এমন একটা ম্যাচের পর আসলে কিছু বলার থাকে না। বাকরুদ্ধতার আবেশে ঘিরে ধরে চারিদিক। তারপরও আশার ফুল ফুটিয়েও কেন মুহূর্তের মধ্যে বাংলাদেশ দল ঝরে গেল তা নিয়ে একটা ময়না তদন্ত হতে পারে।
চারদিকে প্রশংসার জোয়ার। ‘ওয়েল প্লেইড বাংলাদেশ’ নামক চিরায়ত লাইন দিয়ে ফেসবুক সয়লাব। অর্থাৎ সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের এমন পারফরম্যান্সের মাঝেই যেন সমস্ত তৃপ্ততা খুঁজে নেওয়া। ভারতের মত দলের বিপক্ষে লড়াই করে ৫ রানে হার, এটাই যেন পরম গর্বের এক বিষয়। কিন্তু দিনশেষে এমন আশা জাগানিয়া ম্যাচে হারের মাঝে কি কোনোই সমালোচনা খুঁজে বের করা সম্ভব না? সম্ভব। প্রবলভাবেই সম্ভব।
প্রথমে বাংলাদেশের ব্যাটিং ইনিংসের সারমর্মে ফেরা যাক। বাংলাদেশ জয়ের দিকে ছুটেছে কিংবা জয়ের প্রত্যাশার পারদ বেড়েছে লিটন দাশের ঝড়ো শুরুতে। তাঁর করা ২১ বলে ফিফটিতেই বাংলাদেশের কাছে তখন ভারতের দেওয়া লক্ষ্য একটা সময় খুব সম্ভবই মনে হচ্ছিল। তবে ৭ ওভার পরেই আসে বৃষ্টির বাঁধা। এতে অবশ্য চনমনেই ছিল বাংলাদেশের ড্রেসিং রুম। কারণ ডি/এল পার স্কোরে তারা তখন ১৭ রানে এগিয়ে। উল্টো এমন পরিস্থিতিতে ভারত শিবিরে ঘোর আঁধারই নেমেছিল তখন।
প্রায় এক ঘন্টা বৃষ্টির পর আবারও খেলা মাঠে গড়ায়। বাংলাদেশের জন্য তখন নতুন সমীকরণ ১৬ ওভারে ১৫১। অর্থাৎ পরবর্তী ৫৪ বলে করতে হবে ৮৫ রান। এরপরের প্রেক্ষাপটটা তো সবারই জানা। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ হেরেছে ৫ রানে। ম্যাচের সালতামামি এতটুকুই।
এবার শুরু করা যাক, দিনশেষে এই ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত। একটি দলে হাতে রয়েছে ১০ উইকেট, ম্যাচ জেতার জন্য শেষ ওভারগুলোতে রানও করতে হবে ১০ এর কম করে। এখন শুধু এই পরিস্থিতি বিবেচনা করেই বলুন, এখানে ম্যাচ জেতার সম্ভাবনাটা কোন দলের বেশি? বাংলাদেশের এমন পরিস্থিতিতে ম্যাচ খেলার স্বল্প অভিজ্ঞতার কথা বলে দায় এড়ানো যেতেই পারে। তবে এমন ম্যাচ আসলে ব্যাটিং দলের জেতাটাই সম্ভাব্য ফলাফল।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই সব সম্ভাব্যতা পুরোপুরিই উল্টে গেল। এখন এই হারের দায়টা কার? সাদা চোখে বাংলাদেশ এই ম্যাচে লড়াই করে হেরেছে। কিন্তু আরেকটু ঘেটে দেখলে দেখা যাবে, লড়াইটা আসলে লিটনই করেছে, টিম বাংলাদেশ না। আরেকটু ভিতরে গেলে, একদম কেঁচো খুড়তে সাপ বেরোনোর মত অবস্থা হবে।
সাকিব বাংলাদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলছেন ১৬ বছর। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও খেলছেন বহু বছর। ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে তিন চারশো টি-টোয়েন্টি খেলা হয়ে গিয়েছে তাঁর। অথচ, এমন টান টান উত্তেজনার ম্যাচে কিংবা টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ক্রাঞ্চ মুহূর্তে প্রায় সময়ই কেন তাঁর ব্যাট হাসে না? বেশ বড়ো সড়ো কোয়েশ্চেন মার্কই দেওয়া হয়ে গেল বুঝি! কিন্তু এমন ম্যাচে সাকিবের দিকে আঙুল তোলার যথেষ্ট কারণও আছে।
সাকিব তিনে/চারেই টি-টোয়েন্টিতে ব্যাট করেন সাধারণত। একজন টপ অর্ডার ব্যাটারকেই তো ব্যাটিং লাইনআপের নিউক্লিয়াস বলা যায়। কিন্তু সেই সাকিবকে কখনোই সময়ের প্রয়োজনে চেজ করা ম্যাচে বিধ্বংসী রূপে দেখা যায় না। দেখা গেলেও সেটা ফলপ্রসু হয় না। আজকের ম্যাচের শুরুটা লিটন করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী পথটাও পাড়ি দেওয়াটা সাকিবের জন্য তেমন কঠিন ছিল না। কিন্তু প্রত্যাশার চাপে আজ তিনিও ভেঙ্গে পড়েছেন। স্লগে উঠিয়ে খেলেছিলেন, কিন্তু সেটা ক্যাচ হয়েই ফিল্ডারের কাছে ধরা দিয়েছে।
