ইউরোপ ভীতু ব্রাজিল

আবারও স্বপ্ন ভঙ ব্রাজিলের। দুই দশকের অপেক্ষাটা আরও বেড়ে অন্তত দুই যুগ হবে। ক্রোয়েশিয়ার সাথে স্নায়ুযুদ্ধে পরাস্ত হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় ব্রাজিলের। একগাদা তারকা ফুটবলার নিয়ে হেক্সা জয়ের মিশনে কাতারে হাজির হয়েছিল সেলেসাওরা। তবে কাঙ্খিত সেই শিরোপটা অধরাই থেকে গেল নেইমার, থিয়াগো সিলভাদের।

আবারও স্বপ্ন ভঙ ব্রাজিলের। দুই দশকের অপেক্ষাটা আরও বেড়ে অন্তত দুই যুগ হবে। ক্রোয়েশিয়ার সাথে স্নায়ুযুদ্ধে পরাস্ত হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় ব্রাজিলের। একগাদা তারকা ফুটবলার নিয়ে হেক্সা জয়ের মিশনে কাতারে হাজির হয়েছিল সেলেসাওরা। তবে কাঙ্খিত সেই শিরোপটা অধরাই থেকে গেল নেইমার, থিয়াগো সিলভাদের।

তবে এর পেছনে সূক্ষ্ম একটা ভীতি কাজ করেছে সেই ২০০২ এর পর থেকে। সেবার জার্মানির বিপক্ষে ২-০ গোলের জয় পেয়েছিল ব্রাজিলের সেই লেজেন্ডারি দলটি। ফাইনালে অলিভার কানের মত ধুরন্ধর গোলরক্ষককে দুই দফা পরাস্ত করে বিশ্বকাপের উন্মাদনায় মেতেছিল ব্রাজিলিয়ানরা। এরপর থেকেই ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসটায় নেমে আসে ইউরোপের কাল ছায়া।

এশিয়ায় হওয়া সেই বিশ্বকাপের ঠিক বছর বিশেক বাদে আবার এশিয়াতে বসেছিল বিশ্বকাপ। এবার তাই আরও একটি শিরোপা জয়ে বিভোর ছিল সেলেসাওরা। কিন্তু ভাগ্য অথবা নিজেদের অপরাগতায়, চতুর্থবারের মত কোয়ার্টারফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে পাঁচ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। মাঝে অবশ্য একদফা সেমিফাইনালে উঠেছিল সেলেসাওরা। সে গল্প তো স্রেফ এক বিভীষিকা।

তবে এই যে পাঁচটি বিশ্বকাপেই ব্রাজিলের বিদায় খালি হাতে। এর পেছনে প্রতিবারই দায়ী কোন না কোন ইউরোপীয় দল। ২০০৬ সালে শিরোপা ধরে রাখার লড়াইটা শুরু হয় জার্মানীর মাটিতে। অপেক্ষাকৃত সহজ গ্রুপের প্রত্যাশিত চ্যাম্পিয়ন হয়েই পরবর্তী রাউন্ডের টিকিট কাঁটে ব্রাজিল। রাউন্ড অব সিক্সটিনে তাদের প্রতিপক্ষ আফ্রিকার দেশ ঘানা। ৩-০ গোলের বড় জয় নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নরা।

কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। এর আগে একমাত্র ইউরোপীয় দেশ হিসেবে ব্রাজিল প্রতিদ্বন্দিতা করেছিল ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। শক্তিমত্তার বিচারে বেশ পিছিয়ে ছিল সে সময়ের ক্রোয়েশিয়া। তবে তাদের বিপক্ষেও ব্রাজিলের জয়টা ছিল ১-০ ব্যবধানে। আর ঠিক একই গোল ব্যবধানে তাঁরা কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বসে ফ্রান্সের কাছে। শেষ অবধি সেবার ফাইনাল খেলেছিল ফ্রান্স। যদিও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।

একই ধারা অব্যাহত থাকে ২০১০ বিশ্বকাপেও। সেবার ব্রাজিলের যম হয়ে হাজির নেদারল্যান্ডস। আরিয়ান রবেনের দলের কাছে ব্রাজিল হেরেছিল ২-১ ব্যবধানে। কাকতালীয়ভাবে সেবার ডাচরাও ফাইনাল খেলেছিল। তবে তাদেরও ফাইনালটা হারতে হয়েছিল। এই ধারাবাহিকতার অবসান ঘটায় জার্মানি ২০১৪ সালে।

সেবার ব্রাজিলের ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ। চিরায়ত নিয়ম মেনেই ব্রাজিল হট ফেভাবিট। তবুও হট ফেভারিট ব্রাজিলকে আটকে দিয়েছিল উত্তর আমেরিকার দল মেক্সিকো। তবে সেটা গ্রুপ পর্বে। সেবার ক্রোয়েশিয়াকে ৩-১ গোলে গ্রুপ পর্বে হারিয়েছিল ব্রাজিল। এরপর সেমিফাইনালের আগে আর কোন ইউরোপীয় দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ মেলেনি সেলেসাওদের। আর সেমিফাইনালে নেইমারহীন ব্রাজিলের সাথে রীতিমত ছেলেখেলা করে জার্মানি।

