বার্সেলোনার ইতিহাসের অন্যতম সফল সভাপতি হচ্ছেন হুয়ান লাপোর্তা। বার্সেলোনায় তাঁর উথান, অর্জন, ভালো মন্দ ইতিহাস পুরো সময়টা রীতিমত এক মহাকাব্য।
বার্সেলোনার অন্যতম সফল যাত্রা ছিলো লাপোর্তার সময়কালটা। এই সময় বার্সা ৮ টি ঘরোয়া শিরোপা, তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ, হেক্সা জয় করে। সেই বার্সাকে বলা হতো সর্বজয়ী বার্সা। তবে লাপোর্তার দায়িত্ব নেওয়ার সময় বার্সার অবস্থা এমন ছিলো না। অর্থনৈতিক ভাবে ধসে পড়া এক বার্সাকে হাতে নিয়েছিলেন তিনি, তার পর ধীরে ধীরে এই পর্যায়ে নিয়ে আসেন। তার সভাপতির সময়কাল নিয়ে আছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা। অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্যও পাওয়া যায় সেই সময়ের।
২০০৩ সালে লাপোর্তা প্রথমবার সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। লাপোর্তার জয়ে যে দু’টি জিনিস মুল ভুমিকা পালন করেছিলো তা হলো সান্দ্রো রাসেলের সমর্থন এবং সমর্থকদের উদ্দেশ্যে একটি ‘মিথ্যা আশ্বাস’। লাপোর্তা নির্বাচনের পূর্বে সকল কিউলদের কাছে ওয়াদা করেছিলেন তিনি যদি পাশ করেন তবে ডেভিড বেকহ্যামকে বার্সেলোনায় আনবেন।
কিন্তু, লাপোর্তা নির্বাচনে পাশ করার কিছুদিন পর বেকহ্যাম তাঁদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদে যোগদান করেন। এই মিথ্যা আশ্বাস এর জন্য তখন তার উপর সমর্থকরা ব্যাপক ক্ষেপেছিলো।
লাপোর্তা যখন বার্সার দায়িত্ব নেন তখন বার্সার অবস্থা ভঙ্গুর ছিলো। তার প্রথম বছরে সেই অবস্থা আরো খারাপ পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থা পাল্টাতে থাকে, ম্যানেজার হিসেবে রাইকার্ড এবং রোনালদিনহো কে কেনার পর বার্সেলোনার দিন বদলাতে শুরু করে।
কখনো শার্টে স্পন্সর না নেওয়া বার্সা তখন ইউনিসেফ এর সাথে পাঁচ বছরের চুক্তি করে। এরজন্য বার্সেলোনা প্রতিবছর দেড় মিলিয়ন পাউন্ড দিতো ইউনিসেফ কে। এই সিদ্ধান্তের জন্য লাপোর্তা অনেক সমালোচিত হন এবং অনেকে সাধুবাদও জানান।
লাপোর্তার প্রেসিডেন্সির দুই বছরের ভেতর তার প্যানেলের চার জন বোর্ড সদস্য এবং তার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা সান্দ্রো রাসেল পদত্যাগ করেন। তারা বলেন লাপার্তা ক্ষমতা পাওয়ার পর সম্পূর্ন বদলে গেছে, সে বদরাগী, কাউকে সম্মান করেনা এবং সে আরো ক্ষমতা চায়।
তবে লাপোর্তা সবচেয়ে ভালো যে কাজটি করেছেন সেটি হলো তিনি ন্যু ক্যাম্প থেকে ম্যাড বয়েস গ্যাং কে তাড়াতে পেরেছিলেন । নিজের এবং পরিবারের জীবন এর ঝুকি নিয়ে এই গ্যাং এর সাথে লড়াই করেছেন যারা ন্যু ক্যাম্পে বর্ণবাদ-বর্বরতা ছড়াতো। এই গ্যাং লাপোর্তা কে কিডনাপ করার চেষ্টা ও করেছিলো তবে আলটিমেটলি লাপোর্তা এদের চিরতরে তাড়াতে পেরেছিলেন।
লাপোর্তার পিরিয়ডে বার্সা ইকোনোমিকেলি অনেক গ্রো করে। লাপোর্তা নিজে থেকেই সবসময় প্রচার করেন তিনি ঋনখেলাপি থেকে বার্সার অর্থনীতিকে আবারো শীর্ষে নিয়ে আসেন। হ্যাঁ, তিনি বার্সাকে ক্রাইসিস থেকে উদ্ধার করেছিলেন, কিন্তু ‘ইন টার্ম অফ ফিল্ড সাকসেস’, বার্সার লভ্যাংশের পরিমান কি যথেষ্ট ছিল?
