ম্যাচ একবার বাংলাদেশের দিকে হেলে পড়ে তো পরের বলেই অস্ট্রেলিয়ার দিকে। কখনো আবার দুলতে থাকে পেণ্ডুলামের মতো সমান তালে। বারবার রঙ বদলায়, দৃশ্যপট পরিবর্তন আসে। অবশেষে নানা আঙিনা পেরিয়ে মুস্তাফিজুর রহমানের দারুণ এক ওভারে ম্যাচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় বাংলাদেশ। শেষ ওভারে জয় নিশ্চিত করেন মেহেদী হাসান।
লড়াইয়ের জন্য ১২৮ রানের মাঝারি এক পুঁজি পেয়েছিল বাংলাদেশের বোলাররা। আগের দুই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা বলে দিচ্ছিল এই রানই হয়তো জয়ের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আজ রান তাড়ায় দারুণ শুরু করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা। তবে শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেননি তারা। শেষের দিকে বাংলাদেশের বোলারদের দারুণ বোলিংয়ে ১০ রানের জয় পায় বাংলাদেশ।
আজকের ম্যাচে জয়ের ফলে দুই ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জয় নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যে কোন ফরম্যাটে এটিই বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়। আজকের জয়ে ব্যাট হাতে অবদান রেখেছেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। আর বল হাতে দুর্দান্ত ছিলেন মুস্তাফিজ। উইকেট না পেলেও চার ওভারে মাত্র ৯ রান দিয়েছেন এই পেসার।
রান তাড়া করতে নেমে শুরুটাই ভালো হয়নি অস্ট্রেলিয়ার। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই নাসুম আহমেদের লেগ স্টাম্পে করা শর্ট বলে শর্ট ফাইন লেগে শরিফুল ইসলামের হাতে ক্যাচ দিয়ে ৫ বলে ১ রান করে ফিরে যান অ্যালেক্স ক্যারি। ৮ রানে উদ্বোধনী জুটি ভাঙার পর বাংলাদেশ উইকেট পেতে পারতো আরো একটি।
সাকিব আল হাসানের বল অফ সাইডে খেলতে গিয়ে উইকেটের পিছনে নুরুল হাসান সোহানের হাতে ক্যাচ দেন মিশেল মার্শ। আবেদনে সাড়াও দেন আম্পায়ার। রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান মার্শ। এরপর আর পাওয়ার প্লেতে উইকেট হারায়নি অজিরা। তবে মন্থর ব্যাটিংয়ে ছয় ওভারে মাত্র ২০ রান সংগ্রহ করে সফরকারীরা।
পাওয়ার প্লে শেষেই বেন ম্যাকডারমট ও মার্শের দারুন ব্যাটিংয়ে ম্যাচে ফিরে আসে অস্ট্রেলিয়া। ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে এই জুটি। ৫৫ বলে আসে এই জুটির পঞ্চাশ রান। সব রকম চেষ্টা করেও জুটি ভাঙতে পারছিলেন না বাংলাদেশের বোলরার। মুস্তাফিজুর রহমানকে উড়িয়ে মেরে সীমানায় ক্যাচ দিয়েছিলেন ম্যাকডারমট। সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি শরিফুল।
তবে সুযোগ পেয়েও বেশিদূর যেতে পারেননি এই ওপেনার। পরের ওভারেই সাকিবকে স্লগ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে ৪১ বলে ৩৫ রান করে ফিরে যান ম্যাকডারমট। এরপর নতুন স্পেলে বোলিংয়ে এসে দারুণ এক স্লোয়ারে শরিফুল মোজেস হেনরিকসকে ফিরিয়ে দিলে ম্যাচে ফেরে বাংলাদেশ। ৩ বলে ২ রান আসে হেনরিকসের ব্যাট থেকে।
এরপর আরেক ধাক্কায় পথের কাটা হয়ে থাকা মার্শকে শরিফুল ফিরিয়ে দিলে জমে যায় ম্যাচ। ৪৭ বলে ৫১ রান করেন মার্শ। শেষ দুই ওভারে অজিদের প্রয়োজন ছিল ২৩ রান। অস্ট্রেলিয়া নিতে পারে মাত্র ১৩ রান। বাংলাদেশের বোলারদের ভিতর দুটি উইকেট শিকার করেছেন শরিফুল ইসলাম। এছাড়া সাকিব আল হাসান ও নাসুম আহমেদ একটি করে উইকেট পান।
এর আগে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশের শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি। দলকে আরো একবার ভালো শুরু এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন দুই ওপেনার নাঈম শেখ ও সৌম্য সরকার। জশ হ্যাজেলউডের দুর্দান্ত ডেলিভারি হালকা সুইংয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার মুখে নাঈম চেষ্টা করেন থার্ডম্যানে খেলতে। কিন্তু ব্যাটের কানায় লেগে বল চলে যায় উইকেটরক্ষক ম্যাথু ওয়েডের গ্লাভসে।
