জিম করবেটের বাঘের গল্প তো সবাই জানে। জানে, কিভাবে একটি আহত বাঘ হিংস্রতার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ প্রদর্শন করতে পারে। এই মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের ম্যাচগুলো দেখলে বলা যায়, পিছিয়ে পড়া রিয়াল মাদ্রিদ আহত বাঘের মতই। এমনিতে রিয়াল মাদ্রিদ দলটি কাগজে-কলমে খুব একটা বড় দল নয়। কিন্তু যখনই গোলের হিসেবে পিছিয়ে পড়ে রিয়াল মাদ্রিদ, তখনই যেন আসুরিক শক্তি ভর করে সাদা জার্সি পরা এগারোজনের ওপর।
ফুটবল মাঠের আহত বাঘ রিয়াল মাদ্রিদ চলতি মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ইতোমধ্যে প্যারিস সেন্ট জার্মেই, চেলসির মত দলকে বধ করেছে, লা লিগাতেও অনেকবারই পিছিয়ে থেকেও শেষ হাসি হাসতে পেরেছে৷ আর লস ব্ল্যাঙ্কোসদের শিকারের তালিকায় এবার নতুন সংযোজন ম্যানচেস্টার সিটি।
ম্যানচেস্টার সিটি’র বিপক্ষে সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ইতিহাদ স্টেডিয়ামে মাঠে নেমেছিল স্প্যানিশ ক্লাবটি। সাত গোলের ধ্রুপদী সেই লড়াইয়ে অবশ্য হেরেছিল তারা। ম্যাচের স্কোরলাইন নয়, বরং গোল খাওয়ার ধরনই বেশি হতাশ করেছিল ভক্তদের। তবু পরিচিত সেই সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে দ্বিতীয় লেগ, আশা ভরসায় একটু একটু করে সম্ভবনার অংক কষেছিলো আনাচে-কানাচে থাকা সব রিয়াল ভক্তগণ।
কিন্তু তাদের আশা ভরাসায় ছাই ঠেলে দিয়ে ম্যাচের ৭৩ মিনিটের মাথায় রিয়াদ মাহরেজের গোল। বার্নান্দো সিলভার দুর্দান্ত এক ডিফেন্স চেরা পাসে রিয়াল ভক্তদের হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করেন মাহরেজ। দুই লেগ মিলিয়ে তখন ৫-৩ গোলে এগিয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের টেবিল টপাররা।
টিক টিক করে এগিয়ে যাচ্ছিলো ঘড়ির কাঁটা, তখন ইতোমধ্যে ম্যাচের বয়স পেরিয়ে গিয়েছে ৮০ মিনিট, নব্বই তখন ছুঁই ছুঁই। গ্যালারির অনেক ভক্তই তখন মাঠ ছাড়তে শুরু করেছেন। তখনই হঠাৎ করে রিয়াল মাদ্রিদের হিংস্রতম রূপ জেগে উঠেছিল। রিয়ালের সাবস্টিটিউট ফুটবলার রদ্রিগো সিলভার দুই মিনিটের ঝড়ে রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যায় ফুটবল বিশ্ব।
নব্বই মিনিটের সময় মাঠের ডান প্রান্ত থেকে বক্সের ভেতর কামাভিঙ্গার ক্রস খুঁজে নিয়েছিল করিম বেনজেমাকে। দুর্দান্ত ভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বেনজেমা বল বাড়িয়ে দেন রদ্রিগোর দিকে। পায়ের আলতো টোকায় সিটি গোলরক্ষককে বোকা বানাতে ভুল হয়নি তাঁর।
ম্যাচে সমতা থাকলেও গোল ব্যবধানে তখন এগিয়ে ছিল সফরকারীরা। তবে আশার ঝলক দেখার পরে হঠাৎ জেগে ওঠা বার্নাব্যুয়ের উত্তাপ সহ্য হয়নি সিটিজেনদের। পরের মিনিটেই আবারো ডান দিকে কারভাহালের ক্রস অ্যাসেনসিওয়ের মাথা ছুঁয়ে এসেছিল রদ্রিগোর কাছে। পারফেক্ট প্লেসিং হেডারে রিয়ালকে একেবারে ফ্রন্টফুটে নিয়ে আসেন ব্রাজিলিয়ান ইয়াংস্টার।
