বেহালা-বান্দ্রা মৈত্রী এক্সপ্রেস

না, এ কোন রাজ-সিমরান বা দেব-প্রিয়ার প্রেমকাহিনী নয়, নয় আনারকলি -সেলিমের কোন প্রেমগাথা। জ্যাক-রোজ, লায়লা-মজনু বা রোমিও-জুলিয়েট তো নয়ই। স্বপ্নালু চোখে পটলচেরার মাদকতা বা গরমে চাদর ঢাকা ভিক্টোরিয়ার রোমান্সও নয়।

কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটে এই জুটির রোমান্টিসিজমে আপামর ক্রিকেটপ্রেমী আজও আচ্ছন্ন,সেই রেশ আজও বহমান।

সাহিত্য সহবাস বলুন বা স্কুলজীবনে অতুল রানাডে, বিবেক পালকার, ফয়জল বা বিনোদ কাম্বলি – এই নামগুলোই ঘুরেফিরে উঠে আসে শচীনের বন্ধুত্বের পরিধির মধ্যে। কিন্তু এই বৃত্ত ছাড়িয়ে  মাঠের অজুহাতে মাঠের বাইরে সেই চৌদ্দবছর বয়সেই সৌরভের সাথে গড়ে উঠেছিল আর এক বন্ধুত্বের জ্যা যা বাইশ গজকে আরও টেনে পরিধি স্পর্শ করে ভারতীয় ক্রিকেটের সবথেকে বড় জ্যা অর্থাৎ ব্যাস হয়ে উঠেছিল!

একজন জন্মেছিল মুখে রূপোর চামচ দিয়ে কিন্তু আর একজন জন্মেছিল সাদামাটা পরিবারের সরল ভূগোল নিয়ে। কিন্তু দু’জনেরই স্বপ্ন বোধহয় এক জায়গাতেই স্থির ছিল। একজনের জীবন সংগ্রাম কঠিন হলেও ক্রিকেটীয় সংগ্রাম বোধহয় আল্টিমেট ট্যালেন্ট ও ঘটনা পরম্পরায় অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। আর অন্যজনের ক্ষেত্রে রূপোর চামচ আর চারচাকা বা সেন্ট জেভিয়ার্স জীবন  সংগ্রামকে সহজ করে তুললেও বারবার ক্রিকেট দেবতা কঠিন পরীক্ষার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

  • প্রথম আলো

দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ চৌদ্দবছর বয়সে। বাসুস্যারের(পরাঞ্জপর) তত্ত্বাবধানে অনুর্দ্ধ ১৫ -এর জাতীয় ক্যাম্পে ইন্দোরে। শচীন ছাড়াও পরিচিতদের মধ্যে বিনোদ কাম্বলি ছিল। মাঠে যতোই শান্ত হোকনা কেন স্কুল এবং ক্যাম্পে শচীন ছিল এক্কেবারে দুরন্ত মানে যাকে বলে পোলা তো নয় সে তো আগুনেরই গোলা রে!

সেই ক্যাম্পের এক রবিবার বিকেলে বাসুস্যার ছুটি দিয়েছিলেন বলে সবার সাথে সৌরভও ভাতঘুম দিতে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিল। বিকেল ৫টায় ঘুম থেকে উঠেই দেখে জলময় ঘর আর সুটকেস ভাসছে সেই জলে। ভাবলো জলের পাইপ ফেটে গেছে কিন্তু বাথরুমে গিয়েই দেখে বাথরুম শুকনো! দরজা খুলতেই দেখে কাম্বলি ও শচীন মজা নিচ্ছে। ‘তোমরা এটা কী করলে?’ ‘তুমি বিকেলে ঘুমাচ্ছো?’ ‘বিকেলে ঘুমানোটা কি দোষের?’ ‘আমরা টেনিস বলে খেলবো বলে ডাকতে এসে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছো।’ ‘তোমরা আমাকে ডাকতে পারতে!’

হ্যাঁ, এরকমই বিচ্ছু ছিল শচীন! কিন্তু হ্যাঁ, সৌরভের কিটস ব্যাগটা অন্য রুমে রেখে দিয়েছিল যাতে ব্যাট,প্যাড,জুতো,গ্লাভস ভিজে না যায়! এটাই কিন্তু বন্ধুত্ব।

সৌরভের কথায়, ‘আমি প্রথম বড়বড় ঝাঁকড়া, কোঁকড়ানো চুলের শচীনকে দেখি যে কিনা বোম্বে থেকে এসেছে। প্র‍্যাক্টিস নেট থেকে তাকে সরানো যেত না, সারাদিন ব্যাট করে যেতে চাইতো। বাসুস্যার জোর করে সরিয়ে নিয়ে যেত। তখনই বুঝেছিলাম এ ছেলে অন্যদের চেয়ে আলাদা!’