২ বলে ১ রান করে নাঈম ফিরে যাওয়ার পরের ওভারের প্রথম বলেই অ্যাডাম জ্যাম্পাকে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডাব্লিউয়ের ফাঁদে পড়েন সৌম্য। রিভিউ নিয়েও আম্পায়ারের সিদ্বান্ত পরিবতর্ন করতে পারেননি তিনি। অস্বস্তি নিয়ে ব্যাট করা সৌম্যর ব্যাট থেকে আসে ১১ বলে মাত্র ২ রান। পাওয়ার প্লেতে আর উইকেট না পড়লেও বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল মাত্র ২৮ রান।
সৌম্যর বিদায়ের পর উইকেটে এসে সাকিব আল হাসানের সাথে জুটি বাঁধেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এই জুটিতেই সচল হচ্ছিল রানের গতি। দারুণ ফ্লিকে চার মেরে মাহমুদউল্লাহ ইনিংস শুরু করার পর টানা দুই চার মারেন সাকিব। প্রথমটি স্কুপে আর দ্বিতীয়টি কাট করে। কিন্তু ভালো শুরু পেয়েও বেশি আক্রমণাত্মক হতে গিয়েই ফিরে যান সাকিব।
জ্যাম্পার হালকা ঝুলে দেওয়া বল হাঁটু গেড়ে উড়িয়ে মেরে লং অফে অ্যাগারের হাতে ধরা পড়ে সাকিব ১৭ বলে ২৬ রান করে বিদায় নিলে গেলে ভাঙে ২৬ বলে ৪৪ রানের জুটি। দলীয় ৪৭ রানে সাকিব ফিরে যাওয়ার পর উইকেটে এসে দারুণ এক ছয়ে ইনিংস শুরু করেন আগের ম্যাচের নায়ক আফিফ হোসেন। তবে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি তিনি।
ড্যানিয়েল ক্রিস্টিয়ানের বল কাভারে ঠেলে দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সিঙ্গেল নিতে গিয়ে রান আউটের ফাঁদে পড়েন এই ব্যাটসম্যান। ১৩ বলে ১৯ রান করে আফিফ বিদায় নেওয়ার পরই থেমে যায় বাংলাদেশের রানের গতি। রানের গতি বাড়াতে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন দিয়ে উইকেটে পাঠানো হয় শামিম হোসেন পাটোয়ারিকে। কিন্তু ব্যর্থ হন এই ব্যাটসম্যান।
হ্যাজেলউডকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে সীমানায় ধরে পড়ে শামিম ফিরে যান ৮ বলে ৩ রান করে। এরপর উইকেটে এসেই ছয় মেরে রানের গতি বাড়ানোর আভাস দেন নুরুল হাসান সোহান। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক রান আউটে থামতে হয় তাকেও। ক্রিস্টিয়ানের বলে ড্রাইভ করে কাভারে পাঠিয়ে রানের জন্য ছোটেন সোহান। সরাসরি থ্রোয়ে স্টাম্প ভেঙে দেন মোজেস হেনরিকস।
৫ বলে ১১ রান করে সোহান ফিরে গেলে ৯৭ রানে ছয় উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকে বাংলাদেশ। এক প্রান্ত আগলিয়ে রাখলেও রান বাড়াতে পারছিলেন না মাহমুদউল্লাহ। ইনিংসের শেষের দিকে হাত খোলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক। সপ্তম উইকেটে মেহেদী হাসানকে নিয়ে ১৮ বলে ৩০ রান যোগ করেন তিনি। ইনিংসের শেষ ওভারে ৫২ বলে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে পঞ্চম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন মাহমুদউল্লাহ।
মাহমুদউল্লাহর হাফ সেঞ্চুরির পরই ইনিংসের শেষ তিন বলে দৃশ্যপটে আসেন অভিষিক্ত অস্ট্রেলিয়ার পেসার নাথান এলিস। টানা তিন বলে মাহমুদউল্লাহ, মুস্তাফিজুর রহমান ও মেহেদী হাসানকে ফিরিয়ে দিয়ে হ্যাটট্রিক করে
অভিষেক স্মরণীয় করে রাখলেন এলিস। ৫৩ বলে চারটি চারের সাহায্যে ৫২ রান আসে মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে।
৬ রান করেন মেহেদী। বাংলাদেশ থামে ২০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ১২৭ রানে। শেষের ঐ হ্যাটট্রিকেই অস্ট্রেলিয়ার সফল বোলার এলিস। চার ওভারে ৩৪ রান দিয়ে তিন উইকেট শিকার করেন তিনি। এছাড়া হ্যাজেলউড ১৬ রান দিয়ে দুটি ও জাম্পা ২৪ রান দিয়ে দুই উইকেট শিকার করেন।
- সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ: ১২৭/৯ (ওভার: ২০; নাঈম- ১, সৌম্য- ২, সাকিব- ২৬, মাহমুদউল্লাহ- ৫২, আফিফ- ১৯, শামিম- ৩, সোহান- ১১, মেহেদী- ৭) (জাস্পা- ৪-০-২৪-২, হ্যাজেলউড- ৪-০-১৬-২, এলিস- ৪-০-৩৪-৩)
অস্ট্রেলিয়া: ১১৭/৪ (ওভার: ২০, ম্যাকডারমট- ৩৫, ক্যারি- ১, মার্শ- ৫১, হেনরিকস- ২, (সাকিব- ৪-০-২২-১, শরিফুল- ৪-০-২৯-২, মুস্তাফিজ- ৪-০-৯-০)
ফলাফল: বাংলাদেশ ১০ রানে জয়ী।
সিরিজ: বাংলাদেশ ৩-০ ব্যবধানে এগিয়ে।