জোয়াকিম লোর শীর্ষ্যরা অতিরিক্ত সময়ের অন্তিম লগ্নে গোল আদায় করে। ব্রাজিলকে নকআউটে হারানো দল শিরোপা উৎসব করতে না পারার ধারাবাহিকতায় লাগাম টানে মারিও গোৎজে। তবে তাতে অবশ্য ব্রাজিলের ইউরোপ ভীত আর নকআউট পরাজয়ের ধারাবাহিকতায় কোন ধরণের ব্যঘাত ঘটেনি। ২০১৮ সালেও একই চিত্র। সেবার অপেক্ষাকৃত খর্বশক্তির ইউরোপীয়ান দল সুইজারল্যান্ডের সাথে গ্রুপ পর্বে ১-১ গোলে ড্র করে নেইমার বাহিনী।

এরপর অবশ্য সার্বিয়ার বিপক্ষে জয় পেতে সমস্যা হয়নি। অধিনায়ক থিয়াগো সিলভার করা গোল ২-০ গোলের জয় এনে দেয় ব্রাজিলকে। কিন্তু আবারও সেই কোয়ার্টার ফাইনালে ইউরোপ বাঁধা। এবার প্রতিপক্ষ বেলজিয়াম। সেবার অবশ্য বেলজিয়ামের গোলরক্ষক থিবো কোর্তায়া বনে গিয়েছিল চীনের প্রাচীর। হাজার চেষ্টা করেও তাঁকে দমন করা যায়নি। ২-১ গোলের পরাজয়ে টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যায় ব্রাজিল। বেলজিয়ামের সেবার বিশ্বকাপ যাত্রা অবশ্য সেমিফাইনালেই থেমে গিয়েছিল।

ইউরোপের বিপক্ষে ব্রাজিলের অসহায় আত্মসমর্পণের চিত্রটা বদলায়নি কাতার বিশ্বকাপেও। দারুণ ছন্দে থাকা দলটাকে রীতিমত চোখের জলে ভাসিয়ে বাড়ি পাঠালো ক্রোয়েশিয়া। গেল বারের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া সেই ফাইনাল বাদে এখন অবধি বিশ্বকাপে হারেনি কোন ম্যাচ। তাদের জয়ের ধারা অব্যাহত রেখে ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে হারিয়েছে দলটি। নির্ধারিত ১২০ মিনিটের খেলায় ১-১ এর সমতার ম্যাচটি ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে নিয়ে আসেন তাদের গোলরক্ষক ডমিনিক লিভাকোভিচ।

ব্রাজিল ২০০২ সালের পর থেকে প্রতিবারই বিশ্বকাপে হাজির হয়েছে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে। তবে তাঁরা ইউরোপ নামক বাঁধা কখনো টপকাতে পারেনি। শেষ সেবার নকআউটে ইউরোপের চারটি দলকে হারিয়ে তবে শিরোপায় হাত রেখেছিল রোনালদো, রিভালদো, কাফু, রবার্তো কার্লোসরা।

ব্রাজিলের এই ইউরোপ ভীতির প্রধান কারণ, নিয়মিত ইউরোপীয় দলগুলোর সাথে ম্যাচ খেলতে না পারা। হয়ত দলের অধিকাংশ খেলোয়াড় ইউরোপের সব নামিদামি ক্লাবে খেলে থাকে। তবুও দলগতভাবে ইউরোপের দলগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী। মাঠের ফুটবলে না হলেও, ড্রয়িং বোর্ডে বেশ এগিয়ে তাঁরা। ২০০২ সালের পর সব কয়েকটি শিরোপা গিয়েছে ইউরোপে। এমনকি কেবল ২০১৪ সাল ব্যতীত ফাইনাল অবধি উঠতে পারেনি লাতিন আমেরিকার কোন দল।

এ থেকেই আন্দাজ করে নেওয়া যায় যে, ইউরোপের ফুটবল ঠিক কতটা এগিয়েছে। একটা সময় লাতিন ফুটবলের জয়জয়কার থাকলেও, সে দিন বদলেছে। অতএব ব্রাজিলের এই ইউরোপ ভীতি কাটানোর একটিই উপায়- বেশি বেশি ইউরোপের দলগুলোর সাথে ম্যাচ আয়োজন। সেটা যেকোন টুর্নামেন্ট থেকে দ্বিপাক্ষিক প্রীতি ম্যাচও হতে পারে। নতুবা ব্রাজিল তথা অন্য মহাদেশের দলগুলোর বিশ্বকাপের আক্ষেপ ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে। আর বিশ্বকাপের অলিখিত দখল চলে যাবে ইউরোপের হাতে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...