অন্যদিকে শচীনের স্মৃতিচারণ, ‘সেই অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেটের দিন থেকে সৌরভকে আমি দেখছি। এবং সব চেয়ে বেশি করে আমাকে মুগ্ধ করেছে সৌরভের ক্রিকেট নিয়ে আবেগ এবং দেশের হয়ে ভাল করার ইচ্ছাশক্তি।’

  • রুমমেট

মেট শুধু না, দু’জনে রুমমেটও ছিল কৈলাস ঘাটানির হয়ে ইংল্যান্ড সফরে। ঘুমন্ত শচীনকে হাঁটতে দেখে দাদা তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরপর দুদিন এরকম দেখে ভয় দেখাচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে শচীন বলেছিল, ‘No, I walk while sleeping.’ ১৯৯১-৯২ এর অস্ট্রেলিয়া সফরেও সৌরভ ও শচীন রুমমেট ছিল।

আর হ্যাঁ, কৈশোরে দু’জনেই ছুটেছিলেন এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে। আগুনে পেসার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। চেন্নাইয়ের মাউন্ট রোডের হোটেলে তাঁরা এক ঘরেও থাকতেন। ভাগ্যিস, তাঁরা ডেনিস লিলি স্কুলের কৃতী ছাত্র হয়ে উঠতে পারেননি!

  • ধারের ব্যাট

সৌরভের ব্যাট নিয়ে সেই খেলোয়াড় জীবনের শুরুতে শচীন অনেকবার খেলেছে। ১৯৯১-৯২ এর অস্ট্রেলিয়া সফরের প্রথম ২ ম্যাচে শচীন যখন রান করতে ব্যর্থ তখন শচীন নতুন ব্যাটের খোঁজ চালালো। মনে ধরলো সৌরভের ভারী ব্যাট। তা নিয়েই রাত দুটোর সময় প্র‍্যাক্টিস করেছিল। তারপর সিডনিতে এল সেই চোখ ধাঁধানো ১৪৮।

সৌরভ নিজে চান্স না পেলেও শচীনকে ব্যাট দিতে কুণ্ঠাহীন ছিল।

  • বাড়িয়ে দাও তোমার হাত

মনে আছে সৌরভের সেই অভিষেক টেস্টের কথা? এর আগে ভারতীয় দলের হয়ে লোটাকম্বল নিয়ে ঘোরাঘুরি করলেও সৌরভের জন্য বরাদ্দ ছিল জলের বোতল আর তোয়ালে! সেই ঐতিহাসিক ১৯৯৬ এর লর্ডস টেস্টের আগে প্র‍্যাক্টিসে সঞ্জয় মাঞ্জরেকার চোট না পেলে বিড়ালের ভাগ্যে শিকেটা ছিঁড়তে বোধহয় অনেক দেরি হয়ে যেত!

সেই টেস্টে কী ঘটেছিল তা, ‘A century is not enough’ বই থেকে দেখে নেওয়া যাক। যেখানে সৌরভ বলেছে, ‘আমার প্রথম টেস্টে চা পানের বিরতির সময়ে ১০০ রানে অপরাজিত ছিলাম। ছ’ঘণ্টার ব্যাটিংয়ের পর চা বিরতির সময়ে দ্রুত ড্রেসিংরুমে ফিরে এসেছিলাম। আমার ব্যাটের হ্যান্ডেলটা একটু আলগা হয়ে গিয়েছিল। প্যাড পরে বসেছিলাম আমি। এক কাপ চা দেওয়া হয়েছিল আমাকে। চা বিরতি ছিল মাত্র ১৫ মিনিটের। সেই কারণে দ্রুত হ্যান্ডেলে টেপ বাঁধছিলাম। আমি ব্যাটের টেপ বাঁধছি দেখেই ছুটে আসে সচিন। আমাকে বলে, তুমি বিশ্রাম নাও, চা খাও। তোমাকে তো ব্যাট করতে নামতে হবে। আমি টেপ বেঁধে দিচ্ছি।’