লাপোর্তার শেষ বছরে ক্লাবের হিসাবে দেখানো হয় তিনি ৭ বছরের সকল দেনা মিটিয়ে ১১ মিলিয়নের লাভ দিয়ে সেই মৌসুম শেষ করেছেন। এরপর নতুন বোর্ড এসে নতুন অডিট ফার্ম নিয়োগ করে সব হিসাব খতিয়ে দেখতে বলা হয়। হিসাব শেষে দেখা যায় যে ২০১০ সালে ক্লাব ১১ মিলিয়নের লাভ নয় বরং ৭৭ মিলিয়নের লোকসানে মৌসুমে শেষ করে।
এই বেআইনি কাজের জন্য লাপোর্তাকে আদালতে নেওয়া হয়। কিন্তু টেকনিক্যাল ত্রুটি দেখিয়ে লাপোর্তা বের হয়ে আসেন। সকল হিসাব শেষে যে চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হয়ে আসে সেটি হলো বার্সার এরকম গোল্ডেন পিরিয়ডের পর ও ক্লাবের ওপর ৪৪২ মিলিয়নের দেনা। অর্থাৎ লাপোর্তা ক্ষমতা নেওয়ার পর ২০০৩ সালে বার্সা যতটা খারাপ অর্থনৈতিক সংকটে ছিলো এখন তারচেয়ে খারাপ আর্থিক অবস্থায় তিনি বার্সাকে ছেড়ে গিয়েছেন ।
এছাড়া তদন্তে আরো বেরিয়ে আসে ক্লাবের আয়ের খাতায় অনেক অর্থের পুরোটা ক্লাবে আসে নি। অর্থাৎ প্লেয়ার সেলস-সহ ক্লাবের যে আয়ের উৎস ছিলো সেগুলোর পেমেন্ট অ্যাকাউন্টে একরকম দেখানো হত আবার বুকে একরকম দেখানো হতো। এজন্য তার বিরুদ্ধে ক্লাবের টাকা আত্বসাৎ করার অভিযোগ ওঠে।
এবার আসি সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ‘দ্য ফ্রাঙ্কো স্ক্যান্ডাল’ নিয়ে, যা লাপোর্তাকে সমস্ত কাতালানদের কাছে ভিলেন বানিয়ে দিয়েছিলো। লাপোর্তার শালা আলসান্দ্রো ইচেবারিয়া ছিলেন তাঁর বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার এবং সিকিউরিটি ইন চার্জ। তবে এর বাইরে ও তার আরেকটি পরিচয় ছিলো, তা হলো তিনি FNFF (Francisco Franco Foundation) এর মেম্বার।
স্পেনের ডিক্টেটর ফ্লাংকোর ইমেজ ক্লিন করার জন্য একটি ফাউন্ডেশন কাজ করে আর লাপোর্তার শালা বার্সার বোর্ড মেম্বার ইচেবারিয়া সেই দলের সদস্য। এই খবর যখন বের হয় তখন কাতালানরা লাপোর্তা সহ পুরো বোর্ডের পদত্যাগ চায়।
কাতালানিয়ার লোকের ফ্রাঙ্কোকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে অথচ তাঁদের ক্লাবের বোর্ড মেম্বার সেই ফ্রাংকোর ইমেজ ক্লিন করার জন্য কাজ করছে। এটা তারা মেনে নিতে পারে নি। তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো লাপোর্তা তাকে বরখাস্ত করেন নি, সে বোর্ড মেম্বার হিসেবেই থাকে পুরো টার্ম। লাপোর্তা নিজে একসময় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তবে তাকে বরখাস্ত করেন নি।
পেপ গার্দিওলার জীবনী ‘Pep Confidential’, পেপ তার এবং লাপোর্তার জঠিল সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন। লাপোর্তাকে অস্থির, অনিশ্চিত হিসেবে ব্যাখা করেন। পেপ গার্দিওলা বলেন উনার মুড কে নিয়ন্ত্রন করে তার সাথে ডিল করতে হতো । আমরা সবকিছু জেতার পর প্রেসিডেন্ট আমাদের উপর পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলেন না।
লাপোর্তা রাগী মানুষ সেটা উনার কিছু ব্যক্তিগত জীবনের কিছু ঘটনা দেখেও বুঝায়, একবার বিমানবন্দরে তাঁকে মেটাল ডিটেক্টর এ চেক করতে বলা হলে উনি রাগে সবার সামনে নিজের প্যান্ট খুলে ফেলেন৷
ক্লাবের খারাপ অবস্থার জন্য ২০০৮ সালে লাপোর্তার বিরুদ্ধে ‘Vote Of No Confidence’ করা হয়, সেখানে তার বিরুদ্ধে ৬০% ভোট পড়ে। তবে ৬% ভোটের জন্য তিনি সেই যাত্রায় বেচে যান, নিয়ম হলো ইমিডিয়েট ইলেকশনের জন্য প্রেসিডেন্ট এর বিরুদ্ধে ৬৬% ভোট পরতে হবে। নির্বাচন না হলে ও সবাই ধরে নিয়েছিলো লাপোর্তা এবার হয়তো নিজ থেকেই পদত্যাগ করবেন। ১০ ই জুলাই ২০০৮ সালে, লাপোর্তার বোর্ডের ১৭ জন বোর্ড মেম্বার পদত্যাগ করে।
প্রায় ১০ বছর পর আবার বার্সায় ফিরে এসেছেন হুয়ান লাপোর্তা। সেটাও আবার বার্সেলোনার কঠিন এক দুর্দিনে। দেখা যাক এবারের যাত্রাটা কেমন হয় তাঁর!