তিনি ছিলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সোনালি সময়ের শেষ স্মৃতি। মাঝেও একবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন। তবে পরে আবার ফিরে এসেছিলেন নিজ দেশের হয়ে খেলবেন বলে। ৩৫ বছর বয়সে এসেও তিনি দেশটির ব্যাটিং স্তম্ভ ছিলেন। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরাদের একজন। যার ক্ল্যাসিকাল ব্যাটিং এ বুঁদ হয়ে ছিল জিম্বাবুয়ের একটি প্রজন্ম।
ব্রেন্ডন টেলর বিদায় জানানোর সময় তাঁকে নিয়ে আক্ষেপটাই বেশি ছিল, সেই আক্ষেপটা আরো বাড়লো যেন ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে যাওয়ার পর। মাদক, ফিক্সিং নিষেধাজ্ঞার আড়ালে যেন চাপাই পড়ে গেল ব্যাট হাতে তাঁর ধুন্ধুমার সব লড়াই।
জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট যাত্রাটা শুরু হয়েছিল বেশ দারুণ ভাবে। একেবারে ছোট বয়সেই নজরে পড়েছিলেন অ্যালিস্টার চ্যাপেলে বাবা ইয়ান চ্যাপেলের। ফলে স্কুলে থাকতেই জিম্বাবুয়ের ঘরোয়া ক্রিকেটে পরিচিত হয়ে উঠছিলেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই ম্যাশোনল্যান্ডের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন।
ফলে জিম্বাবুয়ের বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে নিয়মিত সদস্য ছিলেন টেলর। দুইবার খেলেছেন অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হওয়ার পইরের বছরই লোগান কাপে ডাবল সেঞ্চুরি করে হৈচৈ ফেলে দেন। ফলে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ২০০৪ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন এই ব্যাটসম্যান।
টেলর জিম্বাবুয়ে দলে এসেছিলেন ভয়াবহ এক দু:সময়ে। সেই সময়ের দলের সেরা খেলোয়াড়রা বোর্ডের বিপক্ষে বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছিল। সেই সময় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে আসেন এক নতুন মহাতারকা হয়ে।
দ্রুতই জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং লাইন আপে বড় নাম হয়ে উঠেন ব্রেন্ডন টেলর। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সফরে আসে জিম্বাবুয়ে। সেখানে বাংলাদেশের বিপক্ষে তৃতীয় ম্যাচ জয়ে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শেষ বলে জিম্বাবুয়ের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ৫ রান। মাশরাফি বিন মর্তুজার বলে ছয় মেরে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন তরুণ টেলর।
এখন অবধি জিম্বাবুয়ে যে কয়েকজন আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটার তৈরি করেছে তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ২০১৫ সালে তাঁর নেতৃত্বেই ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে যায় জিম্বাবুয়ে। বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে পরপর দুটি সেঞ্চুরিও করেছিলেন এই ব্যাটসম্যান। প্রথম সেঞ্চুরিটি আসে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। সেখানে ৯১ বলে খেলেন ১২১ রানের ইনিংস। এরপরই মাত্র ২৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়েছিলেন এই ব্যাটসম্যান।
পরে জানা যায় ৩ বছরের জন্য কলপ্যাক চুক্তি করেছিলেন টেলর। খেলতে চলে যান ইংলিশ কাউন্টি দল নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে। টেলর ইংল্যান্ড চলে যাইয়ার পড় নিজেদের ব্যাটিং নিয়ে বেশ ভালোই ভুগেছিল জিম্বাবুয়ে। তবে ২০১৭ সালে আবার কাউন্টি ক্রিকেট ছেড়ে জিম্বাবুয়েতে ফিরে আসেন টেলর। গত চার বছর ধরে দলপ্টির ব্যাটিং সামলাচ্ছেন তিনি।
জিম্বাবুয়ের হয়ে ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। কিংবদন্তি অ্যান্ড্রু ফ্লাওয়ারের থেকে মাত্র শ খানেক রান পিছিয়ে আছে। সেঞ্চুরি করেছেন ফ্লাওয়ারের থেকেও বেশি। দেশটির হয়ে খেলা ২০৫ ওয়ানডে ম্যাচে ৩৫.৫৫ গড়ে করেছেন ৬৬৮৪ রান। এই ফরম্যাটে তাঁর ঝুলিতে আছে ১১ টি সেঞ্চুরি ও ৩৯ টি হাফ সেঞ্চুরি। দেশটির হয়ে খেলা ৩৪ টেস্টেও করেছেন ২৩২০ রান। ওদিকে ৪৫ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে আছে প্রায় হাজার খানেক রান।
সবমিলিয়ে নিজের স্ববাভসুল্ভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং দিয়ে জয় করেছিলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ভক্তদের মন। ক্ল্যাসকাল কাভার ড্রাইভ কিংবা স্ট্রেট ড্রাইভে যে মুগ্ধতা ছড়াতেন তা চোখে লেগে থাকবে বহুকাল। পাওয়ার হিট না করেও কীভাবে দ্রুত রান তোলা যায় সেটি দেখিয়েছিলেন ক্রিকেট বিশ্বকে।
ব্রেন্ডন টেলরের সমসাময়িক ছিলেন রস টেলর, নিউজিল্যান্ডের গ্রেট। চাইলে জিম্বাবুয়ের ব্রেন্ডন টেলরকেও রস টেলরই বলা যায়। কারণ, জিম্বাবুয়ের এই তারকার পুরো নাম ব্রেন্ডন রস মারে টেলর। ক্রিকেটাঙ্গনে রস টেলরের চেয়ে কম গুরত্বপূর্ণ ছিলেন না ব্রেন্ডন। অন্তত, জিম্বাবুয়ের প্রেক্ষাপটে তিনি বিরাট ব্যাপারই বটে। কিন্তু, ওই যে ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় ওই ফিক্সিং – এক হাড়ি দুধে এক ফোঁটা বিষ!