জেসন গিলেস্পির করা বলটা ব্যাটে ছুঁয়েই প্রান্ত বদল করলেন আফতাব আহমেদ।
সাথে সাথেই ইতিহাস। এক প্রান্ত বদলে ওলোটপালোট হয়ে গেলো ক্রিকেট বিশ্ব। কার্ডিফে ইতিহাস করে ফেললো বাংলাদেশ। দুনিয়ার ইতিহাসের অন্যতম শক্তিধর দল অস্ট্রেলিয়াকে হারালো তখনকার পুঁচকে বাংলাদেশ।
সেদিন কেবল বাংলাদেশের জয় লেখা হয়নি।
কার্ডিফে লেখা হয়েছিলো এক ঐতিহাসিক সেঞ্চুরির গল্প। সেদিন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম আর বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের দ্বিতীয় সেঞ্চুরির মালিক হন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার মোহাম্মদ আশরাফুল। তার সেই স্মৃতিবিজড়িত সেঞ্চুরিতে কার্ডিফে অজি বধের ইতিহাস রচনা করেছিলো হাবিবুল বাশার সুমনের বাংলাদেশ দল।
অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথু হেইডেন, রিকি পন্টিং, গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পিদের সামনে সেদিন ২০ বছরের যুবকটি তার ব্যাটিং দাপট দেখিয়ে অজিদের বিপক্ষে প্রথম ও একমাত্র ওয়ানডে জয় ছিনিয়ে এনেছিলো।
তারিখটা ছিলো ১৮ জুন, ২০০৫।
কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে রৌদ্রজ্জ্বল দিনে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় অজিরা। তখনকার অস্ট্রেলিয়া দল মানেই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দল! তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশ জিতবে তো দূর, কোনো রকম লড়াই করতে পারবে-এমনটাই যেনো ছিলো ক্রিকেটভক্তদের ভাবনা।
সেদিনের সেই ঐতিহাসিক জয়ের শুরুটা ছিলো অজি শিবিরে মাশরাফি বিন মুর্তজার আঘাত দিয়েই! ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলে শূন্য রানেই ফেরান ম্যাশ। এরপর রিকি পন্টিংকে চাপের মুখে রানই বের করতে দেননি মাশরাফি-তাপশ বৈশ্যরা! দলীয় ৯ রানেই ১৬ বলে মাত্র ১ রান করা পন্টিংকে ফেরান তাপশ বৈশ্য।
৯ রানে দুই উইকেট হারিয়ে টাইগারদের সামনে শুরুতেই হোঁচট খায় অজিরা৷ পরের উইকেটে হেইডেন ও ডেমিয়েন মার্টিনের ৪৮ রানের জুটি ম্যাচে প্রতিরোধ গড়লেও দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে হেইডেনকে বোল্ড করেন নাজমুল! ব্যক্তিগত ৩৭ রানে হেইডেন ফিরলে অজিদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩ উইকেটে ৫৭ রান।
ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়া অজিদের হাল ধরেন ডেমিয়েন মার্টিন ও মাইকেল ক্লার্ক। চতুর্থ উইকেটে দুইজনের ১৫৬ বলে ১০৮ রানের জুটি ম্যাচে ফেরায় অজিদের। দু’জনেই তুলে নেন ফিফটি। উইকেট নিতে না পারলেও মাশরাফি-রাজ্জাকদের শক্ত বোলিংয়ে দ্রুত রান তুললে ব্যর্থ হয় অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা।
দলীয় ১৬৫ রানে ব্যক্তিগত ৭৭ রানে ফেরেন ডেমিয়েন মার্টিন। তাপশ বৈশ্যর বোলিং নৈপুণ্যে এরপর দ্রুতই ফেরেন মাইকেল ক্লার্কও! দলীয় ১৮৩ রানে অজিরা যখন পাঁচ উইকেট হারায়, ইনিংসের বাকি মাত্র ৬.৩ ওভার! এরপর মাইক হাসির ৩১ বলে ৩১ আর সাইমন ক্যাটিচের ২৩ বলে ৩৬ রানের ক্যামিওতে শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ২৫০ রান সংগ্রহ করে অজিরা।
বাংলাদেশের পক্ষে ৬৯ রানে তিন উইকেট নেন তাপশ বৈশ্য। এছাড়া ৩৩ রানে এক উইকেট মাশরাফি ও কোনো উইকেট না শিকার করলেও ১০ ওভার মাত্র ৩১ রান দেন মোহাম্মদ রফিক।
২৫১ রানের লক্ষ্যমাত্রা টাইগারদের সামনে তখন পাহাড়সমই! একে তো ইংলিশ কন্ডিশন, তার উপর গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পি, ব্র্যাড হগদের শক্তিশালী বোলিং লাইনআপ। কিন্তু সেদিন যেন কার্ডিফে অন্য কিছু অপেক্ষা করছিলো, লাল-সবুজের জার্সিতে বাংলাদেশের বিজয়গাঁথায় অজি বধের ইতিহাস লেখার অপেক্ষা।
