দ্য এভারগ্রিন চায়নাম্যান

ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন বছর তিনেক হল। কিন্তু, এ কি! মাঠে বল নিয়ে কে উনি? ঠিক এমনই এক অনুভূতি হয়ত জেগেছিল ক্রিকেট ভক্তদের মনে। ২০০৮ সালে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার চায়নাম্যান বোলার ব্র‍্যাড হগ। কিন্তু ২০১১ সালে তিনি আবার ফিরেছিলেন ক্রিকেট মাঠে। না কোচ হিসেবে নয়, খেলোয়াড় হিসেবেই। অস্ট্রেলিয়ার ফ্রাঞ্চাইজ ভিত্তিক টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট বিগ ব্যাশ দিয়ে ৪০ বছর বয়সে ক্রিকেট অধ্যায়ের দ্বিতীয় যাত্রা শুরু করেন হগ।

ব্র‍্যাড হগ জন্মেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে। ছয় ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ সালে মা-বাবার ঘর আলো করে ভূমিষ্ট হওয়া ব্র‍্যাড হগ পরবর্তীতে আলো ছড়িয়েছেন ক্রিকেট অঙ্গনে। তবে গল্পের শুরুটা নিতান্তই সাদামাটা ছিল না তাঁর। কাজ করতেন উইলিয়ামন্স নামক স্থানে এক ফার্মে। সেই সাথে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটটা খেলতেন হগ।

মূলত একজন ব্যাটার হিসেবেই তিনি নিজেকে গড়ে তুলছিলেন অল্প অল্প করে। চায়নাম্যান বোলার তো হয়েছে বহু পরে৷ সেই যে ফার্মে কাজ করতেন, সেই ফার্মের মালিকের কাছে সময় নিয়ে এসেছিলেন কোন এক ক্রিসমাস অবধি ৷ ততদিনে ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে হগ পূর্ণ মনোনিবেশ করবেন খামারের কাজে ৷

নিজেকে ছুড়ে দিলেন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। হেরে যাবেন হয়ত ভেবেছিলেন ৷ তাই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আবার সেই ফার্মেই ফেরত আসার। কিন্তু না, ভাগ্য বিধাতার পরিকল্পনা নিশ্চয়ই ভিন্ন ছিল ৷ অবশ্যই ভিন্ন ছিল। তিনি মুখ তুলে চাইলেন হগের দিকে৷ ব্যাস! এসে গেল ডাক ৷ সালটা ১৯৯৪। ব্র‍্যাড হগ একজন ব্যাটার হিসেবে প্রথম শ্রেণি ক্রিকেট খেলার নিমন্ত্রণ পান তাঁর জন্মস্থান পশ্চিমাঞ্চলের কাছ থেকে ৷ শুরু হল নতুন এক পদযাত্রার।

যেমনটা বলছিলাম, একেবারে গোড়া থেকে ব্র‍্যাড হগ ছিলেন না একজন বোলার৷ ঘরোয়া ক্রিকেটে বছর দু’য়েক পার করার পর অস্ট্রেলিয়ার সাবেক লেগ স্পিনার টনি ম্যান তাঁকে টোটকা দিয়েছিলেন লেগ স্পিন করার। তিনি কোন এক নেট সেশনে টনি ম্যানের দেওয়া টিপস কাজে লাগিয়ে বোলিং করতে লাগলেন।

নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত হতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন শুধু ব্যাটার না তিনি একজন বোলার হিসেবেও ক্রিকেটটা খেলতে চান ৷ সেই মৌসুমে ঘরের হয়ে ২১টি উইকেট ও নিয়েছিলেন হগ। তারপর তো তিনি বনে গেলেন ‘এভারগ্রিন চায়নাম্যান’।

তবে নিজের ঝুলিতে অনন্য এক অস্ত্রের শামিল ঘটালেও ব্র‍্যাড হগের জাতীয় দলের রাস্তাটা মোটেও মসৃণ ছিল না। থাকবেই কি করে বলুন, দলে তো তখন কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নের রাজত্ব। তাঁকে হটিয়ে দলে থিতু হওয়া কি আর চাট্টিখানি কথা? তবুও ১৯৯৬ সালে তিনি জাতীয় দলের ওয়ানডে ফরম্যাটের জন্য ডাক পেলেন।

অভিষেক ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২৬ রান খরচায় নিয়েছিলেন এক উইকেট ৷ তাতে আর কিছু না হোক দলে থেকে যাওয়ার একটা রাস্তা তৈরি হল। সে বছর টেস্ট দলেও জায়গা পান ৷ উপমহাদেশের উইকেট বিবেচনায় বর্ডার-গাভাস্কার সিরিজে অজিদের হয়ে ‘ব্যাগি-গ্রিন’ ক্যাপ পরে মাঠে নেমেছিলেন হগ।

