ব্রাদার্স ইউনিয়নের গেটে সেদিন দারুণ শোরগোল।
কেউ গেট ঠেলে ঢুকতে চাইছে, কেউ টপকানোর চেষ্টা করছে। এক বৃদ্ধ এর ফাঁকে পথ খুজছেন ব্যাপারটা বোঝার জন্য।
ব্রাদার্স ইউনিয়নে তারকা খেলোয়াড় ইতিহাসে কম আসেনি। কিন্তু এমন ভিড় তো আগে দেখা যায়নি। ব্যাপারটা বোঝার জন্য পাশে দাড়িয়ে থাকা এক কিশোরকে ধরলেন বৃদ্ধ, ‘ভিতরে কী হইছে?’
কিশোর না ফিরেই বললো, ‘গুরু ক্রিকেট খেলে।’
‘গুরু মানে?’
‘গুরু মানে চেনে না! গুরু আজম খান।’
‘গায়ক আজম খান।’
‘জ্বি না। ক্রিকেটার আজম খান।’
হ্যা, বিশ্বাস করুন, তিনি ক্রিকেটার আজম খানও ছিলেন। তিনি পপগুরু আজম খান, তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খান, তিনি গনসঙ্গীতের আজম খান এবং তিনি ক্রিকেটার আজম খান।
বাংলাদেশের ইতিহাসে আইকন বলতে যা বোঝায়, আজম খান ছিলেন তাই। যৌবনে দেশের ডাক শুনেছেন। ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছেন, ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় এসে খালেদ মোশাররফের সেক্টরে ‘ক্লাক প্লাটুনের’ সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করেছেন। একসময় দেশ গড়ার জন্য গনসঙ্গীত করেছেন। সাংষ্কৃতিক বিপ্লব করতে পপ গানকে হাতিয়ার করে হয়ে উঠেছেন ‘গুরু’। এই হাজারো রূপের অসামান্য মানুষটার আরেকটা পরিচয় ছিলো ক্রিকেট প্রেমী; আরও ভালো করে বললে বলা যায় ক্রীড়াপ্রেমী।
আজম খানের ভাতিজা, সঙ্গীত পরিচালক আরমান খান এক কথায় বলছিলেন, ‘আজম খানের প্যাশন ছিলো স্পোর্টস। ক্রিকেটটাকে পাগলের মতো ভালোবাসতেন। তবে কেবল ক্রিকেট নয়, ফুটবল নিয়েও দারুন মাতামাতি ছিলো। এমনকি সাতারের মতো স্পোর্টস নিয়েও খুব উৎসাহী ছিলেন।’
আজম খানের খেলাধুলার প্রতি প্রেম যতদূর জানা গেলো একেবারে শৈশব থেকেই। জহির আব্বাস, হানিফ মোহাম্মদ, সুনীল গাভাস্কারদের দারুন ভক্ত ছিলেন। কমলাপুর এলাকার ছেলে আজম খান ছোটবেলা থেকে মহল্লায় মহল্লায় ক্রিকেট-ফুটবলের সাথেই বড় হয়ে উঠেছেন। আরমান খান জানালেন, তার বাবা এবং কিংবদন্তী গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আলম খানও একসময় ক্রিকেট খেলেছেন। আলম খান ও আজম খান একসাথেই খেলার প্রেমে মজেছিলেন।
ঢাকার পুরোনো বাসিন্দা, মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান জানতেন আজম খানের এই ক্রিকেট পাগলামি সম্পর্কে। অনুজ এই পপ গায়কের ক্রিকেট প্রেম নিয়ে বলতে গিয়ে রকিবুল হাসান বলছিলেন, ‘ও তো ক্রিকেট পাগল ছিলো। দেখা হলেই বলতো-বড় ভাই, বাংলাদেশ কিন্তু বড় দল হইবো। নিজে পাড়ায় মহল্লায় একসময় খেলেছে, একসময় বিভিন্ন জায়গায় ক্রিকেট ক্লাবের সাথে জড়িয়েছে, এমনকি বেশ বয়সে এসে মাঠে নেমে খেলেছেও। তার মতো একজন ব্যস্ত ও জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পীর জন্য এটা কঠিন একটা ব্যাপার ছিলো।’
আজম খানের এই ক্রিকেট প্রেম বস্তুগত রূপ পেলো নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। তখন তার নামে দেশের যে কোনো প্রান্তে মানুষের ঢল নামে। তাকে এক পলক দেখার জন্য মানুষ নিজের জীবন হাতে নেয়। সেই সময় তিনি নিজে একদিন হাজির হলেন গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবে।
