তিনি আসছেন।
আউট হয়ে যাওয়া ব্যাটসম্যান মাথা নিচু করে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেছেন। তাকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি একটু অপেক্ষায় রাখছেন সবাইকে। হঠাৎ একটা বিদ্যুতের চমকের মতো তাঁকে দেখা যাবে বেরিয়ে আসতে।
পুরো স্টেডিয়াম দু পায়ে উঠে দাড়িয়েছে। গগনবিদারী করতালির মধ্যে তিনি আস্তে আস্তে হাটছেন এক অলস সিংহের মত। একটা করে হাত বাতাসে ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। যেনো এক রোমান গ্লাডিয়েটর এগিয়ে আসছে এম্ফিথিয়েটারের মাঝ বরাবর।
চিবিয়ে চলেছেন চুইংগাম। আস্তে আস্তে উইকেটের সামনে দাড়িয়ে গার্ড ঠিক করে নিলেন। দুই পা এগিয়ে ব্যাট দিয়ে আলতো টোকা দিলেন পিচে। এরপর চোখ দুটো সরু করে মর্মভেদি দৃষ্টিতে চাইলেন বোলারের চোখে। যেনো ভেতরের সবটা পড়ে ফেললেন। যেনো মোহাম্মদ আলী রিংয়ে দাড়িয়ে চোখের চাউনিতেই শেষ করে দিলেন প্রতিপক্ষকে।
হ্যাঁ, তিনি ক্রিকেটের মোহাম্মদ আলী। তিনি ২২ গজের গ্লাডিয়েটর। তিনি মুক্ত বনের সিংহ। তিনি ক্রিকেট নামে খেলাটিতে আক্রমণ ব্যাপারটির শেষ কথা। তিনি কিং রিচার্ডস; স্যার আইজ্যাক ভিভিয়ান অ্যালেক্সান্ডার রিচার্ডস।
ভিভ রিচার্ডসকে কারো সাথে তুলনা করতে নেই।
ম্যাথু হেইডেন, অ্যাডাম গিলক্রিস, বীরেন্দ্র শেবাগের থেকে শুরু করে আজকের ঋষভ পান্ত; এদের আপনি বলতে পারেন ভিভের তৈরী করে যাওয়া স্কুলের ছাত্র। ভিভ একটা প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানের মূল মন্ত্র ছিলো, ‘মারো এবং মেরে শেষ করে দাও। পেটানোই বলটার জন্য একমাত্র পাওনা।’
ভিভের বাবা ম্যালক রিচার্ডস অ্যান্টিগার হয়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন। এই দ্বীপরাষ্ট্রের সন্তান ভিভ পরে বলেছেন, তিনি বাবার কাছ থেকে এই ঔদ্ধত্যটা শিখেছিলেন। তিনি টিভিতে মোহাম্মদ আলীকে দেখে শিখেছিলেন, কেবল খেলা দিয়ে খেলার ফয়সালা হয় না। অ্যাটিটিউড দিয়ে প্রতিষ্ঠিত শেষ করে দিতে হয়, প্রতিষ্ঠিত করকে হয় নিজেকে।
সেটাই করে গেছেন আজীবন।
১২১ টেস্টে ৫০.২৩ গড়ে ৮৫৪০ রান। আর ১৮৭ ওয়ানডেতে ৪৭.০০ গড়ে ৬৭২১ রান। স্ট্রাইক রেট ৯০.২০।
স্ট্রাইক রেট নিয়ে পরে কথা বলি। আগে গড়টা একটা দেখুন। টেস্টে ৫০-এর ওপরে। ওয়ানডেতে ৪৭। আমরা মারকাটারি ব্যাটিং বলতেই বুঝি ঝুকি। এই ঝুকি জিনিসটা ভিভের চেয়ে বেশি কেউ নিয়েছেন বলে মনে হয় না। বলে বলে ‘ক্যালকুলেটিভ রিস্ক’। বলটা কাছে এলেই সেটাকে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু তাতে ভিভের উইকেট স্বস্তা হয়ে যায়নি। একের পর এক বড় ইনিংস খেলেছেন। এক তালে পেটাতে থেকে ২৯১ রান করে ফিরেছেন। ওয়ানডেতে এক সময়ের রেকর্ড, অপরাজিত ১৮৯ রানের ইনিংস খেলেছেন।
ওই যে বললাম, গড়। গড়টা দেখলেই বুঝতে পারবেন, ভিভের এই মারকাটারি ব্যাটিং তার উইকেটকে ঠুনকো করে দেয়নি। আর এটাই ভিভকে বাকীদের চেয়ে আলাদা করে ফেলেছে।
পেটাতে তো আমিও পারি। একটা গলির বাচ্চাকেও হাতে ব্যাট ধরিয়ে দিলে আড়াআড়ি পেটানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু ভিভ তো ওই ‘পিটিয়ে যাওয়া’ ব্যাটসম্যানটি নন। তিনি পায়ের কাছে পড়তে থাকা বলটাকে চোখ ধাধানো গ্লান্স করে সীমানা পার করেন, তিনি বোলারকে হতভম্ব করে পুল করে বল পাঠান গ্যালারিতে। ওতে বলে বলে লাইফ পাওয়ার ব্যাপার থাকে না।
এবার আসুন, একটু স্ট্রাইক রেট নিয়ে কথা বলি।
আজকাল অনেক নবীশ ব্যাটসম্যানেরও ওয়ানডে স্ট্রাইকরেট ১২০-এর ওপরে। তাহলে আমরা কেনো ভিভকে সর্বকালের সবচেয়ে অ্যাটাকিং ব্যাটসম্যান বলছি। বলছি, কারণ ভিভ ব্যাট করেছেন বোলারদের যুগে।
এখন ক্রিকেট ব্যাটসম্যানদের খেলা। এখন বাউন্সার দিতে পারেন না বোলাররা। এখন উইকেট সারা দুনিয়ায় ব্যাটসম্যানদের হয়ে কথা বলে। এখন বোলারদের হাতে আর কিচ্ছু নেই। আরেকটা সত্যি কথা বলি, সেই মানের বোলারও আর নেই।
ভিভ যখন ব্যাট করতেন, সেটা ছিলো অপ্রতিরোধ বোলারদের যুগ। তখন পেস কোয়াট্রেট, স্পিন চতুষ্টয় থেকে শুরু করে ইমরান-ওয়াসিম দুনিয়ায় রাজত্ব করে বেড়াচ্ছেন। সে সময় ব্যাটসম্যানরা ছিলেন জড়োসড়ো। সারা দিনে একটা চার মারতে পারলে ধন্য ধন্য পড়ে যেতো। তেমন একটা যুগে দাড়িয়ে ভিভ ব্যাট করতেন এই আজকের স্বাধীন, মুক্ত ব্যাটসম্যানদের মতো করে।
কী জানি, আজকের এই যুগ পেলে ভিভ কী করতেন!
এটুকু অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায় যে, লোকেরা আবার দু’পায়ে দাড়িয়ে পড়তো তাঁকে এক পলক দেখার জন্য। তার পেছনে বিজ্ঞাপনদাতারা লাইন লাগাতো। এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, আজও তিনি হেলমেট পরতেন না। আজও মুখটা শক্ত করে বলতেন, পুরুষ মানুষ হেলমেট পড়ে না।