ফ্লিপার মাস্টার – ক্ল্যারি গ্রিমেট

কিংবদন্তি স্পিনার বিল ওরিলির মতে, ‘তিনি প্রতিবেশি দেশের কাছ থেকে পাওয়া সেরা বড়দিনের উপহার।’

কারণ যীশু খ্রীষ্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন ২৫ ডিসেম্বর। নিউজিল্যান্ডের বুকে জন্মেছিলেন ওই একই তারিখে ক্রিকেটের এক বিস্ময় ক্ল্যারি গ্রিমেট। ফাস্ট বোলার হিসেবে শুরু করলেও তিনি বিদ্যালয় শিক্ষকের পরামর্শে হয়ে যান লেগ স্পিন বোলার।

১৭ বছরে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। তারপর ভিক্টোরিয়ার এক মেয়েকে বিয়ে করার পর ১৯১৪ সালে চলে আসেন অস্ট্রেলিয়ায়। প্রথমে সিডনিতে খেলা শুরু করা। তারপর দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ায় স্থানান্তর। সেখানেই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা এবং অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব লাভ। এই সময়েই লেগ স্পিন বোলিং নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং মন্ত্রগুপ্তি লাভ – সে মন্ত্রগুপ্তি আর কিছুই নয় লেগ স্পিনারের এক অমোঘ অস্ত্র ফ্লিপারের উদ্ভাবন।

তারপর দীর্ঘ অপেক্ষার পর এলো সে মাহেন্দ্রক্ষণ। টেস্ট ক্রিকেটে প্রবেশের পথ খুললো তাঁর। ৩৩ বছর তখন তাঁর বয়স। ১৯২৪-২৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে এসেছিল ইংল্যান্ড। পঞ্চম টেস্টে সিডনিতে অভিষেক ঘটলো তাঁর। তারপর, ছাইয়ের যুদ্ধে তাঁর অস্ত্রের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো – হবস, হেনড্রেন, হ্যামন্ড, উইলি সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইন আপ।

দু’ইনিংসে ইংল্যান্ড মাত্র ১৬৭ আর ১৪৬ রানে অল আউট হয়ে গেল। প্রথম ইনিংসে ৪৫ রানে ৫ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৩৭ রানে ৬ উইকেট নিলেন ক্লারি গ্রিমেট। ৩০৭ রানে হারলো ইংল্যান্ড। ম্যাজিক স্পিনার প্রথম সুযোগেই বাজিমাত করলেন।

যে নিয়ন্ত্রণ দুরন্ত লেগ স্পিন-গুগলি বোলার আর্থার মেইলির ছিল না সেই অবিশ্বাস্য নিয়ন্ত্রণ দেখা গেল গ্রিমেটের বোলিংয়ে। তিনি শর্ট বা লং হপ বল করেন না। নো বল নেই। বড় টার্নার নন কিন্তু সীমাহীন বৈচিত্র্য । লেগস্পিন, গুগলি, টপস্পিন এর সাথে এক অজানা অস্ত্র – সেটা তাঁর নিজস্ব।

ছোট্ট চেহারার বোলার দ্রুত ওভার শেষ করেন। ৯০ সেকেণ্ডে তাঁর ওভার শেষ। তো, এমন আক্রমণে ব্যাটসম্যান দিশেহারা হবেন এ তো স্বাভাবিক।  ভীষণ কৃপণ অথচ আক্রমণাত্মক বোলার হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়লো তাঁর।

১৯২৬ সালে ইংল্যাণ্ডে অ্যাশেজ সিরিজেও তাঁর সাফল্য বজায় রইলো। লীডসে প্রথম  ইনিংসে ৫ উইকেট সহ ৭ উইকেট তুললেন ম্যাচে।  সেবার তিন টেস্টে খেলার সুযোগ পান। বৃষ্টিবিঘ্নিত সফরে  বল করার সুযোগের অভাব থাকলেও নেন ১৩ উইকেট।  ০-১ ব্যবধানে সিরিজ হারে অস্ট্রেলিয়া।

এরপর সেই  সিরিজ। ১৯২৮-২৯ সালে সীমাহীন শক্তিশালী ইংল্যান্ড দল এলো অস্ট্রেলিয়ায়। দারুণ তাদের  ব্যাটিং আর বোলিং। হবস, হেনড্রেন, সাটক্লিফ, হ্যামণ্ড,জার্ডিন,  অ্যামেস, লারউড, টেট, হোয়াইট সমৃদ্ধ দল।  ৫ টেস্টের  সিরিজে হ্যামণ্ড  তুললেন ৯০৪ রান, হবস, হেনড্রেনও ৪০০ এর বেশি রান করলেন। ১-৪ ফলে সিরিজ হারলো অস্ট্রেলিয়া।

ব্যাটিং কিংবদন্তীদের আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েও অতুলনীয় বল করলেন গ্রিমেট। ২৩ উইকেট নিলেন সিরিজে। ব্রিসবেনে ৯ উইকেটও নিলেন। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে তাঁর পাশে বড় ভূমিকা নিতে পারেননি মেইলি, গ্রেগোরীরা।

