স্থির বৃক্ষ দেয় রানের শীতল ছায়া

বিশাল বড় এক বটবৃক্ষ। দীর্ঘকাল ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বাজারের ঠিক দক্ষিণ পার্শ্বে। ঝড় হয় বৃষ্টি হয় পাশে  থাকা বহু গাছ শিকড় ছাড়িয়ে নড়বড়ে হয়ে বিলিন হয়। তবু সেই যে বটবৃক্ষ। ধীরস্থির চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে সবার বদলে যাওয়া কিংবা এসে চলে যাওয়া। কল্পনায় থাকা সেই বটবৃক্ষ হয়ে ক্রিকেটের ময়দানে আবির্ভূত হয়েছিলেন ডন ব্রেন্ডন কুরুপ্পু। তা অবশ্য বহুকাল আগের কথা।

১৯৮৭ সাল, নিউজিল্যান্ড এসেছিল শ্রীলঙ্কায় টেস্ট সিরিজ খেলতে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে এসেছিল কিউইরা। সেই সিরিজ দিয়েই অভিষেক হয়েছিল ব্রেন্ডন কুরুপ্পুর। অভিষেক সিরিজেই নিজের ধীরস্থির মানসিকতার এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে রয়ে গেলেন ইতিহাসের পাতায়। সবচেয়ে ধীর গতিতে করা দ্বি-শতকের মালিক ডন ব্রেন্ডন কুরুপ্পু। কুরুপ্পুর সাথে সেদিন আরও একজন খেলোয়াড়েরও অভিষেক হয়েছিল। ব্ল্যাকক্যাপসদের হয়ে টেস্ট ক্যাপ পেয়েছিলেন অ্যান্ড্রু জোনস।

এপ্রিলের তপ্ত রোদ তখনও মাটিতে স্পর্শ করা বাকি। আদ্রর্তার আধিক্য তখনও বাতাস জুড়ে। রোশান মহানামাকে সঙ্গী করে ব্যাট হাতে বাইশ গজের দিকে এগোলেন ব্রেন্ডন কুরুপ্পু। দু’জনে মিলে সকালের সূর্যটা মাথার ঠিক মাঝ বরাবর ওঠার আগে ৪২ মিনিট অবধি টিকে থেকে স্কোরবোর্ডে রান তুললেন ২৯। মহানামা বেশিক্ষণ আর থিতু হতে পারেননি ক্রিজে। চলে যান সাজঘরে ১৬ রান করে। এরপর আসাঙ্কা গুরুসিনহা এসে ৪১ রানের একটি ছোট্ট পার্টনারশিপ গড়ে তিনিও হাটা শুরু করেন মাঠের কোনায় থাকা ড্রেসিং রুমের দিকে।

ম্যারমেরে হওয়া ম্যাচটাকে নিজের দক্ষতায় খানিকটা চাঙ্গা করে তুলবার চেষ্টা করেন রয় ডায়াস। কব্জির পূর্ণ ব্যবহারে তিনি দারুণ সব শট খেলতে শুরু করেন। কিন্তু সেই দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং আর খুব বেশি স্থায়ী হয়নি মাত্র ৪৬ বল খেলে ২৫ রান করে তিনিও ফেরেন প্যাভিলিয়নে। দিনের খেলা তখন প্রায় শেষের দিকে। ব্যাটিং এ নামলেন অর্জুনা রানাতুঙ্গা। কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়ে সেই যে বটবৃক্ষ বেশে অপরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুরুপ্পু। শুধু দাঁড়িয়ে থেকেছেন যে কুরুপ্পু তা কিন্তু নয়। রান ছায়া হিসেবে লঙ্কানদের বোর্ডে তুলে দিয়েছিলেন ৬৬ রান।

দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই রানাতুঙ্গার ইনিংসের ইতি ঘটে। কুরুপ্পুকে এবার সঙ্গ দিতে আসেন রঞ্জন মাদুগালে। ইউয়েন চ্যাটফিল্ড ও রিচার্ড হ্যাডলির বোলিং দাপটে ক্রিজে টিকে থাকাই এক দূর্বিষহ বিষয়। তাঁদের বোলিং তাণ্ডবকে আরও বেশি তরান্বিত করেছেন জন ব্রেসওয়েল এবং ইভান গ্রে। তবে পিচ যে একেবারে নির্জীব এক মৃত্তিকা মন্ড। কোন প্রকার সুযোগ সুবিধাই যেন পাচ্ছিলেন না কিউই বোলারা পিচ থেকে।

তাই কুরুপ্পুও হয়ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোন প্রকার সুযোগ তিনিও দেবেন না ব্ল্যাকক্যাপস বোলারদের। সকল প্রতিকূলতা, সতীর্থদের আসা-যাওয়ার মাঝে নিজের অভিষেক ম্যাচেই শতরান পার করে ফেলেন তিনি। দ্বিতীয় দিন শেষে স্কোরবোর্ডে ৩১৭ রান তুলতে সক্ষম হয় লঙ্কানরা। দৃঢ়তার সাথে এক প্রান্ত আগলে রেখে দলীয় মোট সংগ্রহের প্রায় অর্ধেক রান করেন কুরুপ্পু। ১৫৩ রানে দিন শেষ করেন তিনি। সঙ্গী রঞ্জন মাদুগালে ছিলেন ৫৯ রান করে।

পরদিন ধীর পায়ে কুরুপ্পু এগোচ্ছিলেন নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম দ্বি-শতকের দিকে। কিন্তু ধাক্কা খান সতীর্থ মাদুগালেকে হারিয়ে। তাঁদের দুইজনের মধ্যকার ১০৯ রানের জুটির পতন হয়। শঙ্কা জাগে কুরুপ্পুর মনে। তবে তাঁর সেই শঙ্কার দূরীকরণে আস্থা যোগান রবি রত্নায়েকে ও রুমেশ রত্নায়েকে। তাঁরা দুইজন নিজেদের সেরাটা দিয়ে চেষ্টা করেন কুরুপ্পুকে সঙ্গ দিয়ে যেতে।

শেষমেশ কুরুপ্পু ইতিহাসের তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে নিজের অভিষেক ম্যাচেই দ্বি-শতক হাঁকানোর রেকর্ডটি গড়ে ফেলেন। এর পাশপাশি তিনি যে অনন্য রেকর্ডটি করেন তা হচ্ছে সবচেয়ে মন্থর গতিতে দ্বি-শতক হাঁকানোর রেকর্ড। ডন ব্রেন্ডন কুরুপ্পু সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে প্রায় ৭৭৭ মিনিট ব্যাটিং করেছিলেন।

ঘন্টার হিসেবে প্রায় সাড়ে ১৩ ঘন্টা কুরুপ্পু একাই ওই যে বটবৃক্ষের মতো করে টিকে ছিলেন বাইশ গজে। বিধ্বংসী সব বোলারদের বিপক্ষে যখন অভিজ্ঞরা নাস্তানাবুদ হচ্ছিলো তখন দৃঢ়চিত্তে পপিং ক্রিজটাকে আঁকড়ে ধরেন কুরুপ্পু।

একটি বটবৃক্ষের হয়ত একদিন মৃত্যু হয়। কিন্তু ডন ব্রেন্ডন কুরুপ্পুর করা সেই ধীর গতির দ্বি-শতক পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে রইবে নিশ্চয়ই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link