উমর আকমলের মতো আলোচনায় তাঁকে পাবেন না। বাবর আজমের ব্যাটিংয়ের মোহনীয়তাও নেই ব্যাটিংয়ে। মোহাম্মদ রিজওয়ানের মতো জনপ্রিয়তা নেই তাঁর। তবে ধৈর্য কাশ্মীরি আর একাগ্রতার ছবি আঁকা হলে পাকিস্তান থেকে সেটা নিশ্চিতভাবেই আজহার আলীই হবেন।
ভারতের নাম্বার থ্রি যেমন ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়, দলের ভরসার পাত্র। পাকিস্তান জাতীয় দলে এই ভূমিকাই পালন করেছেন আজহার আলী। পরিসংখ্যানে দ্রাবিড় হয়তো অনেক এগিয়েই থাকবেন, কিন্তু পাকিস্তান দলে আজহারের ভূমিকাটা নেহায়েতই কম নয়। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই তিনি ছিলেন সমান ধারাবাহিক। মিসবাহ উল হকের সময়ে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন এই তারকা।
অথচ ছোটবেলায় ব্যাটসম্যান হওয়ার কথাই ছিল না এই তারকার। তাঁর বাবা এবং ভাই দুজনেই ছিলেন ক্লাব পর্যায়ের ক্রিকেটার। তাঁদের দেখেই মূলত ক্রিকেটের প্রেমে পড়া। তবে শুরুটা করেছিলেন লেগস্পিনার হিসেবে। জাতীয় দলের বয়সভিত্তিক পর্যায়েও ডাক পেয়েছিলেন স্পেশালিস্ট লেগস্পিনার হিসেবে। অনূর্ধ্ব-১৭ পর্যায়ে এসে ভাবেন ব্যাটসম্যান বনে যাবেন।
এরপরই নিজেকে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন, ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে খেলতে শুরু করেন। ১৯ বছর বয়সেই তিনি স্কটল্যান্ডে চলে যান এবং হান্টলি ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতে শুরু করেন। সেখানেই মূলত ধীরে ধীরে ব্যাটিংয়ের সকল বেসিক নিয়ম আয়ত্ত্ব করতে শুরু করেন আজহার।
তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম টার্নিং পয়েন্ট ২০০৭-০৮ মৌসুম। সেই মৌসুমে কায়েদে আজন্ম ট্রফিতে ৫০.২৫ গড়ে ৫০৩ রান করেন। পরের মৌসুমেও দলকে নিয়ে যান ফাইনালে, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সেই ম্যাচে করেন যথাক্রমে ৯৯ এবং ২৫ রান। এরপর ডাক পান পাকিস্তান এ দলের অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলংকা সফরের দলে। সেখানেই বজায় রাখেন রানের ধারা, প্রায় ৪০ এর বেশি গড় নিয়ে শেষ করেন সেই সফর।
আজহার আলী সেই গুটিকয়েক পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের একজন যাদের ওডিআই অভিষেকের আগেই টেস্ট অভিষেক হয়ে গিয়েছিল। ২০১০ সালে লর্ডসে অজিদের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক ঘটে আজহারের। নিজের দ্বিতীয় টেস্টেই জানান দেন নিজের প্রতিভার, ১৮০ রান তাড়া করতে নেমে ৫১ রানের ম্যাচজয়ী এক ইনিংস খেলেন তিনি।
জায়গাটা তিনি ধরে রাখেন পরের ইংল্যান্ড সিরিজেও, যদিও প্রথম দুই টেস্টে বলার মতো অবদান রাখতে পারেননি। কিন্তু ওভালে তৃতীয় টেস্টে অপরাজিত ৯২ রানের ইনিংস খেলে বুঝিয়ে দেন হারিয়ে যেতে আসেননি তিনি।
পরের বছরই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে নিজের ইস্পাত দৃঢ় মানসিকতার জানান দেন তিনি। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ইউনিস খানের সাথে সাথে চতুর্থ ইনিংসে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তিনি, এনে দেন জয়ের সমান ড্র। পরের টেস্টেও দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৯০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
টেস্টের মতো ওডিআই ক্রিকেট ক্যারিয়ারটা মসৃণ গতিতে এগোয়নি আজহারের। যদিও মিসবাহ উল হকের অবসরের পর জাতীয় দলের নেতৃত্বের ভার তুলে দিয়েছিল তাঁর কাঁধে। তাঁর অধীনেই নয় বছর বাদে শ্রীলংকাতে সিরিজ জিতেছিল পাকিস্তান।
তবে ২০১৩ সালে বাজে এক বছর কাটান তিনি। সাত টেস্টে তাঁর গড় নেমে গিয়েছিল ২০ এর নিচে। তবে শ্রীলংকার বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে ১৩৭ বলে ১০৩ রানের ইনিংস খেলে মহাকাব্যিক এক জয় এনে দেন পাকিস্তানকে।
২০১৬ সালে স্বপ্নের মতো এক বছর কাটান আজহার। দিবা রাত্রির টেস্টে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেন তিনি। দুবাইতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২৩ চার এবং দুই ছক্কায় ৪৬৯ বলে ৩০২ রানের চমৎকার এক ইনিংস খেলেন তিনি। হানিফ মোহাম্মদ, ইনজামাম উল হক এবং ইউনুস খানের পর চতুর্থ পাকিস্তানি ব্যাটার হিসেবে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেন তিনি। সেই বছরে ওপেনার হিসেবে ৯৮২ রান করেন এই তারকা যা কিনা মহসিন খানের পর পাকিস্তানিদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ হারের পর ওডিআই অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন আজহার। তবে অধিনায়কত্ব হারালেও পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে যথাক্রমে ইংল্যান্ড এবং ভারতের বিপক্ষে দুই ম্যাচেই ফিফটি হাঁকিয়ে দলকে জয়ের পথে এগিয়ে দেন। মিসবাহ এবং ইউনুসের অবসরের পর পাকিস্তানের ক্রিকেটকে সামনে এগিয়ে নিয়েছেন আজহারই।
সাদা বলের ক্রিকেটকে ২০১৮ সালে বিদায় জানালেও টেস্ট থেকে বিদায়ের ঘোষণা দেন ২০২২ সালে। টেস্টে জাতীয় দলের হয়ে ৯৭ ম্যাচে ১৯ সেঞ্চুরি এবং ৩৫ হাফ সেঞ্চুরিতে তাঁর সংগ্রহ ৭১৪২ রান। অন্যদিকে, ৫৩ ওডিআই খেলে তিন সেঞ্চুরি এবং ১২ হাফ সেঞ্চুরিতে তাঁর সংগ্রহ ১৮৪৫ রান।