মাঝারি গড়নের, ঠান্ডা মেজাজের মানুষটিকে দেখে মোটেও বোকা বনে যাবেন না। আপনি তাঁর সরলতাকে অস্পষ্টভাবে বিবেচনা করতে পারেন। কিন্তু তাঁর অদম্য আত্মবিশ্বাসটা বছরের পর পর সাফল্যের উপরই নির্মিত। সে বিশ্বের অন্যতম সেরাদের একজন, হয়ত সেরাদের সেরা। আপনি ভাবতে পারেন আপনি ক্লার্ক কেন্টের (জনপ্রিয় ‘সুপারম্যান’ চরিত্রে অভিনয় করা নায়ক) দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু না, আপনি আসলে একজন সুপারম্যানের দিকে তাকিয়ে আছেন; যাকে আমরা সবাই গ্যারি কার্স্টেন নামে চিনি।
পিটারের সৎ ভাই হিসেবেই তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। তাঁর বড় ভাই পিটার কার্স্টেনের মত দুর্দান্ত কোনো ব্যাটিং প্রতিভা ছিল না। কিন্তু তাঁর মধ্যে ছিল দুর্দান্ত কিছু কৌশল এবং সেটা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করার বুদ্ধি। এবং তিনি কিভাবে নিজের সেরাটা বের করে আনবেন সেই চেষ্টাতেই ছিলেন সবসময়; যাতে তিনি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকতে পারেন।
দক্ষিণ আফ্রিকানদের মধ্যে জ্যাক ক্যালিস, হাশিম আমলা, গ্রায়েম স্মিথ ও এবি ডি ভিলিয়ার্সই কার্স্টেনের চেয়ে টেস্টে বেশি রান করেছেন। যদিও এদের প্রত্যেকেই কার্স্টেনের চেয়ে বেশি ইনিংস খেলেছেন। ওয়ানডেতে কার্স্টেনের চেয়ে বেশি রান করার এই তালিকায় শুধু যুক্ত হবেন সাবেক প্রোটিয়া তারকা হার্শেল গিবস।
২০০৪ সালে ১০১ টেস্ট ও ১৮৫ ওয়ানডে খেলে ক্রিকেটকে বিদায় জানান গ্যারি কার্স্টেন। অপরদিকে, সরকারের বর্ণবাদ নীতির কারণে আইসিসির কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় ডজন খানেক টেস্ট আর মাত্র ৪০ টি ওয়ানডে খেলেছেন পিটার কার্স্টেন।
দুই ভাই কোচিংকেই পরবর্তীতে পেশা হিসেবে বেছে নেন। পিটার এক স্কুলে কাজ করত; প্রাদেশিক স্তরে তিনি কাজ করতেন। ২০০৭ সালে গ্যারি কার্স্টেন ছোট্ট অভিজ্ঞতার বৃত্তান্ত ও নিজের অ্যাকাডেমিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা বলে ভারতের কোচ বনে যান। সৌরভ গাঙ্গুলি, শচীন টেন্ডুলকার, মহেন্দ্র সিং ধোনি, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ, বীরেন্দ্র শেবাগ ও যুবরাজ সিং’দের মত বড় বড় তারকারা যেই ড্রেসিং রুমে – সেখানে ৪০ বছর বয়সী এই কোচকে কতটা গুরুত্ব সহকারে নেওয়া হতে পারে?
কিন্তু কার্স্টেনকে বেশ গুরুত্বের সাথেই নেওয়া হয়েছিল ২০১১ সালের দুই এপ্রিল রাতে। সেদিন শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ওয়াংখেড়েতে বিশ্বকাপ জয় করে ভারত। সেদিন ক্রিকেটের অন্যতম বড় তারকাদের কাঁধে চড়ে জয়ের সফলতা উদযাপন করেছিলেন কার্স্টেন। একটা কোচ দলের জন্য কতটা গুরুত্ব বহন করে সেটা স্রেফ ভালবাসা নামক এক তত্ত্ব দিয়ে বোঝা যাবে না। কিন্তু কার্স্টেনকে ভারতীয় খেলোয়াড়েরা ভাল না বেসে পারলেন না।
সেই উদযাপন বজায় থাকল পরের বছরেও। ২০১২ সালে ২০ আগস্ট কার্স্টেনের অধীনেই ইংল্যান্ডকে হারিয়ে টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা (তখন দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ ছিলেন কার্স্টেন)। গেল রবিবার (৩০ মে) আহমেদাবাদে তার অধীনেই আইপিএলের শিরোপা জয় করে গুজরাট টাইটান্স। নিজের জীবন বৃত্তান্তের অভিজ্ঞতার ছকে আরেকটি সাফল্য যোগ করেন এই দক্ষিণ আফ্রিকান তারকা। এই ট্রফি জয়ের পর কি এখন তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল কোচ?