১৯২৮-২৯ সালের সিরিজে অস্ট্রেলিয়া দলে এসেছিলেন ব্যাটিংয়ের দেবতা ডন ব্র্যাডম্যান। ১৯৩০ সালের ইংল্যাণ্ড সফরে তার সূর্যসম প্রতিভার প্রকাশ দেখা গেল। সারা সিরিজে ৯৭৪ রান করলেন ডন। আর বোর্ডে বড় রান পেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন গ্রিমেট।

প্রথম টেস্ট টেণ্টব্রিজে  প্রথম ইনিংসে ১০৭ রানে ৫ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৯৪ রানে ৫ উইকেট নিলেন গ্রিমেট। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ৯৩ রানে হারলো এ টেস্টে। লর্ডসে পরের টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৩ ওভার বল করে ১৬৭ রানে ৬ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে জেতালেন গ্রিমেট।

লীডসে পরের টেস্টে এক ইনিংসে ১৩৫ রানে ৬ উইকেট এলো তার ঝুলিতে। ৫৬ ওভার বল করেছিলেন। এ টেস্ট ড্র হলো। শেষ টেস্ট ইনিংস ও ৩৯ রানে জিতলো অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ইনিংসে ৬৬ ওভার বল করে ১৩৫ রানে ৪ উইকেট নিলেন গ্রিমেট। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতলো ২-১ ফলে। গ্রিমেট নিলেন ২৯ উইকেট।

১৯৩০ সালে দুর্বল নবাগত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধেও ৫ টেস্ট খেলেন গ্রিমেট। তাদের পক্ষে গ্রিমেটের স্পিন জাদুর পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নি। ১৯৩১ সালে আর এক নবাগত দক্ষিণ আফ্রিকাও গ্রিমেটের স্পিন ম্যাজিকে মোহাবিষ্ট হয়ে তাঁর ঝুলিতে একরাশ উইকেট দিয়ে যায়।

এরপর ১৯৩২-৩৩ সালের কুখ্যাত বডিলাইন সিরিজ। গ্রিমেট বিপর্যস্ত অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সে সিরিজে ছন্দ পান নি। তিনটে টেস্ট খেলেন। এই সিরিজটিই তাঁর বোলিং ব্যর্থতার একমাত্র  প্রদর্শন। কিন্তু  নতুন লেগ স্পিন বিস্ময় বিল  ওরিলি সে সিরিজে পর্যাপ্ত উইকেট নিয়েছেন।

১৯৩৪ সালে লেগ স্পিনের কিংবদন্তী বিল ওরিলির সাথে গ্রিমেটের জুটি ইংল্যাণ্ড সফরে দারুণ কার্যকরী হয়। প্রথম টেস্টেই জেতে অস্ট্রেলিয়া। ট্রেন্টব্রিজে প্রথম ইনিংসে ৫৮.৩ ওভারে ৮১ রানে ৫ উইকেট নেন গ্রিমেট।

চতুর্থ টেস্টে লিডসে ম্যাচ ড্র হয়। কিন্তু গ্রিমেট প্রথম ইনিংসে নেন ৫৭ রানে ৪ উইকেট। বল করেন ৩০.৪ ওভার। দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ৭২ রানে ৩ উইকেট। বল করেন ৫৬.৫ ওভার।

পঞ্চম টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জেতে। জেতে ৫৬২ রানের বিরাট ব্যবধানে। আর সে টেস্টেও এক ইনিংসে ২৬.৩ ওভার বল করে ৬৪ রানে ৫ উইকেট নেন গ্রিমেট।  সিরিজ অস্ট্রেলিয়া ২-১ ব্যবধানে জেতে। ২৫ উইকেট নেন গ্রিমেট। ওরিলি নেন ২৯ উইকেট।

এরপর ১৯৩৬ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর। এ সিরিজে গ্রিমেট দুর্বল দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজে নেন ৪৪ উইকেট। পাঁচটি ইনিংসে ৫ পাঁচ উইকেট দখল করেন তিনি। পঞ্চম ও শেষ টেস্ট ছিল ডারবানে। সে টেস্টে প্রথম ইনিংসে ৪৮ ওভারে ৭৩ রানে ৬ উইকেট নেন গ্রিমেট। আর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ৪৫ ওভারে ১০০ রানে ৭ উইকেট।

সেই সেরা প্রদর্শনের পর ডন ব্র্যাডম্যানের ইচ্ছায় দল থেকে বাদ পড়লেন কিংবদন্তী স্পিনার ক্লারি গ্রিমেট। অজুহাত দেওয়া হলো তাঁর বয়স হয়েছে। নতুনদের সুযোগ দিতে হবে। ১৯৩৬ সালে অ্যাশেজ সিরিজে তাঁর জায়গায় যাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তিনি ৪ টেস্টে পান ১১ উইকেট। কিন্তু ডনের ইচ্ছা বলে কথা। তার প্রতিবাদ কে করবে?

