বাংলাদেশের ফুটবল পেশাদার যুগে প্রবেশ করার আগে থেকেই প্রিমিয়ার থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগের সাথে পাইওনিয়ারের ক্লাবগুলোর ওঠানামার বিষয়টি রয়েছে। প্রিমিয়ার থেকে পয়েন্ট টেবিলের সবার নিচের দলটি নেমে যায় প্রথম বিভাগে। ঠিক তেমনি তৃতীয় বিভাগ থেকে নিচের দলটি পাইওনিয়ারে যেমন নেমে যায় ঠিক তেমনি পাইওনিয়ার থেকে আবার উঠে যায়।
এভাবেই বছরে পর বছর ধরে ফুটবলটা চলে আসছে। কিন্তু এবার বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল থেকে অবনমিত দুই ক্লাব ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও আরামবাগ ক্রীড়া সংঘকে নিয়ে আলোচনাটা একটু বেশিই হচ্ছে। গোপিবাগের ক্লাবটি এখানে এককাঠি এগিয়ে রয়েছে। ঠিক ততটা নয় মতিঝিল ক্লাব পাড়ার ক্লাবটিকে নিয়ে। তবে ব্রাদার্স ও আরামবাগ দুটি ক্লাবই ঢাকার ফুটবলে জায়ান্ট কিলার হিসেবে পরিচিত। এখন নিয়মানুসারে দুই ক্লাবকেই এখন খেলতে হবে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে (বিসিএল)। যদিও ব্রাদার্স প্রিমিয়ারে টিকে থাকা নিয়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) কাছে চিঠি দিয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও আরামবাগের ক্ষেত্রে এমনটি শোনা যায়নি।
- অবনমনের কষ্টে ব্রাদার্স ইউনিয়নে হাহাকার!
বাফুফের বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটিতে তিনজন কর্মকর্তা রয়েছেন ব্রাদার্স ইউয়িন থেকে। সহ সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মহি আবার ঢাকা মহানগর দক্ষিন আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদকের পাশাপাশি সমবায় ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান। নির্বাচিত বাকি দুজন সদস্য হলেন আমের খান ও মহিদুর রহমান মিরাজ। প্রায় একবছর আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জিততে যতটা মরিয়া ছিলেন বিপিএলে দলগঠন করা নিয়ে ছিলেন ততটাই উদাসিন।
সে কারণেই বিসিএলে অবনমিত হয়ে যাওয়ার পর এখন করোনা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে বিপিএলে টিকে থাকার চেষ্টা করছে ক্লাবটি। কিন্তু বাফুফের পেশাদার লিগ কমিটি কতটা নমনীয় হবে ব্রাদার্সের আবেদনে সেটাই দেখার বিষয়। অথচ একটা সময় দেশের তৃতীয় ক্লাব হিসেবে আবাহনী-মোহামেডানের পরই ধরা হতো গোপিবাগের দলটিকে। সেই দলটিই কিনা আগামী মৌসুমে খেলবে বিসিএলে। এটা যেন ক্লাব সংশ্লিষ্টরা মেনে নিতে পারছেন না। ৪৬ বছরের ইতিহাসে এরচেয়ে বাজে সময় আর পায়নি ক্লাবটি।
ইতিহাস সমৃদ্ধ ক্লাবের পাশাপাশি ভিন্ন ফ্যানবেইজও ছিল তাদের। কিন্তু প্রতিনিয়ত দূর্বল দল গঠন করে সাফল্য তো পাচ্ছিলইনা উল্টো এবার তো নেমে যেতে হলো নিচের সারির লিগে। আবার সেখান থেকে লড়াই করে চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরে আসতে হবে বিপিএলে। আশির দশক থেকে শুরু করে নব্বই দশক পর্যন্ত আবাহনী-মোহামেডানের সঙ্গে টক্কর দিতো। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের কাছে ০-৪ গোলে হারের মধ্য দিয়ে ব্রাদার্সের অবনমন নিশ্চিত হয়ে যায়।