সব প্রশ্নের উত্তর কি নির্দিষ্ট করে বলা যায়? – কার্স্টেন ছিলেন গুজরাটের ব্যাটিং কোচ ও পরামর্শক; তিনি কিন্তু প্রধান কোচ ছিলেন না। কোচ হিসেবে চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে স্টিফেন ফ্লেমিং চারটি আইপিএল শিরোপা জয় করেন। এক আইপিএল শিরোপা যেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোচ হিসেবে অর্জনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব বহন করে।
জনপ্রিয় ক্রীড়াভিত্তিক ওয়েবসাইট ক্রিকবাজের সাথে সাক্ষাৎকারে কার্স্টেনকে প্রশ্ন করা হয়, ‘শীর্ষ পদ থেকে একধাপ পিছিয়ে এসে কাজ করতে কেমন লাগছে? জবাবে কার্স্টেন বলেন, প্রধান কোচের বাইরে কাজ করে এটা আমার জন্য দারুন এক অভিজ্ঞতা। আমি সত্যি এটা উপভোগ করেছি। আমি বিশ্বাস করি আইপিএলে সাফল্যের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্বের প্রয়োজন। এটা একটা ভারতীয় টুর্নামেন্ট – যেখানে ৮৫ শতাংশ ক্রিকেটারের প্রধান ভাষা হিন্দি। যখন আপনি ১০ সপ্তাহের একটা ক্যাম্পেইনে থাকেন – ভারতীয় একটা নেতৃত্ব সব কিছু সহজে সামাল দিতে পারবে।’
এখন পর্যন্ত কোনো ভারতীয় কোচই আইপিএলে শিরোপা জিততে পারেনি, আশিষ নেহরা ছাড়া। ২০১৮ সালে কার্স্টেন ও নেহরা ছিলেন রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর ব্যাটিং ও বোলিং কোচ। নেহরার সাথে কার্স্টেনের সম্পর্কটা বেশ পুরনো। কার্স্টেনের অধীনে ভারতের হয়ে ৭৫ ম্যাচে খেলেন নেহরা।
তিনি বলেন, ‘আশিষ আমার বেশ কাছের বন্ধু। আমরা একসাথে লম্বা সফর করেছি। সে হৃদয় দিয়ে কোচিং করে। সে সবসময় খেলোয়াড়দের কথা চিন্তা করে। কিভাবে তাদের সাহায্য করে সেটা ভাবে। সে কখনোই লাইমলাইটের কথা ভাবে না। কৌশলগত দিক থেকে সে আইপিএলের অন্যতম সেরা একজন কোচ। কিভাবে খেলোয়াড়দের থেকে সেরাটা বের করে আনবে তা নিয়েই ভাবেন নেহেরা। আইপিএলে একটা পরিকল্পনা দিয়ে চলে না, প্রতিটা মূহুর্ত, প্রতিটা ম্যাচের জন্য আলাদা পরিকল্পনার প্রয়োজন। আমি মনে করি আমরা একজন আরেকজনকে বেশ ভাল বুঝি। আমরা একজন আরেকজনের কাজ বিশ্বাস করি। আমি শুধু তাঁর কাছে সমর্থন দিয়ে গেছি।’
কার্স্টেন বেশ ভাল করেই জানেন দলের মধ্যে একতা আর বন্ধন না থাকলে স্রেফ পরিকল্পনা দিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া যাবে না। তিনি বলেছেন, ‘ছেলেরা একসাথে নিজেদের সেরাটা দিয়েছে। তাঁ রা সবাই দলের জয়ের জন্য এক হয়ে খেলেছে। আমরা টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই এটা ঠিক করতে চেয়েছিলাম। বেশ কয়েকজন বড় বড় তারকা ভাল খেলেছে। যার ফলে আমাদের জন্য সবকিছু সহজ হয়ে যায়।’
জয়ের ছকটা টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই দেখা গিয়েছিল গুজরাটের। ডেভিড মিলার, অভিনব মনোহর, রাহুল তেওয়াতিয়াদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে লখনৌ সুপার জায়েন্টসের বিপক্ষে জয় তুলে নেয় তাঁরা। মাত্র তৃতীয় বলেই আউট হয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করা শুভমান গিল পরের দুই ম্যাচে খেলেন ৪৬ বলে ৮৪ ও ৫৯ বলে ৯৬ রানের ইনিংস; টুর্নামেন্টের পঞ্চম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হন।
ইনজুরি, অফ ফর্ম সাথে প্রথমবার অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখান হার্দিক পান্ডিয়া। কার্স্টেন বলেন, ‘ হার্দিক অধিনায়ক হিসেবে দুর্দান্ত ভূমিকা পালন করেছে। আগের আইপিএলের চেয়ে এবার ভিন্ন ভূমিকা ছিল; সেটিতে বেশ দারুনভাবে সফল হয়েছে সে। মিডল অর্ডারে পরিস্থিতি বুঝে ব্যাট করেছে। ‘
ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনদিনের এক প্রস্তুতি ম্যাচে একবার অধিনায়কত্ব করেছিলেন হার্দিক। এরপর আর কখনোই অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেননি। এবারের আসরে প্রথমবার দায়িত্ব পেয়ে ১৯ ম্যাচের মাঝে তার অধীনে ১৬ট’তেই জয় পেয়েছে গুজরাট। হার্দিকের অধিনায়কত্ব নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকান এই কোচ বলেছেন, ‘তাঁর অধিনায়কত্ব সত্যি দেখার মত। অধিনায়ক হিসেবে সে ভাল প্রোফাইলধারী কেউ ছিল না। সবসময়ই সে মুখিয়ে থাকবে কিভাবে উন্নতি করতে পারে। শান্তই থাকে মাঠে এবং মাঠের বাইরেও বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল বের করতে ব্যস্ত থাকে।’
