পঁচাশির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের ‘চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়ন্স’ এর ক্রিকেট ক্যারিয়ার মাত্র তিরিশ বছর বয়সেই শেষ হয়ে যাওয়ার পেছনে যে তৎকালীন অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল সেটা বোঝার জন্য ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হাওয়ার প্রয়োজন বোধহয় পরে না।
হ্যাঁ, একদিনের ক্রিকেটে সেই সময় অত্যাধিক ধীর ব্যাটিং করছিলেন, বোলিংয়ের ধার কমে গিয়েছিল কিন্তু টেস্টে ওপেনার হিসেবে বিদেশের মাঠে মাত্র দেড় বছরের মধ্যে তিনটে শতরান করেও টেস্ট ক্রিকেট থেকে বাদ যাওয়ার কোন কারণ অন্তত: ছিল বলে মনে হয় না। যেখানে রবি শাস্ত্রীর বাদ যাওয়ার পরে নব্বইয়ের দশকের বাকি সময়টায় অর্থাৎ প্রায় আট বছরে টেস্টে ভারতীয় ওপেনারদের মোট শতরানের সংখ্যা দুই বা তিন (সিধুকে বাদ দিয়ে, কারন একদিকে সিধু থাকতো আর অন্যদিকে মিউজিক্যাল চেয়ার)।
আর সম্ভবত এই কারণেই কমেন্ট্রি বক্সে ঢোকার পর থেকে খুব বাধ্য না হলে শাস্ত্রী কোনোদিনই প্রকাশ্যে ব্যাটসম্যান বা অধিনায়ক আজহারের প্রশংসা করেননি। শাস্ত্রী কমেন্ট্রি করা অবস্থায় শচীন আউট হলে যেখানে তিনি যেনতেন প্রকারে তিনি বুঝিয়ে ছাড়তেন কেন ওই বলটা ম্যাচের মোস্ট আনপ্লেয়েবল বল, সেখানে তার পাঁচ শতাংশ সমর্থনও পেতেন না সীমিত ওভারের ক্রিকেটে প্রথম নয় হাজার রানের সংগ্রাহক।
নি:সন্দেহে ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম বিতর্কিত এবং অনেকের মতে, কলঙ্কিত ( যদিও কোর্টের রায় অনুযায়ী কলঙ্কমুক্ত) অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন। খেরোর খাতা বলছে গত ৩৪ বছরে ভারত দেশের মাটিতে মাত্র তিনটি টেস্ট সিরিজ হেরেছে। ২০০০ এ দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৪ এ অস্ট্রেলিয়া এবং ২০১২ সালে ইংল্যান্ডের কাছে।
ভারতের দেশের মাটিতে এহেন বিজয় রথের শুরু যে মানুষটার হাত ধরে হয়েছিল তাঁর নাম আজহারউদ্দীন, সহযোগিতায় অজিত ওয়াদেকার। চিরকাল স্পিন এবং স্পিনারের স্বর্গরাজ্য ভারত হলেও স্পিনার ব্যবহার করে তাঁদের আগে এভাবে দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য কেউ আনতে পারেনি। কোনভাবেই এই সময়ের আগের স্পিনারদের আনা সাফল্যকে ছোট না করেই বলি সেগুলো বিক্ষিপ্ত ছিল, সেটাকে দেশের মাঠে টার্নিং পিচ বানিয়ে কুম্বলে-রাজু-চৌহানকে লেলিয়ে দিয়ে এক যুগ ধরে দেশের মাঠে অপরাজেয় (তার মধ্যে এক বছরের কিছু বেশি সময় শচীন অধিনায়ক ছিলেন) করে ছাড়েন আজহার।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তাঁদের আমদানি করা এই স্ট্রাটেজি পরবর্তীতে সমস্ত ভারতীয় অধিনায়ক-কোচ জুটি যখনই বিপদে পড়েছেন তখনই ব্যবহার করেছেন। শচীন-কপিল, সৌরভ-রাইট, দ্রাবিড়-গ্রেগ, ধোনি কার্স্টেন, ধোনি-ফ্লেচার হয়ে হালের কোহলি-শাস্ত্রী।
না, দেশের মাঠে পছন্দের পিচ বানিয়ে স্ট্রাটেজি সাজিয়ে জেতার মধ্যে অন্যায় কোথাও নেই। কম বেশি বিশ্বের সব দেশই এটা করে থাকে। কিন্তু কেউ প্রেস কনফারেন্স করে ঢাক পেটায় না যে আমাদের এই দলটা জয় পরাজয় স্থান কাল পাত্রের উপর নির্ভর করে না।
প্রথম টেস্ট হারার পরে যেই বুঝতে পারলেন যে তৃতীয় টেস্টও পঞ্চাশ-পঞ্চাশ (যেহেতু গোলাপি বল টেস্ট), অমনি লর্ডসের স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে সেই নব্বইয়ের দশকের ভারতীয় অধিনায়কের প্রেসক্রিকশন আর্কাইভ থেকে টেনে বের করে আনলেন যাকে নিজের অবসর উত্তর জীবনে সুযোগ পেলেই সমালোচনা করতে ছাড়েননি।
ত্রিশ বছর আগে প্রয়োগ করা থিওরি আজও প্রয়োগ করে টেস্ট জেতান। কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ওই প্রেস কনফারেন্স এ এসে সস্তার বাহবা কুড়তে দয়া করে বলবেন না, যে এই দলটার জয় পরাজয় বাহ্যিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে না।
তবে, আজহারের থিওরি এই দলটার ক্ষেত্রে রোজ রোজ সাহায্য করবে না। এই দলটায় যেমন ভারতের সর্বকালের সেরা পেস বোলিং আছে তেমনি নিকৃষ্টতম স্পিন বোলিং খেলার ব্যাটিং লাইন আপ আছে। এই ব্যাটিং লাইন আপ টেস্টে মঈন আলীকে প্রায় মুরালিধরন বানিয়ে ছেড়েছে। আমি বলছি না, পরিসংখ্যান বলছে।
আর আজহারের হাতে এমন একটা ব্যাটিং লাইন আপ ছিল যার সামনে স্বয়ং শেন ওয়ার্নও পালাবার পথ খুঁজত। শচীন-সৌরভদের কথা ছেড়ে দিন, ১৯৯৮-এর অস্ট্রেলিয়া সিরিজে শচীন মাঠে নামার আগেই ওয়ার্নের এক রাউন্ড আড়ংধোলাই হয়ে যেত সিধু নামক একজনের হাতে যার টেস্টে কেরিয়ারে সাকুল্যে সংগৃহিত রান ৩০০০, ৫০ টেস্ট খেলে অর্থাৎ ইনি কুলীন বংশীয় নন।
শাস্ত্রী মশাই, ঠেলায় পড়ে নিজের ভীষণ অপছন্দের অধিনায়ককে মনে পড়েছে, তাঁর আমদানি করা থিওরি প্রয়োগ করে তীরে উঠতে চাইছেন; খুব ভাল কথা, কিন্তু অনুগ্রহ করে পাশাপাশি স্টিভ ও’কিফ কেও ভুলে যাবেন না।