১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবল খেলার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু। সময়ের হিসাবে ৪৬ বছর পর দেশের শীর্ষ স্থর থেকে অবনমিত হলো ব্রাদার্স। মৌসুমের শুরু থেকেই ধুকতে থাকা দলটি এ পর্যন্ত ২১ ম্যাচে মাত্র একটিতে জয়ের বিপরিতে ড্র ৩টি আর পরাজয় ১৭টি ম্যাচে। সর্বসাকুল্যে পয়েন্ট মাত্র ৬। ১৯৭৪ সালে ব্রাদার্স দ্বিতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে জায়গা নিয়েছিল। এরপর প্রথম বিভাগ, সিনিয়র ডিভিশন, প্রিমিয়ার লিগ ও পেশাদার লিগ সব আসরে সরব উপস্থিতি ছিল। কিন্তু নামের সাথে মিল রেখে সাফল্য পাচ্ছিলনা। যেমন করে ১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগ লিগের অভিষেক ম্যাচে আবাহনীকে পরাজিত করে চারিদিকে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল সেটি অনেকদিন দেখা যায়নি।
‘তৃতীয় শক্তি’ হিসাবে উত্থান হওয়া ব্রাদার্স ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় তারকার নাম হাসানুজ্জামান খান বাবলু। প্রিয় ক্লাবের অবনমনের খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ের তিনি। এছাড়া সেলিম, সালাম, মহসিন, ওয়াসিমের মতো ফুটবলারের উঠে আসে এই ক্লাব থেকে। প্রয়াত কোচ গফুর বেলুচের প্রাণয়িয় ক্লাবটির এই দশা দেখলে জীবদশ্যায় লজ্জা পেতেন। অথচ স্বাধীনতার পর আগাখান গোল্ডকাপে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। ১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগ ফুটবলে অভিষেকের পরের ছয় বছরে আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতে। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন আবদুস সালাম।
১৯৮০ সালে ফেডারেশন কাপের প্রথম আসরের যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ডামফা কাপের অভিষেক চ্যাম্পিয়নও তারা। ২০০৩-০৪ মৌসুমে ব্রাদার্স লিগ শিরোপা জয় করে। সেই ক্লাবটির এমন পতন দেখে অনেকেই কষ্ট পেয়েছেন। তবে ব্রাদার্সের বাবলু হিসেবে পরিচিতি পাওয়া হাসানুজ্জামান খান বাবলু বলেন, ’আমি যদি মরে যেতাম তাহলে হয়তো ব্রাদার্সের এই অবস্থা দেখতে হতোনা। অথচ দেখেন ১৯৭৫ সালে লিগের আগে প্রস্তুতি ম্যাচে মোহামেডানকে ৩-০ গোলে হারানোর পর প্রথম ম্যাচে আবাহনীকে হারিয়েছিলাম ১-০ গোলে। আমি তো গত দশ বছর ধরেই দেখছি ব্রাদার্সের অবস্থা ভাল না। কয়েকটি মৌসুমে তো কোনরকমে টিকে ছিল। কিন্তু এবার আর পারলনা, এই দায় সাবেক খেলোয়াড় হিসেবে আমার ওপরও বর্তায়। সবকিছুর পর এই ব্যর্থতা যেন মেনে নেবার মতো নয়।’
দলের পারফরম্যান্স খারাপ দেখে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ইরানের রাজা পার্কাসকে। কিন্তু তিনিও কিছু করতে পারেননি। দল হিসেবে আসলে বিপিএলে থাকার মতো ছিল না ব্রাদার্স। দ্বিতীয় লেগে জাহিদ হাসান এমিলি যোগ দিলেও ভাগ্য ফেরেনি। এমনিতেও ক্লাবের ভেতরের অবস্থা ভাল নয় ব্রাদার্সের। খেলোয়াড়দের থাকার রুমগুলো দেখলে যে কারোরই দম বন্ধ হয়ে আসবে। খেলোয়াড়রা ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না। অনেকটা বিনা পারিশ্রমিকেও খেলতে হচ্ছে অনেককে।
সে কারণেই শুরুর দিকে কোচ আব্দুল কাইয়ুম সেন্টু চলে গিয়েছিলেন। ক্লাবটির সাবেক তারকা ফুটবলার ওয়াসিম ইকবাল বলছিলেন, ‘অনেকের কাছে আশ্চর্যের মনে হলে ব্রাদার্সের রেলিগেশনেন পড়টা আমার কাছে আশ্চর্যের মনে হয়নি। এভাবে একটি ক্লাব চালানো যায়না। পরিনবর্তন প্রয়োজন। এখন হয়তো সেটা করা হবে, তবে অনেক দেরি হয়ে গেছে’।
- তালাবদ্ধ আরামবাগের কপালে জুটল অবনমন