ব্যাটিংয়ে নেমে শুরু থেকেই গ্লেন ম্যাকগ্রা, গিলেস্পি আর ক্যাসপ্রোভিচের গতির সামনে রান নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলেন দুই টাইগার ওপেনার। দলীয় ১৭ রানেই গিলেস্পির বলে ২১ বলে ৮ রানে গিলক্রিস্টকে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন নাফিস ইকবাল। ইনিংসের তখন ৮ম ওভার চলছে! দ্বিতীয় উইকেটে জাভেদ ওমরের সাথে ৩৪ রানের জুটি গড়ার পথে ২৪ রান করে ব্র্যাড হগের বলে কাটা পড়েন তুষার ইমরান। এরপর দলীয় ৭২ রানে ৫১ বলে মাত্র ১৯ রান করে ক্যাস্প্রোউইক্সের বলে আউট হন জাভেদ ওমর।
দলীয় ৭২ রানেই তিন উইকেট হারায় বাংলাদেশ দল। এটা যেন তখনকার জন্য বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তখনো ১৭৫ বলে প্রয়োজন ১৭৯ রান! হাতে সাত উইকেট। এটা তখনো একটা স্বপ্নই ছিলো। যার বাস্তবে রুপ দেন ২০ বছর বয়সী তরুন মোহাম্মদ আশরাফুল।
চতুর্থ উইকেটে হাবিবুল বাশারকে সাথে নিয়ে একপ্রান্তে রান তুলতে থাকেন আশরাফুল। হগ-ম্যাকগ্রাদের উপর চড়াও হয়ে দ্রুত রান তুলতে থাকেন তিনি। আশরাফুলের ব্যাটিং কপালে চিন্তার ভাঁজ কেটেছিলো গিলক্রিস্ট-পন্টিংদের! শুধু যেনো এই উইকেটটা গেলেই ম্যাচে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে অজিরা। কিন্তু তা হতে দেননি আশরাফুল-বাশাররা।
একপ্রান্তে ধৈর্য্যশীল ব্যাটিং করে আশরাফুলকে যোগ্য সমর্থন দেন বাশার। চতুর্থ উইকেটে তাদের দুইজনের ১৩৮ বলে ১৩০ রানের জুটি টাইগারদের ঐতিহাসিক জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে। এর মধ্যে আশরাফুল তুলে নিয়েছেন দাপুটে ফিফটি৷
ম্যাচ জিততে তখন দরকার ৩৮ বলে ৪৯ রান! হাতে তখনো সাত উইকেট। আশরাফুলও ছিলেন সেঞ্চুরির একদম দ্বারপ্রান্তে। দলীয় ২০২ রানে ভুল বুঝাবুঝিতে ব্যক্তিগত ৪৭ রানে রান আউট হন বাশার। আফতাব আহমেদকে সাথে নিয়ে ২৫ রানের জুটির পথে আশরাফুল তুলে নেন দূর্দান্ত এক সেঞ্চুরি।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এবং ওয়ানডেতে ইতিহাসে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন ২০ বছর বয়সী এই তরুন ব্যাটসম্যান। ১০০ বলে ১১ চারে সেঞ্চুরি করেন তিনি। অ্যাডাম গিলক্রিস্টও হাত তালি দিতে কার্পণ্য করেননি। পরের বলেই অবশ্য লং অনের উপর দিয়ে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ব্র্যাড হগের হাতে ধরা পড়েন তিনি। আশরাফুলের উইকেটে যেনো প্রাণ ফিরে পায় অজিরা!
ম্যাচের সমীকরণ তখন ১৭ বলে প্রয়োজন ২৩ রান, হাতে পাঁচ উইকেট। নিজের খেলা প্রথম বলেই বাউন্ডারি মারেন মোহাম্মদ রফিক। গিলেস্পির ওই ওভার থেকে ১০ রান আদায় করেন রফিক-আফতাব। শেষ ১২ বলে দরকার মাত্র ১৪ রান। গ্লেন ম্যাগ্রার করা ৪৯ তম ওভার থেকে আসে মাত্র ৬ রান!
ম্যাচে তখনো বেশ উত্তেজনা! শেষ ওভারে টাইগারদের ইতিহাস গড়তে দরকার মোটে ৭ রান। অবশ্য অপেক্ষার প্রহর বেশিরদূর গড়ায়নি, শেষ ওভারের প্রথম বলেই গিলেস্পিকে ছক্কা হাঁকিয়ে টাইগারদের জয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান আফতাব। রিকি পন্টিং বলের দিকে তাকিয়ে হয়তো ভাবছিলেন কোনো কাল্পনিক কাব্য নয়তো এটা! পরের বলেই সিংগেল নিয়ে জয় উল্লাসে মেতে উঠেন আফতাব-রফিকরা।
ড্রেসিং রুমে বাঁধ-ভাঙ্গা উল্লাসে মেতে উঠেন আশরাফুল-বাশাররা। কার্ডিফে ততক্ষণে রচিত হয়ে গিয়েছে এক ঐতিহাসিক ম্যাচের। শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া বধের গল্প তখন লিখতে ব্যস্ত বহু মিডিয়া! ১৬ বছর পর আজও সেই স্মৃতিবিজরিত ঐতিহাসিক ম্যাচ ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে তাজা। এরপর আর কখনোই ওয়ানডে ফরম্যাটে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু ২০ বছরের সেই তরুণ যুবকের দাপুটে ব্যাটিং হয়তো গিলক্রিস্ট-পন্টিংরা একটা দু:স্বপ্ন ভেবে ভুলে থাকতে চাইবেন।