অভিষেক টেস্টে নিয়েছিলেন এক উইকেট। তাতে খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারেননি তখনকার অজি হর্তাকর্তারা। দল থেকে ছিটকে যান। এরপর স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল অস্ট্রেলিয়া দলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। ওয়ার্নের অবর্তমানে দলের স্পিন কোটা পূরণ করতেন ম্যাকগিল।

আর অন্যদিকে, হগ ঘরোয়া লিগে নিজের সেরাটা নিঙরে দিয়ে জাতীয় দলে ফেরার প্রচেষ্টা করতে থাকেন ৷ ২০০১/০২ মৌসুমে ঘরোয়া লিগে ভাল করার সুবাদে হগের আবার ডাক আসে জাতীয় দলে ৷ তবে তখন ওয়ার্নারে ইনজুরি ছিল তাঁর ডাক পাওয়ার প্রধান কারণ।

মূলত একজন অতিরিক্ত বোলার হিসেবে বাজিয়ে দেখতেই ত্রিদেশীয় সিরিজে দলে নেওয়া হয়েছিল ব্র‍্যাড হগকে। সেই ত্রিদেশীয় সিরিজে বল হাতে নিজের উইকেট নেওয়ার সক্ষমতা সামনে নিয়ে আসেন হগ। একই সাথে নিজের ব্যাটিং সামর্থও প্রদর্শন করেন তিনি ৷ তাতে মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়ে যান নির্বাচকরা।

২০০৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়ে যান হগ ৷ তবে পরিকল্পনায় তিনি ছিলেন বিকল্প বোলার। যেহেতু তখনও ওয়ার্ন দলের সদস্য। কিন্তু হগের কপাল আরেকটু খুলে গেল। শেন ওয়ার্ন বাদ পড়লেন দল থেকে। ডোপ টেস্টের মারপ্যাঁচে এই কিংবদন্তি ছিটকে যান বিশ্বকাপ থেকে। এরপরের যাত্রাটায় হগ নিজেকে উজাড় করে দিয়ে দলকে শিরোপা জেতাতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

এরপর জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য বনে যান ব্র‍্যাড হগ ৷ ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১৫৬টি উইকেট রয়েছে তাঁর নামের পাশে ৷ মাত্র সাত টেস্ট খেলে লাল বলের উইকেট নিয়েছেন ১৭টি। দুই ফরম্যাটেই টুকটাক রান করেছেন ৷ ২০০৮ সালে সিদ্ধান্ত নেন ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াবার।

অন্তত একজন খেলোয়াড় হিসেবে ক্রিকেটে আর থাকতে চাইছিলেন না তিনি ৷ ক্রিকেটের কমেন্ট্রি বক্সে আনাগোনা শুরু হয় তাঁর। সবাই ভেবে নেন হয়ত মাইক হাতে বাকি জীবন তিনি কাটিয়ে দেবেন ক্রিকেটের সাথে। কিন্তু ২০১১ সালে সবাইকে রীতিমত অবাক করে দিয়ে তিনি ফেরেন ক্রিকেট ময়দানে ৷ পুরাদস্তুর একজন খেলোয়াড় হিসেবেই।

৪০ বছর বয়সে তিনি ফ্রাঞ্চাইজ ভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে নেমে নিজের মধ্যে থাকা চির-তরুণ সত্ত্বাটার পরিচয় করিয়েছেন বিশ্বের সাথে। বয়সের বিন্দুমাত্র প্রভাব যেন ছিল না তাঁর খেলায়। দিব্যি তরুণ বোলারদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে বোলিং করেছিলেন বিগ ব্যাশের দল পার্থ স্কোরচার্সের হয়ে।

দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে তিনি জীবনের ৪০টি বসন্ত পার করে ফেলেছেন। তাঁর এমন অভাবনীয় জীবনীশক্তি আবার অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের নির্বাচকদের বাধ্য করে তাঁকে নিয়ে আরেকটিবার ভেবে দেখবার। ফলস্বরূপ তিনি ৪০ বছর বয়সে আবার ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় দলে। তবে এবারের গল্পে সাফল্য খুব একটা ছিল না।

তবে এরপর আরও বেশ কিছু বছর তিনি ক্রিকেট খেলে বেড়িয়েছেন। ২০১৮ সাল অবধি খেলেছেন বিগ ব্যাশে। এর ফাঁকে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। খেলেছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) মতো ফ্রাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্টে। বয়সের অর্ধ-শতক হাঁকানো এই খেলোয়াড় হয়ত এখনও খেলে বেড়ান ক্রিকেট। চির-তরুণ চায়নাম্যানের গুগলিতে কুপোকাত হয় নতুন এক প্রজন্ম।

Share via
Copy link