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হঠাৎই ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়। মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, আরামবাগ, ওয়ান্ডারার্সের মতো ক্লাবে ক্যাসিনো সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এরপর থেকেই তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের প্রধান ফটক। সবকিছু মিলিয়ে এবার আর প্রিমিয়ারে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি ক্লাবটির। একরকম অভিবাবকশুন্য আরামবাগের তাই বিসিএলে নেমে যাওয়ার পরও যেন কোন খেদ নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এটার জন্যই যেন প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা।
ব্রাদার্স ইউনিয়ন বিপিএলে টিকে থাকতে আবেদন করলেও এসবের ভাবনা নেই ক্লাবটির। সবচেয়ে বড় কথা কোনভাবেই খরচ নিয়ে কুলিয়ে উঠতে না পারার ফলেই এমন ফলাফল মেনে নিতে হয়েছে। এটাকে অস্বাভাবিক বলার যে কোন সুযোগ নেই। মূলত ক্যাসিনো কাণ্ডের পর স্পট ফিক্সিং বেটিংয়ের অভিযোগের বোঝা মাথায় নিয়েই অবনমন হয়েছে আরামবাগের। অথচ এই ক্লাবটিই ২০১৭ সালে বিসিএলে বাংলাদেশ পুলিশের বিপক্ষে ম্যাচে রেফারির সিদ্বান্ত মানতে না পেরে প্রথমে কমলাপুরের বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল ষ্টেডিয়ামে ভাংচুর করেন। পরে এলাকার উশৃঙ্খল লোকজন নিয়ে হামলা করেন বাফুফে ভবনে। এরপর অনেক নাটকীয়তা হয়েছে।
বাফুফের ডিসিপ্লিনারি কমিটি বিশৃঙ্খল কাজ করার দায়ে ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু আদালতে আপিল করে এই জরিমানা স্থগিত করে ক্লাবটি। মূলত ক্লাবটির সভাপতি ছাড়াও ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সে সময়কার ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিনের যুগ্ন সম্পাদক ছিলেন একেএম মোমিনুল হক সাঈদ। তার দাপটের কাছেই মূলত অসহায় থাকত বাফুফের কর্মকর্তারা। আরামবাগও মাঠে বাজে আচরণ করে গেছে। নিজের টাকা আর ক্ষমতার দাপটে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এছাড়া দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতিও ছিলেন তিনি। দেশান্তরী এই সংগঠকের মতোই ত্রাহি অবস্থা আরামবাগের। ২১ ম্যাচ থেকে মাত্র ৫ পয়েন্ট নিয়ে সবার আগে অবনমন নিশ্চিত হয় ক্লাবটির। উত্তর বারিধারার কাছে ১-০ গোলে হেরে ৩ ম্যাচ বাকি থাকতেই দ্বিতীয় বিসিএলে খেলার টিকিট পায় আরামবাগ। এখন বাকি ৩ ম্যাচ জিতলেও অবনমন এড়ানোর কোনো সুযোগ যে নেই। ১১ নম্বরে অবস্থান করা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের পয়েন্ট যে এরই মধ্যে ১৫ হয়ে গেছে।
এর আগে ২০০৭ সালে খাতা কলমে বাংলাদেশের ফুটবল পেশাদার যুগে প্রবেশের পর এবার নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো অবনমিত হলো আরামবাগ। ২০১২-১৩ মৌসুমে প্রথম অবনমন হওয়ার পর ২০১৫-১৬ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে রানার্সআপ হয়ে আবার প্রিমিয়ারে ফিরে এসেছিলেন। এরপরে দুই মৌসুম স্থানীয় কোচ সাইফুল বারী টিটু আর মারুফুল হকের অধীনে দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিয়েছিল তারুণ্যনির্ভর দল আরামবাগ। ২০১৬ সালে ফেডারেশন কাপে রানার্সআপ হয়ে তাক লাগিয়ে দেয়ার পর ২০১৭-১৮ মৌসুমে মারুফুল হকের হাত ধরে স্বাধীনতা কাপে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে ছাড়িয়ে যায় পেছনের সব সাফল্য। এই দলই রবিউল হাসানের মতো খেলোয়াড় জন্ম দিয়েছে। আর এখন তো নতুন যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হচ্ছে আরামবাগকে।