এক মার্চেন্টের বিজয়

কিংবদন্তি সিবি ফ্রাই একদা তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তাঁর মুখে রঙ মেখে আমাদের সাথে নিয়ে চলো। অ্যাশেজে বরং আমাদের হয়েই ওপেন করুক।’ স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যানের সাথে তার বেজায় মিল। দুজনেই রান করেছেন দেদারসে। স্যার ডনের মত তিনিও ক্রিকেট খেলেছেন দুটি দেশে, নিজ দেশ ভারত এবং বিলেত ইংল্যান্ডে। রঞ্জি ট্রফিতে রান করেছেন প্রায় ৯৮ গড়ে।

তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম সুপারস্টার, তার লেগ গ্লান্স কিংবা কব্জির মোচড়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো পুরো বিশ্ব। এমন আলতো ছোঁয়ায় লেট কাটটা খেলতেন, পাছে বল যেন আঘাত না পায়। ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম পুরোধা পুরুষ এই ক্রিকেটারের নাম বিজয় মার্চেন্ট।

১৯১১ সালে বোম্বের এক সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবারে জন্ম তাঁর। বাবা- মা আদর করে নাম রাখেন বিজয়সিং মাধবজি ঠাকারসে। সেখান থেকে তার নাম বিজয় মার্চেন্ট হবার গল্পটা বেশ মজার। তাকে স্কুলে ভর্তির সময় ইংরেজ প্রিন্সিপাল তাকে স্বভাবতই তাকে জিজ্ঞেস করেন ঠাকারসে মানে কি। ছোট্ট বিজয় তাকে জবাব দেয় তাঁরা মার্চেন্ট অর্থাৎ ব্যবসায়ী। সেই থেকে তার নাম হয়ে যায় বিজয় মার্চেন্ট। পুরো বিশ্ব তাঁকে এই নামেই চেনে।

১৮ বছর বয়সে তিনি পড়বার উদ্দেশ্যে বিলেত পাড়ি জমান। সেখানে সিন্ডেমহ্যাম কলেজে পড়বার সময় তার ক্রিকেটীয় প্রতিভা সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হবার সুযোগ পায়। ১৯৩১ সালে আন্ত:কলেজ প্রতিযোগিতায় তিনি রেকর্ড ৫০৪ রান এবং ২৯ উইকেট শিকার করেন।

বিলেতের মাটিতে দারুণ খেলার সুবাদে ১৯৩৩ সালে ভারত জাতীয় দলে ডাক পান তিনি। আঠারো বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার হলেও ভারতের হয়ে খেলতে পেরেছেন মাত্র দশ টেস্টে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার জীবন কেড়ে নিয়েছিল মহামূল্যবান ছয়টি বছর। কিন্তু ক্রিকেট জীবনে এত বিশাল বিরতি পড়লেও ব্যাটে বিন্দুমাত্র মরচে পড়েনি মার্চেন্টের। ১৯৪৬ সালে ইংল্যান্ডে সফরে ৪১ ইনিংসে সাত সেঞ্চুরিতে দুই হাজারের অধিক রান করেন তিনি।

১৯৩৭ সালে উইজডেনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। এমনকি নিজের শেষ টেস্টেও দিল্লিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৫৪ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে সেঞ্চুরি করেন তিনি। মূলত ভঙ্গুর স্বাস্থ্য এবং কাঁধের ইনজুরিতে ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত হয়নি তাঁর।

ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় জুড়েই সতীর্থ বিজয় হাজারের সাথে রানের রেকর্ড ভাঙা গড়ার একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল মার্চেন্টের। শুরুটা হয় মুসলিমসের বিপক্ষে মার্চেন্টের ২৪৩ রানের রেকর্ড দিয়ে। কিছুদিন বাদেই একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ২৪৮ রান করে সেই রেকর্ড ভাঙেন হাজারে।

জবাব দিতে অপেক্ষা করেননি মার্চেন্টও, খেলেন অপরাজিত ২৫০ রানের ইনিংস। কয়েক মাস পর হাজারে তাকে পেছনে ফেলেন ৩০৯ রান করে। এবারও বেশিদিন রেকর্ডটা তার কাছে থাকতে দেননি মার্চেন্ট, সপ্তাহ ঘুরতেই ৩৫৯ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন তিনি। এবারে আর হাজারে তাকে পেছনে ফেলতে পারেননি।

বিজয় মার্চেন্টের ছোটভাই উদয়ও ক্রিকেট খেলতেন। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দারুণ এক ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি, ৫৫.৭৮ গড়ে প্রায় তিন হাজারের মতো রান করেছেন। কিন্তু যার বড় ভাই স্বয়ং বিজয় মার্চেন্ট, তার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসা কষ্টকর বৈকি। বিজয় মার্চেন্ট যেন ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের রেকর্ডের বরপুত্র। রঞ্জি ট্রফিতে সবচেয়ে বেশি দ্বিশতকের রেকর্ড ছিল তাঁর দখলে।

যদিও ২০১৭ সালে চেতেশ্বর পূজারা এই রেকর্ড ভেঙে দেন। পাঁচ বছরে মাত্র ৬৯ ইনিংসে ১১ বার ডাবল সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। ১৯৪০ সালে মাত্র একমাসের মাঝে টানা ১৭০, ২৪৩, ২২১ এবং ১৫৩ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। এর মাঝে কেবলমাত্র ২২১ রানের ইনিংসে আউট হয়েছিল বাকি তিন ইনিংসেই ছিলেন অপরাজিত। তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি কিনা টানা দুটি দ্বিশতক হাঁকিয়েছেন। এছাড়াও একই ম্যাচে সেঞ্চুরি এবং হ্যাটট্রিকের বিরল রেকর্ডধারী একমাত্র ভারতীয় তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তার গড় ৭১.৬৪, ডন ব্র‍্যাডম্যানের পর দ্বিতীয় সেরা।

ক্রিকেট ছাড়ার পর পারিবারিক ব্যবসা এবং মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন তিনি। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের কল্যাণে কাজ করার জন্য ১৯৭৩ সালে জাতীয় পুরষ্কারও পান তিনি। ১৯৮৭ সালে ৭৮ বছর বয়সে বোম্বেতে পরলোকগমন করেন ভারতের এই স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান।

বিরাট ধন্যাঢ্য পরিবারের ছেলে তিনি। খ্যাতনামা ঠাকারসে গ্রুপের কর্ণধারদের একজন ছিলেন পারিবারিক সূত্রেই। সাদা চোখে পেশাদার জীবনে তাঁর নিজেকে প্রমাণের কিছু ছিল না। তবে, সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেও তিনি বাইশ গজকে বেছে নিয়েছিলেন, ভারতীয় ক্রিকেটকে করে গিয়েছেন আরও সম্পদশালী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link