  • জুটিতে লুটি

এবার আসি জুটির সেই ক্রিকেটীয় মস্তানিতে। ১৭৬ টা আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৪৭.৫৫ গড়ে এই জুটির মোট রান ৮২২৭। ২৬ টা সেঞ্চুরি ও ২৯ টা হাফ সেঞ্চুরির পার্টনারশিপ।  তার মধ্যে ১৩৬ ম্যাচে ওপেন করে ৪৯.৩২ গড়ে রেকর্ড সর্বোচ্চ মোট রান ৬৬০৯। যার মধ্যে ২১ টা শতরান ও ২৩ টা অর্ধশতরান। এই জুটিতে আমরা পেয়েছি ২৫৮ (কেনিয়া), ২৫২ (শ্রীলঙ্কা), ২৪৪ (নামিবিয়া), ১৯৭ (জিম্বাবুয়ে), ১৯৩ (দক্ষিণ আফ্রিকা), ১৭৫ (অস্ট্রেলিয়া) – এর মতো রান। এই জুটি আবার তিনবার অপরাজিতও থেকেছে!

এদের জুটিতে রেকর্ড সর্বোচ্চ  ছয়টা দ্বিশতরানের পার্টনারশিপও আছে(দ্রাবিড়-সৌরভও ৬টা)। শচীন যেখানে রেকর্ড ৫৬ টা ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার পেয়েছে সেখানে সৌরভও ৩১ টি পেয়ে তৃতীয় স্থানে আছে।

আবার অন্যদিকে একজন টেস্টে যেখানে ৪ নং এ নামতো অন্যজন সাধারণত ৫ এ। এখানেও এই জুটির রান বিশ্বে নয় নং আর ভারতে ৩ নং,  দ্রাবিড়-শচীন(৩) এবং গম্ভীর-শেহবাগ (৮) জুটির রানের পরই! ৭১ টা ইনিংসে ৬১.৬৩ গড়ে এই জুটির রান ৪১৭৩।  যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২৮১। ১২ টি শতরান আর ১৬ টি অর্ধ শতরান। অপরাজিত থেকেছে ৩ বার। টেস্টে জুটিতে সর্বোচ্চ রানের প্রথম দশের মধ্যে এই জুটির গড় রান দ্বিতীয়, পন্টিং ও হেডেন জুটির(৬৭.১১) পরই।

  • শুরুর শুরু

সবাই যতই শচীনের ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে ‘ধুরছাই’ করুক না কেন সৌরভ কিন্তু শচীনের প্রতি কৃতজ্ঞ। একদিবসীয় ক্রিকেটের অন্যতম মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত ছিল সৌরভকে ওপেনিংয়ে তুলে আনা। ২৩ শে অক্টোবর ১৯৯৬ জয়পুরে টাইটান কাপের লিগ ম্যাচে।  ওই ম্যাচে জুটিতে ওঠে ১২৬, শচীন করে ৬৪ আর সৌরভ ৫৪।   সেই শুরু তারপর আমরা দেখেছি এই জুটির শুধুই বিজয়পথ!

সৌরভকে ওপেন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০০৩-এর বিশ্বকাপের প্রাক্কালে হর্ষ ভোগলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শচীনের বক্তব্য ছিল, ‘Well, right now I firmly believe in horses for courses – because right now, Virender Sehwag is striking the ball well. But a year back, Sourav was striking the ball well in South Africa. So I would say when we reach close to the World Cup, whoever is in the right form and striking the ball well should take the initiative.’

  • সৌরভের অধিনায়কত্ব লাভ

ভারতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন্সি সৌরভের পাওয়ার পিছনে শচীনের ভূমিকা যে অনস্বীকার্য তা আজও বলে থাকে বেহাল বীরেন রায় রোডের ওই বিখ্যাত বামহাতি! সিঙ্গাপুরে তৎকালীন নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান অজিত ওয়াদেকরকে শচীন বলেছিলেন গাঙ্গুলি কিন্তু ক্যাপ্টেন্সি ম্যাটেরিয়াল। হ্যাঁ, শচীন কিন্তু অনেক ভেবেচিন্তেই সৌরভের নামটা প্রস্তাব করেছিল। তারপরে গল্পটা তো আজ ইতিহাস, সোপান।