সেমিফাইনালের টাইয়ে সমতা, ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ের শুরুতেই আবার ভুল করে বসেন সিটি অধিনায়ক রুবেন দিয়াস। নিজেদের ডি-বক্সে ফাউল করে বসেন তিনি। পুরো ম্যাচে কিছুটা ছায়া হয়ে থাকা বেনজেমা ইতিহাদের মত বার্নাব্যুতেও পেনাল্টি থেকে ঠাণ্ডা মাথায় গোল করেন।
ম্যাচের স্কোরলাইন রিয়াল ৩-১ সিটি। দুই লেগ মিলিয়ে রিয়াল ৬-৫ সিটি। এগারো গোলের ধ্রুপদী এই লড়াইয়ে প্রথমবারের মত লিড পায় লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। লড়াকু মানসিকতার খেলোয়াড়দের জন্য একবারের লিডই অবশ্য যথেষ্ট। ম্যাচের বাকি সময় লিড ধরে রাখে মিলিটাও-নাচোরা। ম্যাচের পুরোটা সময় জুড়ে বারবার ফিল ফোডেন, বার্নান্দো সিলভাদের সামলেছিল মাদ্রিদ ডিফেন্ডাররা।
রিয়ালকে আহত বাঘ বলার কারণটা এই ম্যাচে আবারো প্রমাণ করেছে তাঁরা, ম্যাচ শুরুর আগেই এক গোলে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও প্রথম সত্তর মিনিট কিছুই করতে পারে নি তারা। কিন্তু একটি গোল হজম করতেই বদলে যায় দৃশ্যপট। বদলে যাওয়া ম্যাচের মোড় আর ঘোরেনি পেপ গার্দিওলার দিকে।
শেষ বাশি বাজার সাথে সাথে রিয়াল মাদ্রিদ আর ভক্তদের জয়োল্লাস তখন স্বাভাবিক বটে। রিয়াল মাদ্রিদ আরো একবার পৌঁছে গিয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে। রাউন্ড অব সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনাল তিনটি রাউন্ডেই ম্যাচ হেরেও ফাইনালে ওঠা একমাত্র দল রিয়াল মাদ্রিদ।
দলটির ডাগআউটে থাকা কার্লো আনচেলত্তি ট্যাকটিক্সের দিক থেকে আহামরি কেউ নন। তিনি মাঠেও তেমন কোন ব্যস্ততা দেখান না। তবু তাঁর মন্ত্রে বদলে যায় দল, বদলে যায় ম্যাচ ভাগ্য। প্রথম ম্যানেজার হিসেবে এই ইতালিয়ান রেকর্ড পঞ্চমবারের মত চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে খেলতে যাচ্ছেন এবার।
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে যদি ধরা হয় রূপকথার বই, তবে নিঃসন্দেহে ফিনিক্স পাখির ভূমিকায় থাকবে রিয়াল মাদ্রিদ। ফিনিক্স পাখি যেমন বারবার ধ্বংসস্তুপ থেকে ফিরে আসে, ডানা মেলে মুক্ত আকাশে; তেমন করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বারবার পিছিয়ে থেকেও ঘুরে দাঁড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ।
শুধু লুকা মদ্রিচের টুইটারের অ্যাকাউন্টে নয়, রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিটি খেলোয়াড়ের শিরা উপশিরাতে রয়েছে একটি লাইন, Giving up is not an option. মাদ্রিদের রয়্যাল ক্লাবটির ইতিহাস-ও সবসময় জানান দেয়, Giving up is never an option!