৪৪ বছর বয়সে ম্যাজিক স্পিনারের আন্তর্জাতিক জীবন যখন শেষ হল তিনি তখন অনেকগুলি কীর্তি করে ফেলেছেন।

  • প্রথম বোলার হিসাবে ২০০ উইকেট।
  • দ্রুততম ২০০ উইকেট। (৮২ বছর পরে এ রেকর্ড ভাঙেন ইয়াসির শাহ)
  • জীবনের প্রথম ও শেষ টেস্টে দশ উইকেটের বেশি লাভ।
  • জীবনের প্রথম টেস্টে দু’ইনিংসে ৫ উইকেট এবং জীবনের শেষ টেস্টে দু’ ইনিংসে ৫ উইকেট।
  • ৩০ বছরের পরে শুরু করে একশোর বেশি উইকেট পাওয়া। (তিনিই প্রথম। পরে দিলীপ দোশিও করেন)
  • এক সিরিজে ৪৪ উইকেট লাভ। (বার্নেসের ৪৯ এর পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ)। অ্যাশজ সিরিজে ১০০ উইকেট লাভ।
  • ইংল্যান্ডের মাঠে ৫০-এর বেশি উইকেট লাভ।

ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে ১০৫ উইকেট নেন গ্রিমেট। ২২ টেস্ট খেলে। ইনিংস পিছু প্রায়  ৫ উইকেট। সাফল্য কিছুটা কম হলেও তাঁর সময়েই ইংল্যাণ্ড ব্যাটিং শ্রেষ্ঠতম ছিল। তাঁর যুগে প্রভুত্ব করেছেন হ্যামন্ড হবস, সাটক্লিফ, উইলি, হেনড্রেন, অ্যামেস – সকলে ব্যাটিং গ্রেট। কিন্তু বোলিং গড় দেখলেই বোঝা যায় কেউ তাঁর উপর প্রভুত্ব করতে পারেন নি। কারণ অসামান্য নিয়ন্ত্রণ ছিলো গ্রিমেটের।

তবে নিজ উদ্ভাবিত ফ্লিপার নিয়ে একসময় তাঁর মোহ এমন জায়গায় পৌঁছেছিল যে ওভারে ৩/৪ টি ফ্লিপারও তিনি দিতেন। ডন ব্র্যাডম্যান তো একবার বলেছিলেন লেগ স্পিন করতে নাকি ভুলে গেছেন। কথাটা হয়তো সত্য নয়। কিন্তু ফ্লিপারের জনক তাঁর ব্রহ্মাস্ত্র বেশী ব্যবহার করবেন এ তো স্বাভাবিক। বৈচিত্র্য তা বলে তাঁর কমেনি। তাঁর সাফল্যই সে প্রমাণ দেয়।

আর তাঁকে নিয়ে ডনের অপপ্রচারের জবাব তিনি দিয়েছিলেন একটি অসাধারণ লেগস্পিনে ডনকে বোল্ড করে। ওয়ার্নের বহু পূর্বেই গ্যাটিংকে বোল্ড করার সেই বলের মতো লেগ স্টাম্পে পিচ ফেলে বল ঘুরিয়ে তিনি ডনের অফ স্টাম্পের বেল ছিটকে দেন। সেটা অবশ্য বল অফ দ্য সেঞ্চুরী নামে প্রচার পায় নি।

ডন ব্র্যাডম্যান ক্লারি গ্রিমেটের মুখোমুখি হয়েছেন ১৫ টি ম্যাচে। ২৭ ইনিংসে তিনি ১০ বার আউট হন গ্রিমেটের বলে। আর তাঁর গড় গ্রিমেটের বিরুদ্ধে  ৬৩। সুতরাং  ক্লারি গ্রিমেট কত বড় মাপের বোলার ছিলেন ডনের বিরুদ্ধে তাঁর সাফল্যই সে প্রমাণ দেয়।

আজ সেরা লেগ স্পিনারের তালিকায় দেখি অনেকে তাঁকে বাদ দিয়ে দিচ্ছেন। কারণটা কী বুঝে ওঠা অসম্ভব। ফ্লিপারের জনক যদি সঠিক সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসতেন তাহলে তাঁর পরিসংখ্যান কী হত তা কল্পনার বাইরে। প্রথম ৩০০ বা প্রথম ৪০০ উইকেট বোধহয় তাঁর দখলেই থাকতো।

এবার তাঁকে নিয়ে একটা মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করবো। ১৯২৬ সালের ইংল্যান্ড সফরে তাঁর উপরে দলের অধিনায়ক একবার ক্ষেপে গিয়েছিলেন। কারণ, অন্যপ্রান্তের বোলার বল করা শেষ করে সোয়েটার পরার আগেই তিনি বল করতে এসে ওভার শেষ করে ফেলছিলেন (৯০ সেকেন্ড)।

ক্যাপ্টেন তখন তাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘এ কি!  তোমার এতো তাড়া কিসের হে! বোলারকে সোয়েটারটাও তো এই শীতে পরতে দেওয়ার সময় দিতে হবে নাকি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link