আর ওদিকে সৌরভ কিন্তু শচীন,দ্রাবিড়,লক্ষণ,কুম্বলে এবং পরের দিকে বীরুর সাথে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিত। সেজন্যই দলে না ছিল অনিশ্চয়তা, সবটাই ছিল আন্ডারস্ট্যান্ডিংএর উপর। আর হ্যাঁ, এজন্যই বন্ধুত্ব ছিল অটুট।

  • সেনাপতি ও সেরা অস্ত্র

যেকোন ক্যাপ্টেনের কাছে শচীন এক বিশ্বস্ত অস্ত্র। তাই সৌরভ তার কাছ থেকে সেরাটা নিংড়ে নিয়েছে আর শচীনও উজাড় করে দিয়েছে নিজেকে। সে ২০০৩ এর বিশ্বকাপ বলুন বা পাকিস্তান বা অস্ট্রেলিয়া সফর বা ঘরের মাঠে সেই অস্ট্রেলিয়ার সাথে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ বলুন। সব জায়গাতেই শচীন রোল লিড করে গেছে। আবার, দুর্যোগের সময় বল হাতেও শচীন সৌরভকে হতাশ করেনি। ইডেন টেস্টের ওই জমে যাওয়া জুটি ভাঙা বা অন্য অনেক সময়ই জুটি ভাঙতে সৌরভ ভরসা রেখেছিল ছোটবাবুর উপর।

অন্যদিকে ক্যাপ্টেন শচীনও দাদিকে অলরাউন্ডার বানানোর নেশায় ছিল মশগুল। ক্যাপ্টেন আজহার যখন মার খাওয়া সত্ত্বেও মেইন বোলারদের হাতেই বল তুলে দিয়েছে সেখানে শচীনের আমলেই সৌরভ অনেক ম্যাচেই ফুলকোটার বল করে গেছে।

  • ২০০৩ এবং…

টাইটান কাপে জয়পুরে ক্যাপ্টেন শচীন সৌরভকে ওপেনিংয়ে নিয়ে এলেও পরে শারজায় আকাই সিঙ্গার ট্রফিতে দলের স্বার্থে নিজেই চার নম্বরে ব্যাট করতে নামে। ২০০৩ বিশ্বকাপের আগে শচীনকে চার নম্বরে পাঠিয়ে অধিনায়ক সৌরভ নিজে শেহবাগের সাথে ওপেন করলেও দলের স্বার্থে এবং জন রাইটের পরামর্শে শচীনকে ওপেনিং স্লট ছেড়ে দেয়।  এরপরেরটা তো ইতিহাস।

‘দাদি’র ছোটবাবু এক মহাকাব্যিক যাত্রার সাক্ষী করে আপামর ভারতীয়কে। শচীনের ৬৭৩ রানের পাশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সৌরভের ৪৬৫ সেই জুটিরই নিশ্চিতভাবে এক ‘orbital matching’।

  • চ্যাপেল পর্ব

প্রায় একক জেদে সৌরভ চ্যাপেলকে ভারতীয় কোচ হিসেবে নিয়ে এলেও খাল কেটে কুমীর আনার মতোই চ্যাপেল সৌরভ তথা ভারতকে গিলে খেয়েছিল। ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ -এই আত্মজীবনীতে শচীন জানিয়েছে যে, ২০০৭ সালে বিশ্বকাপের আগে রাহুল দ্রাবিড়কে সরিয়ে তাঁকে অধিনায়ক হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন ক্রিকেট কোচ গ্রেগ চ্যাপেল। শচীনের বাড়িতে এসে চ্যাপেল জানিয়েছিলেন, ‘একসঙ্গে আমরা দীর্ঘদিন ভারতীয় ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।’

এমনকি সৌরভের প্রতি চ্যাপেলের আচরণকেও সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন তিনি। শচীন লিখেছে, ‘সৌরভের জন্যই চাকরি পাওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করলেও, পরবর্তীকালে তার প্রতি চ্যাপেলের আচরণ অত্যন্ত খারাপ ছিল।’

চ্যাপেল এসব উড়িয়ে দিলেও সৌরভ বলেছে, শচীনের চ্যাপেল বিরোধী সবকটি অভিযোগ সত্য বলে দাবি করেছে সৌরভ।

বন্ধু সৌরভ সম্পর্কে আত্মজীবনীতে লিটল মাস্টার বলেছেন, ‘সত্যি কথা বলতে ভারতের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার সৌরভ। ভারতীয় দলে থাকার জন্য চ্যাপেলের কোনও অনুগ্রহের প্রয়োজন ছিল না সৌরভের।’

