দ্য বুরেওয়ালা এক্সপ্রেস

পাকিস্তান – চিরকালই বিশ্বের এক বিতর্কিত অধ্যায়ের অংশ। একনায়কতন্ত্র, যুদ্ধ, সন্ত্রাস, আত্মঘাতী হামলা এবং ক্রিকেট।

ভারত পাকিস্তান দ্বৈরথ আজও বিশ্ব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপনের একটা। দু’দলেই খেলেছেন বহু কিংবদন্তি, দাপট দেখিয়েছেন নিজের। ব্যক্তিগত ক্যারিশমায় মুগ্ধ করেছেন অগুনতি ক্রিকেটপ্রেমীদের।

শচীন কোহলি ভক্তের সংখ্যা যেমন ওই দেশে গুনে শেষ করা যাবে না, তেমন ইমরান, ওয়াসিমের খেলার ভক্তকুল কম নেই এদেশে।

ইমরান এসেছেন, সরফরাজ এসেছেন, আখতার এসেছেন, এসেছেন ওয়াসিমও। পাকিস্তান চিরকালই বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলারদের আঁতুড়ঘর। কিন্তু এদের সমসাময়িক হয়েও কিছু সময় এদের থেকে নিজের সর্বোচ্চ পারফরমেন্সের পরেও লোকমুখে চর্চা হল না তাঁকে নিয়ে।

ওয়াকার ইউনুস। যার ডাক নাম ছিল টো ব্রেকার। বিষাক্ত ইয়র্কারের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন তাবড় ব্যাটসম্যানেরা। দুটো জিনিস লক্ষ্য করতেন তাঁরা। এক,বলের গতিবেগ। আর দুই,নিজের পায়ের পাতার সুরক্ষিত আছে কিনা। নয়ের দশকে এক ভয় ধরানো নাম।

অথচ ক্রিকেটার হবারই কথা ছিল না তাঁর। ছোটবেলা থেকেই তাঁর ইচ্ছে ব্যাডমিন্টন আর টেনিসে। অলরাউন্ড অ্যাথলিট ছিলেন ওয়াকার। জ্যাভেলিন থ্রো, হাই জাম্প, পোল ভল্টে সমান দক্ষতা ছিল। কে জানত,ক্রিকেটে পা দেবার পর তিনি কড়া প্রতিদ্বন্দ্বীতার সামনে ফেলে দেবেন ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারিকেও। এমনকি ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল লেগ স্পিনার হিসেবে।

জীবনের শুরুটা পাকিস্তানের ভেহারির বুরেওয়ালাতে। লাহোরে পড়াশুনা চলাকালীনই বাবা ডেকে নেন শারজাতে। শারজা স্টেডিয়াম দেখে ক্রিকেটের প্রতি টান জন্মানো তখনই।

শারজা থেকে ফিরে ওয়াকার ভর্তি হন সাদিক পাবলিক স্কুলে। সেই স্কুলে থাকাকালীনই শুরু হয় ক্রিকেট খেলার চর্চা।তখনও ক্রিকেট ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠেনি।

স্কুল পাশের পর,মনে জায়গা করতে থাকে ক্রিকেট। গভর্নমেন্ট কলেজে পড়ার সময় বিশ্বাস জন্মায় নিজের ওপর। এরপর সুযোগ আসতে দেরি হয়নি।

মুলতানে এক সিজনের পারফরমেন্স দেখেই হায়ার ডিভিশনে সুযোগ আসে। কিংবদন্তি হানিফ মোহাম্মদের জহুরির চোখ হীরে চিনতে ভুলতে করেনি। আজম ট্রফি তে দুরন্ত খেলার পরই উইলস কাপে প্রথম ম্যাচেই ছয় উইকেট নেন তিনি।

সুপার উইলস লাহোর বনাম পাঞ্জাব ম্যাচে মাঠে অসাধারণ পারফরমেন্স করায় টিভিতে খেলা দেখে গাড়ি চালিয়ে সোজা মাঠে এসেছিলেন স্বয়ং ইমরান খান।

‘তুমি আমাদের সাথে শারজাহ যাচ্ছ।’ – দেশের অধিনায়কের কাছ থেকে শোনা এই কথাটাই তখন সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি দেশের হয়ে খেলতে চাওয়া মাত্র ছটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলা এক অখ্যাত ফাস্ট বোলারের।

১৬ নভেম্বর ১৯৮৯, তাঁর অভিষেকের সাথেই অভিষেক হয়েছিল আরও একজনের,যিনি ধর্ম রাজনীতি দুর্নীতির প্যাঁচে জড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের সব দু:খ কষ্ট সাময়িক ভাবে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন বাইশ গজের মধ্যে। তিনি শচীন টেন্ডুলকার।

সেই ম্যাচে চার উইকেট নিয়েছিলেন ওয়াকার। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ওয়াসিমের সাথে জুটি বেঁধে হয়ে উঠেছিলেন ত্রাস। অসম্ভব গতির জন্য নামই হয়ে গিয়েছিল বুরেওয়ালা এক্সপ্রেস।

উইকিপিডিয়া বলছে,নূন্যতম ১০০০০ ডেলিভারি করা বোলারদের মধ্যে স্ট্রাইক রেটে তিনি দ্বিতীয় সেরা। একমাত্র বোলার যিনি তিনটি টানা ওয়ানডে তে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন। ২৭ বার চার উইকেট ফাস্ট বোলিং এর একসময়ের রেকর্ড।

কিন্তু ওয়াসিমের মতন জনপ্রিয়তা কি পেলেন তিনি? অথচ যোগ্যতা পারফরমেন্স কোন অংশে কম ছিলেন না টো ব্রেকার। আইসিসি হল অফ ফেমে অকারণে জায়গা হয়নি তাঁর।

কিন্তু কখনও ব্যক্তিত্বের সংঘাত, কখনও বল বিকৃতির অভিযোগে সেই আসল ওয়াকারই হারিয়ে গেলেন। তবে ক্রিকেট প্রেমীদের মননে থাকবেই রিভার্স সুইং এর সেই পায়ের পাতা ভাঙা বিষাক্ত দুরন্ত গতির ইয়র্কারগুলো যা এনে দিয়েছে তাঁকে প্রায় আটশো উইকেট। ছোটবেলায় দুর্ঘটনায় হাতের একটি আঙুল হারিয়েছিলেন তিনি, তারপরেও থামেনি তাঁর জয়রথ, হয়ে উঠেছিলেন ব্যাটসম্যানদের দু:স্বপ্ন।

এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি বন্ধু হতে চান,হতে চান একজন ভালো মানুষ। লোকে তাঁকে মনে রাখুক এভাবেই।

ওয়াসিম শোয়েব সরফরাজ ইমরান আসিফ আমির ফজল মাহমুদ থাকবেনই, তবে পাকিস্তানের পেস ব্যাটারির বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে না ওয়াকারকে ছাড়া। সেটাই হয়ত টো ব্রেকারের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link