কামঅন সাক্কিইইইই!

একদিনের ম্যাচে বরং পাকিস্তান তাঁকে অনেক ভালোভাবে ব্যবহার করেছে। তাঁর বল আর উইকেটরক্ষক মঈন খানের কট বিহাইন্ড/স্ট্যাম্পিংয়ের ‘কামঅন সাক্কিইইইই’-এর আওয়াজ তখন তাবর তাবর ব্যাটারের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল।

অফ স্পিনার – শব্দটা শুনলেই একশ্রেণীর ক্রিকেটভক্তদের মধ্যে একটা নাক সিঁটকানোর ভাব লক্ষ্য করা হত একটা সময় পর্যন্ত। এখনও হয় না কি!

সময়টা মোটামুটি নব্বইয়ের দশক। টিম সিলেকশনগুলো তখনও মূলত করা হত টেস্ট সিরিজের কথা বিবেচনা করেই। সীমিত ওভারের ক্রিকেট বলতে শুধুই ৫০ ওভারের ম্যাচ। সেখানে ৩০০ বলে ২৫০-এর ওপর করা মানে তখনও জেতা নিশ্চিত।

২০ ওভারে ২০০ রান জয়াসুরিয়াদের সময়ও ছিল কষ্টকল্পনা। এই পরিস্থিতিতে একজন ভালমানের লেগস্পিনার আর অফস্পিনারের মধ্যে বাছতে বললে অফ স্পিনারের কপালে শিকে খুব কমই ছিঁড়ত। বাঁ-হাতি চায়নাম্যান বা অর্থোডক্স স্পিনারদের তো বাদই দিলাম। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিলেন (অনেকক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায়)। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার প্যাট সিমকক্স, নিকি বোয়ে, পল অ্যাডামস, নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্টোরি।

সেই দিনকালে দাঁড়িয়ে অফ স্পিনারদের পালে প্রথম হাওয়া টানা শুরু করেন শ্রীলঙ্কার মুত্তিয়া মুরালিধরন। চাকিং বিতর্কের পরও মুরালি যে মনের জোর আর দক্ষতা দেখিয়ে তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বিশ্বের সর্বোচ্চ টেস্ট উইকেট শিকারী হয়েছেন, তা অতুলনীয়। কিন্তু আমার এই লেখা তাঁকে নিয়ে নয়। আরো একজন এশিয়ান অফ স্পিনারের কথা এখানে বলব, যিনি একদা বিশ্ব সেরাদের মধ্যে বিবেচিত হলেও তাঁর ক্যারিয়ার ততোটাও দীর্ঘায়িত হল না, যতটা প্রত্যাশিত ছিল।

তিনি সাকলাইন মুশতাক। পাকিস্তানের ৯০ দশকের টিমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কি টেস্ট আর কি ওয়ানডে, দলের বিপদে যখনই বল তুলে দেওয়া হয়েছে তাঁর হাতে, তিনি নিরাশ করেননি। কত ক্লোজ় ম্যাচ পাকিস্তান বার করেছে শেষদিকে সাকলাইনের ঠাণ্ডা মাথায় বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং এর জেরে। অর্থোডক্স অফব্রেক ছাড়াও নিজ আবিষ্কৃত ‘দুসরা’তে (যা একই গ্রিপে উল্টোদিকে টার্ন করে) ছিল সাকলাইনের অবিশ্বাস্য মুন্সিয়ানা।

দুসরার আবিষ্কার ও প্রয়োগ নিয়ে জনমানসে মুরালি ও হরভজন নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও এটা সত্যি যে সাকলাইনই প্রথম এই ডেলিভারিটি আন্তর্জাতিক আঙিনায় সফলভাবে প্রয়োগ করেন। তাঁর সতীর্থদের মধ্যে অনেকেই নেটে এই ব্যাপারে সাকলাইনের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা উল্লেখ করেছেন। আর্মবল নামক ডেলিভারিটিও ছিল তাঁর তুণে লুকানো আরেকটি অস্ত্র।

সাকলাইন নিজের ১০ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে মাত্র ৪৯ টি টেস্ট খেলার সুযোগ পান। এর কারন তৎকালীন পাকিস্তান দলে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, আকিব জাভেদ, শোয়েব সম্বৃদ্ধ পেস ব্যাটারির দাপট, সঙ্গে মুশতাক আহমেদের মত লেগস্পিনারের উপস্থিতি। তাও সীমিত সুযোগেই নেন ২০৮ টি উইকেট, ২৯.৮ গড়ে। এর মধ্যে ম্যাচে ১০ উইকেট নেন তিন বার আর ইনিংসে ৫ উইকেট নেন ১৩ বার।  ব্যাটের হাতটিও খারাপ ছিল না সাকলাইনের, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে সেঞ্চুরি ছিল তাঁর। তাও তাদের দেশেই।