সৌরভ যখন বারবার চ্যাপেলের স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনেছিলেন তখন কেন চুপ ছিলেন বন্ধু শচীন? চুপ ছাড়া উপায়ও ছিলনা শচীনের। তখন ভারতীয় ক্রিকেটে চ্যাপেল রাজে দলের ক্রিকেটারদের প্রতি কোচের যাবতীয় বিশ্বাস, সম্মান ধুলিসাৎ। ওদিকে চ্যাপেলের প্রস্তাবে রাজি না হয়ে কোচের নেক নজরে শচীন আর অন্যদিকে সৌরভের পর পথের সবথেকে বড় কাঁটা শচীন। তাই বয়স, ফিটনেস নিয়ে টিম মিটিং, প্র‍্যাক্টিসে কথা শোনানো ছাড়াও শচীন ছিল চ্যাপেলের হিটলিস্টে। ওদিকে ব্যাটিং অর্ডারে নামিয়ে দিয়েছে! সত্যি বলতে শচীনের পায়ের তলার মাটি সেই সময় অনেকটাই আলগা হয়ে গিয়েছিল।

এ নিয়ে শচীনের প্রতি সৌরভের কিন্তু কোন অভিযোগ বা অভিমান নেই!

  • ১৯৪ এবং…

মুলতানের ওই টেস্টে সৌরভ খেলতে না পারার জন্য দ্রাবিড় ক্যাপ্টেন্সি করে। আসলে ওইসময় ডিক্লেয়ারড করার পেছনে কার হাত ছিল? সে কি এই সিদ্ধান্তের পেছনে ছিল? শোনা যায় সে রাহুলকে টোকা মেরে ড্রেসিংরুমের ভেতর উঠে যেতেই ব্যাটসম্যানদের ডেকে নেওয়া হয়!

ওদিকে সৌরভ বলে, ‘ডাহা মিথ্যা কথা!” আবার বার্তা পাঠানোর কথা উঠলে সৌরভ বলে, ‘দুবার রমেশ পাওয়ারকে পাঠিয়েছিল রাহুল!’ রমেশ পাওয়ারকে পাঠালেও আদৌ বলতে বলেছিল কিনা তা জানা ছিল না সৌরভের। যাই হোক সৌরভের সুখের ঘরে হঠাৎ অশান্তির ছায়া দেখা দিলেও  বন্ধুত্বে কিন্তু কোন চিড় ধরেনি!

  • শচীন-সৌরভ ও বাংলা

ভারতীয় ড্রেসিংরুমে হিন্দি ও ইংরেজির বেশি ব্যবহার হলেও, ‘জানেন দাদা আমার ছেলে….’- এর মুখে জুতো মেরে এক মারাঠি সৌরভের কাছে বাংলা শিখে বাংলায় কথা বলার চেষ্টা করতো। বেশ কয়েকটা বাংলা শব্দ শিখে সেগুলোই ঘুরেফিরে ব্যবহার করতো,এমনকি বাইশ গজেও। তাতে নাকি দু’জনেরই চাপ কেটে যেত।

নাগপুরে সৌরভের বিদায়ী টেস্টের সময় একটা গেঞ্জিতে শচীন লিখে দিয়েছিল, ‘এই দাদি, কোথায় যাচ্ছিস?’ পরে শচীন সৌরভকে বারবার বলেছে ও যদি আগে সৌরভের সিদ্ধান্ত ঘুণাক্ষরে টের পেত তাহলে তা করতে দিত না!

  • বীরেন রায় রোডে শচীন

সাংবাদিক দেবাশীষ দত্তের সাথে শচীন একবার সৌরভের বাড়ি গিয়েছিল,সঙ্গে ছিলেন সন্দীপ পাতিল। কোথা থেকে চাউর হতেই মিডিয়া পুরো বাড়ির দখল নিয়েছিল, ফটো তুলতে সৌরভের বাড়ির দোতলার ফ্যাক্স মেশিনের উপর নাকি উঠে পড়েছিল এক সাংবাদিক। ফেরার সময়ও বেহালার  জ্যামে আটকে শচীন বেহাল হয়ে পড়েছিল আর বারবার ফোন করেছিল সৌরভকে এই বলে যে যদি ফ্লাইট মিস হয় তবে সৌরভ পরের ফ্লাইটের টিকিট জোগাড় করে দিতে পারবে কিনা! যাইহোক শচীন সঠিক সময়েই ফ্লাইটটা ধরতে পেরেছিল!

  • বোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর

ইগো নেই, নেই কোন হিংসে আছে শুধু নিখাদ বন্ধুত্ব। তাইতো একজনের সাফল্যে অন্যজন আনন্দিত হয় আর হয় গর্বিত। আজও দু’জনেই দুজনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ভোলে না! সৌরভের বোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই শচীন পাঠিয়ে দেয় সেই বার্তা, ‘Congrats on being elected the @BCCI President, Dadi. I am sure you will continue to serve Indian Cricket like you always have! Best wishes to the new team that will take charge.’

পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সৌরভকে চিনি। ক্রিকেটার এবং অধিনায়ক হিসেবে সবসময় ভারতীয় ক্রিকেটের মঙ্গল ওর কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছে। আমি জানি, বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবেও ওর লক্ষ্য থাকবে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য সেরাটা উজাড় করে দেওয়া।’

পদে না থেকেও দাদির সাথে ভারতীয় ক্রিকেটের উন্নতিতে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশও করেন।

  • মিথস্ক্রিয়া

দুজনের প্রতি দুজনের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আজকের প্রজন্মের কাছে উদাহরণস্বরূপ।  পরস্পর পরস্পরকে যেমন যেমন সম্মান করে ঠিক তেমনি একজন অন্যজনের কথা বলার সময় চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

শচীন সম্বন্ধে সৌরভ

‘These were the moments of my career I always cherish. My batting wth Sachin in one-day internationals at the top was a huge learning experience.’

   সৌরভ সম্বন্ধে শচীন

 ‘We had terrific partnerships. there were tough moments too in the middle, when we discussed how and what to do to get out of the tight situations.’

  • শেষ কথা

অনেক জুটি আসবে যাবে, শচীন-সৌরভ জুটির রেকর্ডও হয়তো ভেঙে যাবে কিন্তু থেকে যাবে এই জুটির রূপকথা। চুপকথার এই আবেগগুলো কিন্তু একান্তই ভালোবাসার। যা হৃদয় স্পর্শ করে, সেখান থেকে ধমনী,শিরা, উপশিরা হয়ে পৌঁছে যায় ক্রিকেটীয় আবেগের কোষে কোষে আর সঞ্চারিত হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মে। এ জুটির মাদকতাই এমন। মাইক ডেনিস থেকে শুরু করে চ্যাপেল হয়ে শাস্ত্রী হটাও বা কুম্বলে ইস্যুতে এ জুটি আজও এককাট্টা। আসলে ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়িয়ে এ জুটি ভারতীয় ক্রিকেটের হৃদয়ের স্পন্দন।

বিভিন্ন বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট খেলেই কিন্তু এই জুটিটা তৈরি হয়েছিল। তাই দুজনের বোঝাপড়া ছিল দুর্দান্ত। রানিং বিটুইন দ্য উইকেট সৌরভের স্লো হলেও শচীন-সৌরভ জুটিতে সৌরভ মাত্র ৯ বার রান আউট হয়েছে। সবুজ গালিচার বুক চিরে কভার ড্রাইভের সাথে ছুটে চলে মাখনে ছুরির স্ট্রেট ড্রাইভ আর ক্রিম মাখিয়ে দেয় ফ্লিক গুলো। বাপি বাড়ি যার-ঔদ্ধত্য গুছিয়ে ঝুলিয়ে রাখে হুকগুলো।

আর হ্যাঁ, ছোটবাবুর বইপ্রকাশের অনুষ্ঠানে দাদির যেমন ডাক আসে তেমনি দাদির দাদাগিরিতে ছোটবাবু অবলীলায় হাজির হয়ে যায়! সেসময় ক্রিজে সৌরভ-শচীন জুটি মানে ভারতের আশা আকাঙ্ক্ষাকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ করা, জুটি ভাঙা মানে কয়েক কোটি ঝাপসা চোখের শূন্যদৃষ্টি! যতদিন ক্রিকেট থাকবে, যতদিন ভারত ক্রিকেট খেলবে ততদিন এই শচীন-সৌরভের ওপেনিং জুটির মতোই তাদের বন্ধুত্ব উদাহরণ হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link