খেলার এমন মুহূর্তে সাকিবের উইকেট খোয়ানো বিরক্তিকর। একই সাথে আরেকটি প্রশ্নেরও জন্ম দেয়, বড় শট খেলার ক্ষেত্রেই কি তবে সাকিবের বড্ড সীমাবদ্ধতা কিংবা এমন ম্যাচে ব্যাট করাতেও কি সাকিবের অনভ্যস্ততা? এমন প্রশ্নের উত্তর নেই। তবে পরিসংখ্যান বলছে, টপ অর্ডারে ব্যাট করা স্বত্ত্বেও সাকিব টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তাঁর শেষ ফিফটিটা পেয়েছিলেন সেই ২০১৬ সালে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ৪০ বলে ৫০ রানের সেই ইনিংসের পরে ১৩ টি ম্যাচ খেললেও এখনও কোনো ফিফটির দেখা পাননি তিনি। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, এর মাঝে যে কয়টা ম্যাচ কিছু রান পেয়েছিলেন তাঁর অধিকাংশই বাছাইপর্বে খেলা সহযোগী দেশের বিপক্ষে। চূড়ান্ত পর্বে এসে বেশ কয়েক ম্যাচ খেললেও রান আসেনি সাকিবের ব্যাটে।
বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত যা রিসোর্স তাতে সাকিব টপ অর্ডারেই খেলার সক্ষমতা রাখেন। কিন্তু প্রশ্নটা আসে এখানেই। সাকিব তো নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সেরা পারফর্মার। সেটি নিয়ে তর্কের সুযোগ নেই। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বর্তমান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সাকিব কি এই ফরম্যাটের বিশ্বমানের পারফর্মার? আবারও বলে রাখি, এই প্রশ্নের জায়গাটা শুধু ব্যাটার সাকিবকে নিয়ে।
আফিফের ব্যাপারটায় আসি। আফিফ এর মাঝেই বেশ কিছু প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচ বলতে গেলে নিজ হাতে জিতিয়েছেন। কিন্তু মঞ্চটা যখন বড় আসরের তখন কি আফিফ একটু ব্যাকফুটে চলে যান? এবারের আসরে বলার মত তেমন কিছুই করতে পারেননি।
আগের বিশ্বকাপেও ছিল না ব্যাটে রান। তাহলে আফিফের সক্ষমতা কি শুধু দ্বিপাক্ষিক সিরিজেই আঁটকে আছে? আপাতত পরিসংখ্যান কিন্তু সেটাই বলে। এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ১২ টি ম্যাচ খেলেছেন। অবাক করা ব্যাপার হল, এই ১২ ইনিংসের ৮ টিতেই তিনি সিঙ্গেল ডিজিটে আউট হয়েছেন। সব মিলিয়ে তাঁর গড় ১২ এর কাছাকাছি। শুধু একবার ভাবুন, আফিফ দলে নিয়মিত খেলা একজন ব্যাটার। অথচ, বিশ্বকাপ এলেই যেন তাঁর ব্যাটিং দৈন্যদশা ফুটে ওঠে।
ইয়াসির আলী রাব্বির ক্যারিয়ারটা সবে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের হয়ে মাত্র ১০ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। তাই তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা কঠিন। সামর্থ্য নিয়ে পর্যবেক্ষণ করার সময়টা এখনই নয়। কিন্তু একটি ম্যাচে ৪২ রানের ইনিংস বাদ দিলে তিনিও রয়েছেন ব্যর্থতার বৃত্তে। সেই বৃত্তে বন্দী থাকলে তাঁকে নিয়েও প্রশ্ন তোলাটা কিন্তু খুব একটা অনুচিত হবে না।
ভেজা আউট ফিল্ডে সমস্যাটা বেশি হয় বোলারদেরই। বল গ্রিপিংয়ে সমস্যা হয়। আর এই ফায়দাটা তুলতেই ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশি ব্যাটাররা। ৫৪ বলে ৮৫ রানের সমীকরণে সাকিব, আফিফ, ইয়াসির, মোসাদ্দেকরা ২৬ বলে করেছেন ২৩। অর্থাৎ রিকোয়ার্ড বলের প্রায় অর্ধেক বল খেলে তারা রান করেছেন ১০০ এরও কম স্ট্রাইক রেটে।
মোসাদ্দেক বাদে সবাই হয়েছেন ক্যাচ আউটের শিকার। রাব্বি বাউন্সে হিমশিম খেয়েছেন, সাকিব, আফিফ উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট হয়েছেন। তাই দিন শেষে ম্যাচটার সমাপ্তিও হয়েছে পরাজয় দিয়ে। বাংলাদেশের সমর্থকদেরও তাতে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে।
তবে যেটাই বলুন না কেন, বাংলাদেশ দল হিসেবে এ ম্যাচটা ভাল খেলেনি। লিটনের ছায়ায় অন্যদের শুভঙ্করের ফাকিটা ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। আসলে গোটা বাংলাদেশ দলটাই ত্রুটিতে পূর্ণ। টেস্ট স্ট্যাটাসের ২২ বছর পেরিয়ে যাওয়া একটা দলের এমন হারের পরও তাই সাধুবাদের ব্যাপারটায় একটা সময় ক্লান্তি আসে। অস্ফুট স্বরে মাঝে মধ্যে বেরিয়ে আসে, আর কত! এভাবেই কি তবে চলবে? আমাদের তৃপ্ততার মাত্রা কি এটুকুই?