একদিনের ম্যাচে বরং পাকিস্তান তাঁকে অনেক ভালোভাবে ব্যবহার করেছে। তাঁর বল আর উইকেটরক্ষক মঈন খানের কট বিহাইন্ড/স্ট্যাম্পিংয়ের ‘কামঅন সাক্কিইইইই’-এর আওয়াজ তখন তাবর তাবর ব্যাটারের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। দেশের জার্সিতে তিনি ১৬৯ টি ম্যাচে পান ২৮৮ উইকেট, ২১.৭৯ গড় আর ৪.২৯ এর ইকোনমি রেটে।

ছয়টি ইনিংসে পান ৫ উইকেট, এর মধ্যে বিশ্বকাপে করেছিলেন স্পিনার হিসেবে একমাত্র হ্যাটট্রিক (একদিনের ম্যাচে তিনি ছাড়া একমাত্র হ্যাটট্রিক করা স্পিনার ভারতের কুলদীপ যাদব) । সাকলাইন হলেন একদিনের ম্যাচে স্পিনারদের মধ্যে দ্রততম ১০০, ১৫০, ২০০ আর ২৫০ উইকেটশিকারী। ব্যাটে টেস্টের মত সাফল্য না পেলেও ভারতের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাট করে সাকলাইন ওয়াকার ইউনিসের সাথে নবম উইকেটে জুটি বেধে একটা ম্যাচ বের করে নিয়ে যান ২০০০ সালের কার্লটন অ্যান্ড ইউনাইটেড ত্রিদেশীয় সিরিজ়ে। এরকম টুকটাক রান করেছেন বেশ কিছু ম্যাচে, লোকে হাততালি দিয়েছে। তারপর স্বাভাবিকভাবে ভুলেও গেছে তাড়াতাড়িই।

দুর্ভাগ্যজনক ভাবে চোটআঘাত, তৎকালীন তাঁর দলেই সেরা পেস আক্রমণের উপস্থিতি আর ভুল নেওয়া কিছু সিদ্ধান্ত সাকলাইনের কেরিয়ার সংক্ষিপ্ত করে দেয়। মুস্তাক আহমেদের পর কিছুদিন টেস্টে পাকিস্তানের একমাত্র স্পিনার রূপে বিবেচিত হলেও দ্রুতই তাঁর জায়গা নিয়ে নেন লেগস্পিনার দানিশ কানেরিয়া। ২০০৩ বিশ্বকাপের দলে থাকলেও সেভাবে সুযোগ পাননি সাকলাইন।

২০০৪ সালে নিজের শেষ টেস্টে তাঁর বোলিং গড় ছিল যাচ্ছেতাই। বীরেন্দ্র শেবাগের নেতৃত্বে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ কার্যত ছিনিমিনি খেলে সাকলাইন সমেত গোটা পাকিস্তান বোলিংকে নিয়ে। ইনিংসে ম্যাচ এবং সিরিজ হারে পাকিস্তান। দেশের মাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে এইরকম পারফরম্যান্স স্বাভাবিকভাবেই ভালভাবে নেয়নি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড, সাকলাইনের জন্য জাতীয় দলের দরজা চিরতরে বন্ধ করে দেন তাঁরা।

শেষ একদিনের ম্যাচেও খেলে ফেলেছেন তার আগের বছরেই। দেওয়ালের লিখন পড়তে ভুল করেননি চতুর স্পিনার। প্রথমে আইসিএল, তারপর ব্রিটিশ ললনার পাণি গ্রহনের পর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পেয়ে সাকলাইন চলে যান সেখানেই। মাঝে গুজবও রটেছিল যে তাঁর আর মুশতাক আহমেদের (তিনিও এখন ব্রিটিশ নাগরিক) হয়ত ইংল্যান্ড বা আয়ারল্যান্ডের হয়ে অভিষেক ঘটাতে পারেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে।

