চাকদা টু লর্ডস: এক অপ্রতিরোধ্য অনুপ্রেরণা

চাকদা স্টেশনের ঠিক বাইরেই আমার একটা চায়ের দোকান আছে। ভোর ভোর দোকান খুলে ফেলি। পাঁচটার শিয়ালদহ লোকালটা ধরার জন্য অনেকেই সকাল সকাল পৌঁছে যায়। অত সকালে কেউ নিজেদের বাড়িতে চা বানায় না। আমার কাছেই আসে।

তা আপিস বাবুদের ভিড়ে একটি মেয়েকে হপ্তায় দিন তিনেক দেখতাম, কাঁধে ক্রিকেট কিটের মতো ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে ওই পাঁচটার গেদে শিয়ালদাহ লোকালটা ধরতো। মেয়েটি বেশ লম্বা। চাপা গায়ের রং। একরকম চিনেই গিয়েছিলাম।

যেমন চিনতাম চাকদা-শিয়ালদহ লাইনে যাতায়াত করা প্রায় সব আপিস বাবুকেই। সালটা বোধহয় ২০০২। শীতকাল। দোকান সামলে আর সংসার চালিয়ে আর অন্যান্য খবর খুব একটা রাখতে পারতাম না। রোববার করে আমার দোকানে কিছু লোক আড্ডা মারতে আসতো। তাতেই যা একটু খোঁজ খবর পেতাম।

তাদের কাছেই শুনে শুনে, বাজপেয়ী, বুদ্ধবাবু, সি.পি.এম, সাদ্দাম হোসেন, রোনালদো, সৌরভ, এসবই একটু আধটু জেনেছিলাম। তা এরকমই এক রোববার সকালে অনেকে আড্ডা দিতে এসে এই চাকদারই মেয়ের ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়া নিয়ে আলোচনা করছিলো। লালপুরের গোস্বামী বাড়ির মেয়ে, ঝুলন নাকি ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে।

ফ্রেন্ডস ক্লাবের মাঠে ছেলেদের সাথে টেনিস বল পেটাতো। আমি তো জানতামই না মেয়েদেরও ক্রিকেট দল আছে। আবার শুনলাম, মেয়েটা নাকি পাঁচটার শিয়ালদহ লোকালটা ধরে হপ্তায় তিন দিন করে কলকাতায় প্র্যাকটিস করতে যেত। শুনেই বুঝে গিয়েছিলাম, ওই লম্বা করে মেয়েটাই ঝুলন।

সেই বছরই আমার দোকানটা একটু বড় করে সাজালাম। একটা টিভি লাগালাম দোকানে। বেঞ্চি বাড়ালাম। আড্ডার বহর বাড়তে লাগলো। খেলা-টেলা থাকলে তো কথাই নেই। সব জড়ো হয়ে আমার দোকানেই খেলা দেখতো। সাথে চা-বিস্কুট।

এর বছর তিনেক পরে শুনলাম ওই লালপুরের ঝুলন বলে মেয়েটা নাকি মেয়েদের বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে নামছে। মনে আছে সেই দিন অনেকে মিলে খেলা দেখেছিলাম। একটা মেম-সাহেব, কি রলটন যেন নাম, সে একাই হারিয়ে দিলো আমাদের। দু:খ পেয়েছিলাম।

কিন্তু, সংসারের চাপে সব ভুলেই গিয়েছিলাম। এর বছর দুয়েক পর, এক ভরা বর্ষার দিনে, টিভির খবরে জানলাম, আমাদের চাকদার মেয়েটা নাকি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েছে। ভারতের ক্যাপ্টেনও হয়েছে শুনলাম। এসব শুনে মাঝে মধ্যে ভাবতাম, মেয়েটা যখন সেই লোকাল ট্রেনে চেপে প্র্যাকটিসে যেত, আমি রোজ দেখতাম ওকে।

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২। আমার চায়ের দোকানটা এখনও আছে। এখন আড্ডা হয় কম। বিক্রিও পড়তির দিকে। আমার ছেলে সরকারি চাকরি করে। আমার সংসারে অভাব নেই। তবুও দোকানে এসে রোজ না বসলে ঠিক ভাত হজম হয় না। দোকানের টিভি এখনও চলে। আমি একাই দেখি বসে বসে।

দেখলাম, ওই লালপুরের মেয়েটাকে সবাই কাঁধে তুলে নিয়েছে। মেয়েটার মুখটা আমার মনে এতো ভালো করে বসে গিয়েছে, সেই শিয়ালদহ লোকালের দিন গুলো থেকে! কেমন যেন নিজের মেয়ের মতো মনে হয়। খবর নিয়ে জানলাম, শেষবারের মতো মাঠে দেখতে পাওয়া গেলো ওকে। অবসরে চলে যাচ্ছে ও। একটু যেন ভিজে গেলো চোখের কোলটা।

মনে পড়ে যাচ্ছে সেই ধোঁয়া ওঠা ভোরবেলা গুলোতে ভারি কিট ব্যাগ নিয়ে দৌড়তে দেখতাম মেয়েটাকে। আমার নাতনি টাও খুব ক্রিকেট পাগল। আমার ছেলে ওকে চাকদাতেই একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছে।

ভাবছি, গোস্বামী বাড়ির ঝুলনকে একবার চিঠি লিখবো। ওর সাথে দেখা করবো। ওকে একটাই কথা বলবো, ‘মা, তুমি সেদিন ভোর বেলা ভারি ব্যাগটা নিয়ে লোকাল টা ধরতে, তাই আজ আমার ক্রিকেট পাগল নাতনিটা সাইকেল করে ক্রিকেট প্র্যাকটিসে যেতে পারে। ভালো থেকো।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link