পুরো আসর জুড়ে দুর্দান্ত ছিলেন ডেভিড মিলার। সব আসর ছাপিয়ে এবার তিনি আইপিএল ক্যারিয়ারের সেরা পারফরম করেছেন। এর আগের দুই আসরে একাদশে সুযোগ পেতেও কাঠ-খড় পুড়িয়েছেন। মিলারের ব্যাপারে কার্স্টেন বলেন,‘আমরা সবসময়ই জানতাম যে মিলারকে ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে সেরাটা পাওয়া যাবে। আমরা তাঁকে পুরো টুর্নামেন্টে বেশ ভাল ভাবে ব্যবহার করতে পেরেছি।’
এবারে আসরে গুজরাটের দলীয় সর্বোচ্চ রান সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে ৫ উইকেটে ১৯৯। বিপরীতে, প্রতিপক্ষ সর্বোচ্চ রান আদায় করেছে ৬ উইকেটে ১৯৫। গুজরাটের চেয়ে বেশি কেউই ১৮০ রানের বেশি লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে পারেনি। কলকাতা নাইট রাইডার্স তিনবার ১৮০ রানের বেশি দিলেও একবারও ম্যাচে জিততে পারেনি।
কার্স্টেন বলেন, ‘আমরা যেমন ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি সেটা খুব দ্রুত আমরা পেরেছি; যেটা অন্য দলগুলোর চেয়ে আলাদা ছিল। আমরা এটার সাথে পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে বজায় ছিলাম। আমরা শিরোপা জয়ের কথা কখনো চিন্তা করিনি। আমরা ম্যাচ বাই ম্যাচ চিন্তা করেছি এবং সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা আমাদের সেরা খেলাটার সাথে ধারাবাহিক ছিলাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বুঝতে পেরেছিলাম আমরা এমন এক দল যারা সবচেয়ে কম ছয় মারব, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চার মারবো। আমরা জানতাম আমরা সবচেয়ে কম ডট বল খেলব। বোলিং বিভাগের দিক থেকে আমরা জানতাম যে আমরা পাওয়াপ্লে ও ডেথ ওভারে সেরা। এবং এসব কিছুই হয়েছে।’
মালিকপক্ষের কাছ থেকেও পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছিল কার্স্টেন-নেহেরারা। সিদ্ধান্ত নিতেও মোটেও বিচলিত হতে হয়নি কাউকে। মালিকপক্ষ ও ম্যানেজমেন্টের বাকি সদস্যদের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পেয়ে বেশ খুশি এই কোচ। কার্স্টেন বলেন, ‘কোচ হিসেবে আমরা সবসময়ই আমাদের সেরাটা দিতে চাই। এবং খেলোয়াড়দের ক্ষমতার জায়গাটা আরও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করি। মালিকপক্ষ আমাদের উপর বিশ্বাস দেখিয়েছে। এখানে যারাই বিনিয়োগ করেছে সবাই চেয়েছে দল ভাল খেলুক। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবকিছুই বেশ গুছিয়ে হয়েছে, কোনো রকম দ্বন্দ্ব ছিল না। খেলোয়াড়েরা এই নেতৃত্ব বেশ ভালভাবেই গ্রহণ করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটা প্রতিযোগি দল বাড়তি সুবিধা আদায় করতে চায়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এখন বেশ জটিল ও কৌশলের খেলা হয়ে গেছে। এটা সিদ্ধান্ত নিতে বেশ দারুণ একটা ব্যাপার। একটা খারাপ সিদ্ধান্ত বড় ব্যবধান গড়ে দিতে পারে। এটা সত্যি মজার – এমন একটা পরিবেশে কোচিং করানোর যেখানে প্রত্যেকে প্রতিটা বলের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখে।’
খেলোয়াড়ী জীবনে শীর্ষে পৌঁছাতে প্রতিভা ছাড়াও কার্স্টেনকে বিভিন্ন কৌশল আর গুনের উপর নির্ভর হতে হয়েছিল। কোচ কার্স্টেন সবসময়ই নতুন ভাবে সাফল্যের সন্ধান করেন। কিভাবে ব্যাট ধরতে হবে সেটা তিনি শেখাতে আসেননি। তিনি এখানে এসেছেন কিভাবে একটা আইডিয়া ধরে রাখা যায়, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যায়। আর স্বপ্ন কখনো স্থির থাকে না।
পরবর্তীতে কখনো যখন কেন্ট ক্লার্ককে অদৃশ্যভাবে কোনো কিছু করতে দেখবেন, তখন মোটেও বোকা বনে যাবে না। জেনে রাখবেন সুপারম্যান এক নয় একাধিক উপায়ে ম্যুভ করতে পারেন।