আদতে যাই ঘটুক, শেষ পর্যন্ত সেরকম কিছু হয়নি। বরং সাকলাইন মনোনিবেশ করেছেন কোচিং এ। সাসেক্সের হয়ে টনটনকে, তারপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলেরও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব সামলেছেন ২০১৪ সালে। ইংল্যাণ্ডের বোলিং কোচ ছিলেন ২০১৬ সালে। বর্তমানে পাকিস্তান দলের বোলিং কোচ সাকলাইন। এশিয়া কাপে দলের পেসাররা মার খেলেও বাঁ-হাতি স্পিনার নওয়াজ আর ডানহাতি লেগব্রেক বোলার শাদাব খান ইকোনমিক বোলিং করে চলেছেন, সঙ্গে উইকেটও তুলছেন নিয়মিত। ডাগআউটে বসে শিষ্যদের পারফরম্যান্সে তৃপ্ত সাকলাইনের হাসিমুখই বলে দিচ্ছিল অনেক কথা।

আগাগোড়া সুভদ্র, সুরসিক ও অসাম্প্রদায়িক সাকলাইনের কোচিং বাদে এখন সময় কাটে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় আর নিজের ইউটিউব চ্যানেলে টুকটাক ভিডিও করে। ভারত ও ভারতীয়দের প্রশংসায় সর্বদা অকুন্ঠ তিনি। নিজেই বলেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, কিন্তু কখনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে অসম্মান করেননি। এই প্রসঙ্গেই উল্লেখযোগ্য, সাকলাইনের দখলে আছে আরেকটি অসামান্য রেকর্ড। ভারতে খেলা নিজের একমাত্র টেস্ট সিরিজের দু’টি ম্যাচের চারটি ইনিংসে তিনি পেয়েছিলেন ২০ টি উইকেট, প্রতিটি ইনিংসে পান ৫ উইকেট।

সেরা ফর্মের শচীন টেন্ডুলকরের উইকেট পান ৩ বার। পাকিস্তান দারুণ লড়ে প্রথম টেস্ট জেতে শুধুমাত্র শেষদিকে সাকলাইনের বোলিং এ। দ্বিতীয় টেস্টে জিতে ভারত সিরিজ ড্র রাখতে সমর্থ হয় প্রধানত অনিল কুম্বলের ১০ উইকেটের সৌজন্যে। সাকলাইন পেয়েছিলেন ম্যান অব দ্য সিরিজের সম্মান।

তারপরও মিডিয়াতে বলা তাঁর কথাগুলো আজকালের বিদ্বেষী আবহাওয়ায় কেমন অবিশ্বাস্য লাগে, ‘আমি সামান্য বোলার, দল যেটুকু দায়িত্ব দিয়েছে সামলেছি। এই সম্মান আমার প্রাপ্য নয়। অনিল ভাই যা বোলিং করল তাতে স্পিনার হিসাবে আমাদের মাথা উঁচু হয়ে গেল। তাঁর জন্য আমি গর্বিত বোধ করছি। উপরওয়ালা ওনাকে আরও সাফল্য দিন এটাই প্রার্থনা করব।’

হরভজনের জন্যও ছিল তাঁর দরাজ প্রশংসা। খেলতে চেয়েছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে আরো ম্যাচ, কিন্তু সে সুযোগ জীবনের শেষ টেস্টের আগে আর হয়নি সাকলাইনের। ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ডের হয়ে খেলবেন কিনা, সেই বিতর্ক তখন তুঙ্গে। তারও আগের একটি ঘরোয়া সাক্ষাতকারে ১৯৯৮ সালে ঢাকার প্রায়ান্ধকার স্টেডিয়ামে তাঁর করা ফুলটস বলে হৃষিকেশ কানিতকারের চার মেরে ভারতের একদিনের ম্যাচে তৎকালীন সর্বোচ্চ রান তাড়া করে অবিশ্বাস্যভাবে জেতা প্রসঙ্গে সাকলাইনকে দুসরার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল।

সাকলাইনের সহাস্য উত্তর ছিল, ‘দুসরার কথা বাদ দিন। ওটা তো অনেকদিন যাবৎ চলছে। এখন আমি তিসরা আর চৌথা নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ সারের হয়ে খেলার সময়ই নাকি তিসরার প্রস্তুতি শুরু করেন সাকলাইন।

সাকলাইনের আঙুলে তিসরার প্রয়োগ আইসিএলে স্বল্প সময়ের জন্য দেখা গেলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দেখতে পেল না, চৌথা তো নয়ই। এখন অপেক্ষা ভবিষ্যতের। কে জানে, দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাঁর হাতে তৈরি কোন স্পিনারের আঙুল কখন না জানি ২২ গজে সেগুলোর ম্যাজিক দেখাতে শুরু করে!

কামঅন সাক্কিইইইই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link