তিনি জর্জ বেস্টের মতো খামখেয়ালি, মোৎজার্টের মতো শিল্পী, এডলফ হিটলারের মতো ইহুদিবিদ্বেষী-নারীবিদ্বেষী এবং মোহাম্মদ আলীর মতো চ্যাম্পিয়ন।
তিনি রবার্ট জেমস ফিশার বা ববি ফিশার, দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! নিয়মতান্ত্রিক এই দুনিয়ার প্রতি অনিয়মের এক প্রবল পরিহাস।
গতানুগতিক এই জীবনটার প্রতি ফিশারকে দিয়ে প্রকৃতির যে দ্বন্দ্ব তৈরির প্রচেষ্টা, তার শুরু হয়েছিল ফিশারের জন্মের মধ্য দিয়েই। ফিশার জানতেন তাঁর বাবা একজন খ্রিষ্টান। অথচ কৈশোর পার হতে না হতেই গবেষকদের কাছ থেকে জানতে হলো, জনাব হ্যান্স জেরার্ড ফিশার তাঁর বাবা নন। ববি ফিশারের বাবা তাঁর ইহুদি মা রেজিনা ওয়েন্ডারের মতোই একজন ইহুদি। হাঙ্গেরিয়ান পদার্থবিদ পল নেমেনি! এই পরিচয়ের সংকটই কি এক চরম বিচ্ছিন্ন আর খেয়ালি ফিশারের জন্ম দিল?
পরবর্তীকালে আত্মীয় বন্ধু থেকে শুরু করে প্রতিটি মানুষের প্রতি প্রবল বিদ্বেষ, মা থেকে শুরু করে যেকোনো নারীর প্রতি তীব্র ঘৃণা, ইহুদিদের শেষ করে দেওয়ার সংকল্প দেখে আপনি এমন অনুমান করে নিলে অন্যায় হবে না।
ববি ফিশারকে নিয়ে লিখতে বসার সবচেয়ে বড় সংকট; কোনটা বাদ দেবেন?
শুধু ফিশারের সাফল্য আর সৃষ্টির কথা বলতে গেলেই শেষ হয়ে যাবে এ লেখা। সেই ১৯৫৬ সালে ১২ বছর বয়সে জুনিয়র শিরোপা বা ১৪ বছর বয়সের মার্কিন চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড; যা এখনো টিকে আছে মাথা উঁচু করে। ১৯৫৮ সালে বিশ্বকাপ বাছাই খেললেন। ২০০৫ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পুরোনো ফরম্যাট ভেঙে ফেলা পর্যন্ত সবচেয়ে কম বয়সে বাছাইপর্ব খেলার রেকর্ড ওটাই। মাত্র ২৯ বছর বয়সে বিশ্বসেরা। বরিস স্পাসকিকে হারালেন আইসল্যান্ডে। জীবনে আটবার অংশ নিয়েছেন মার্কিন চ্যাম্পিয়নশিপে; হারাতে পারেনি কেউ। বিশ্বসেরা খেতাবি লড়াইয়ে হারেননি কোনোদিন। তাই শেষ দিন পর্যন্ত দাবি করে গেছেন, ‘আমিই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’।
অবশ্য এসব সাফল্যে আর সৃষ্টিতে ফিশার ধরা পড়েন না। এ তো আর দশজনও করতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা তো ফিশার হতে পারেন না। ফিশার হলেন তিনি, যিনি খেতাবি লড়াই লড়তে বসে একের পর এক টালবাহানা করে খেলা বাতিল করে দেওয়ার ভয় দেখান।
১৯৭২ সালে স্পাসকির বিপক্ষে ম্যাচ। প্রথম ম্যাচ থেকেই টালবাহানা। বোর্ডটা খুব চকচকে, চোখে লাগছে। বদলে দাও। ক্যামেরা কেন? বের করে দাও। ওর পায়ে খসখস শব্দ হচ্ছে। এমন লোকের খেলা বন্ধ করে দিতে বড় কোনো কারণ লাগে না। বন্ধও করে দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হেনরি কিসিঞ্জার ফোন করে অনুরোধ করলেন খেলা চালাতে। পরবর্তীকালে নিজেই বলেছেন, ‘স্পাসকি ভদ্রলোক ছিল বলে সব মেনে নিয়েছে।’
খেলা নিয়ে এমন ‘বিপ্লব’ করে সবার চোখ টেনেছেন সেই বালকবেলাতেই। ১৯৫৯ সালে আন্দোলন করে ইউএস চেস ফেডারেশনকে বাধ্য করেন প্রকাশ্যে চ্যাম্পিয়নশিপের ড্র আয়োজন করতে। ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রেজেভস্কির বিপক্ষে ১৬ ম্যাচ সিরিজ ১১ ম্যাচ খেলার পর ছেড়ে দেন। কারণ, তাঁকে আগে থেকে না জানিয়েই ১২তম ম্যাচের স্থান ও সময় ঠিক করা হয়েছিল!
সব বিষয়েই তাঁর আপত্তি। আপত্তি তুলেছেন যিশুখ্রিষ্টকে নিয়ে। নিৎসের একটা বই পড়ে মেনে নিয়েছিলেন, ‘ধর্মের কাজ মানুষকে নির্বোধ করা’।
একটা বয়স পর্যন্ত জিন্স বা সাধারণ শার্ট পরতেন। কিন্তু কিছু টাকা-পয়সা আসা শুরু করার পর হয়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ‘অভিজাত’ পোশাকের দাবাড়ু। ট্রেনে-বাসে উঠতে চাইতেন না, ‘ওখানে গরিব আর খারাপ পোশাক পরা লোক আসে’ বলে!
