরান আছে) আর ১১ টি এবং অর্ধ-শতরান টেস্টে ২২টি আর ওয়ানডেতে ৬৪টি।
তার সর্বোচ্চ রান টেস্টে ২৬৭ আর ওয়ানডেতে ১৪৫। টেস্টে আর ওয়ানডেতে তাঁর উইকেটসংখ্যা ২৯ আর ১০৬, যথাক্রমে। টেস্টে আর ওয়ানডেতে তিনি ক্যাচ ধরেছেন ৪৩ টি আর ৯৫ টি, যথাক্রমে। প্রাক টি-টোয়েন্টি জমানায় টি-টোয়েন্টির ঝড়ো হাওয়াও এনে দিত তাঁর ব্যাট। টি-টোয়েন্টি তাকে না খেলতে দেখাটা ক্রিকেটেরই দুর্ভাগ্য ছিল।