ফিশারের জীবনটা পুরো পৃথিবীর সামনে একটা ধাঁধায় পরিণত হলো ১৯৭৫ সালে। আনাতোলি কারপভের সঙ্গে খেতাবি লড়াইয়ে নামলেন না তিনি। বিশ্বাস করুন, তাঁর নাকি নামার ইচ্ছে ছিল! মাত্র ৬৪টি লিখিত শর্ত দিয়েছিলেন লড়াইটা আয়োজনের। ফিদে এত পেরে ওঠেনি। তাই ১৯৭২-এ স্পাসকির বিপক্ষে সেই খেতাবি লড়াই-ই হয়ে রইল ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ফিশারের শেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ। এর মধ্যে ফিদেও তার ‘শর্ত’ মানল না। ফিশারেরও খেলা হলো না। ম্যাচ না খেলেও আলোচনায় রইলেন। কখনো কম্পিউটারের বিপক্ষে খেলে, কখনো ব্যাংক ডাকাতিতে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হয়ে।
এই দাবা-বিরতিপর্বেই মানসিকভাবে তীব্র আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠেন ফিশার। ইহুদিদের একটি সংগঠনকে চিঠি লিখে জানান, ইহুদি তালিকা থেকে তাঁর নাম কেটে দিতে। ১৯৯২ পর্যন্ত ইহুদি এবং যুক্তরাষ্ট্র; নিজের এই দুই পরিচয়ের প্রতিই তাঁর ঘৃণা ছিল প্রকাশ্য। এ বছর সেটা বাস্তবে রূপ নিল স্পাসকির বিপক্ষে যুগোস্লাভিয়ায় ‘চ্যাম্পিয়নশিপ’ খেলতে যাওয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিলো তার আইসল্যান্ডে গিয়ে সোভিয়েত দাবাড়ুর সাথে খেলার ব্যাপারে। তিনি থোড়াই পরোয়া করেন যুক্তরাষ্ট্রের আইন।
চলে গেলেন লড়তে। লড়াইয়ে ফিশার জিতেছিলেন। বিনিময়ে পেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। নিষিদ্ধ যুগোস্লাভিয়ায় খেলার কারণে। এখান থেকে যেনো অদৃশ্যই হয়ে গেলেন ফিশার। তার সেই অর্থে আর কোনো খোজ খবর নেই। অন্তত মানুষের চোখের সামনে আর ছিলেন না তিনি।
এর পর থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত একরকম মিথ হয়েই টিকে রইলেন ফিশার।
কেউ দেখে না তাঁকে। শুধু বারকয়েক কণ্ঠ শোনা গেল ফিলিপাইন বেতারে। নাইজেল শর্ট একবার দাবি করলেন, ইন্টারনেটে খেলেছেন তিনি ফিশারের বিপক্ষে! কেউ বিশ্বাস করল না।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। টুইন টাওয়ার আর পেন্টাগনে হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি বেতারে এলেন। এই আক্রমণকে জানালেন স্বাগত। প্রকাশের অযোগ্য ভাষায় শেষ করে দেওয়ার আহ্বান জানালেন যুক্তরাষ্ট্রকে।
সত্যি সত্যি ফিশারকে পাওয়া গেল ২০০৫ সালে জাপানের নারিতা বিমানবন্দরে। যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট তাঁর হাতে। পরে জানা গেলো, ফিলিপাইনে এক দাবাড়ু বন্ধুর সাথেই থাকতেন। সেখানে একটা বিয়ে না করলেও সংসার মতোও নাকি তৈরী হয়েছিলো।
তারপর তো জানা কথা। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে বাঁচাতে আইসল্যান্ড জাতীয় সংসদে বিল পাস করে তাঁকে সম্মানজনক নাগরিকত্ব দিয়ে নিয়ে যায়। সেই থেকে ছোট্ট এই দেশটিতেই ছিলেন। আর দাবা খেলেননি। এই জীবনটায় আরও প্রথাবিরোধী হয়ে উঠেছিলেন। অনেকটাই খ্যাপাটে এই সময় তিনি। প্রচলিত এলোপেথিক ওষুধ পর্যন্ত খেতেন না। আয়ুর্বেদে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন।
স্পাসকি, কাসপারভ কতজন গেছেন এই দলছুট কিংবদন্তিকে দেখতে! কোনো কিছুই টানেনি। এই আধুনিক জগৎটাই তো তাঁর কাছে মিথ্যে আর ইহুদি-শাসিত!
একেবারে কিছুই টানেনি, কথাটা সত্যি হলো না। ভালো লেগেছিল তাঁর বিশ্বনাথন আনন্দের খেলা। একবার খেলতে চেয়েছিলেন আনন্দের বিপক্ষে। ঠিক দাবা নয়, নিজের আবিস্কার করা ‘ফিশার্যান্ডম’! তাতেও আনন্দ রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু সময় হলো না।
৬৪ বছর বয়সে আরও একটা আফসোস রেখে চলে গেলেন ফিশার। তাই তো যাবেন। ফিশারের কাজই তো সবার আফসোস দেখে অট্টহাস্য করা!