কমলাপুরেই কয়েক জন তরুনের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিলো এই গোপীবাগ ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন। এলাকার সেলিব্রিটি আজম খান এখানে হাজির হয়ে বললেন, ‘আমি পোলাপাইনের ক্রিকেট খেলায় হেল্প করতে চাই।’
এই ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম (মিল্টন) বলছিলেন, ‘আমরা কল্পনা করিনি যে, ওনার মাপের একজন মানুষ ক্রিকেটের টানে এভাবে আমাদের সাথে এসে যোগ দেবেন। কিছুদিনের মধ্যে এটা ওনার যেনো নিজের ক্লাব হয়ে উঠলো। উনি সব করেছেন এই ক্লাবের জন্য। যা পারেন অর্থনৈতিক সাহায্য করেছেন, ছেলেদের যেভাবে পারেন উৎসাহ দিয়েছেন, ওদের সাথে কমলাপুর স্টেডিয়ামে বা অন্য মাঠে প্র্যাকটিস করতেন; এমনকি মাঠে নেমেও খেলেছেন ওই বয়সে। আমি বলি, এটা আজম খানের ক্লাব ছিলো।’
এই সময়ে আজম খানের ক্রিকেট প্রেমটা কাছ থেকে দেখেছেন গীতিকার ও প্রখ্যাত সাংবাদিক তানভীর তারেক। তিনি বলছিলেন আরেক মজার কথা। তানভীর তারেক স্মৃতিচারণ করছিলেন, ‘আমি আজম ভাইয়ের অন্তত ৭-৮টা বড় ইন্টারভিউ করেছি। বড় সাক্ষাতকার নিতে হলে কাছে যেতে হতো। একেবারে শেষ সাক্ষাতকারটা বাসায় বসে দিয়েছিলেন; তখন উনি অসুস্থ ছিলেন। এ ছাড়া সবসময় বলতেন-বিকেলে কমলাপুর স্টেডিয়ামে চলে আয়। আমরা গিয়ে দেখতাম, উনি প্র্যাকটিস করছেন বা বাচ্চাদের সাথে খেলছেন। হাতের ইশারায় বসতে বলে একটু পর এসে চানাচুর বাদাম হাতে নিয়ে কথা বলতেন। ওনার বিকেল মানেই খেলা।’
আম খান চাইলে হয়তো বড় বড় ক্রিকেটারদের সাথে সময় কাটাতে পারতেন। চাইলে বড় তারকাদের ভিড়ে মিশে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি খেলাটাকে বুক দিয়ে ভালোবেসেছেন। তাই ছোট ছোট ক্রিকেটারদের সাথে মিশে গেছেন। নাম না জানা সব ক্রিকেটারের সাথে মিলে অনুশীলন করেছেন, খেলেছেন এবং ভালোবেসে গেছেন।
এই আজমখানের খেলা পাগলামি খুব কাছ থেকে দেখেছেন আরমান খান। তিনি আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়লেন এই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে। বলছিলেন, ‘আমরা তো এক সময় জসীমউদ্দিন রোড (কমলাপুর) ছেড়ে মোহাম্মদপুর চলে এলাম। আমি প্রায়ই চাচাকে দেখতে যেতাম। গিয়ে বাসায় পেতাম না। কোথায়? শুনতাম ব্যাংক কলোনী বা কমলাপুর স্টেডিয়ামে গেছেন খেলতে। অপেক্ষা করতাম। একদিন এসে বললেন-শোনো, আইজকা ঢাকা স্টেডিয়ামে চাইর মাইরা আইলাম। আমি তো অবাক! উনি ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলতে নেমেছেন! হাসতে হাসতে বললেন, আকরাম-লিপুরা অবাক হইয়া চাইয়াছিলো; বলে, এটা ক্যামনে করলেন! আমি মাইরা দিছি আর কী!’
আরমান খান ছোটবেলার কথা মনে করতে পারেন। যখন বাবা ও চাচার হাত ধরে তিনিও ক্রিকেট খেলা শুরু করেছেন। আজম খান তাকে লেগব্রেক, গুগলি, অফব্রেক চেনাতেন। তবে আরমান আরেকটু বাড়তি তথ্য জানালেন, আজম খান ফুটবল নিয়েও দারুন পাগলামি করতেন।
গল্প করতে করতে আরমান বলছিলেন, ‘নব্বইয়ের ফাইনালের কথা আমার ভালো মনে আছে। চাচা এমনিতে আবাহনী আর আর্জেন্টিনার সাপোর্টার ছিলেন। সেদিন ফাইনালের সন্ধা থেকেই তার মন খারাপ। আমি বললাম, কী হয়েছে? আপনার দল ফাইনালে, আপনার মন খারাপ কেনো? উনি বললেন-শোনো, আমার মনে হইতাছে ম্যারাডোনার আইজ কান্দন লাগবো; ওরে খেলতে দিবো না। আর তেমন কিছু হইলে আমি সুইসাইড করমু। রাতে তো সেই ঘটনাই ঘটলো। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে পেনাল্টি হলো। আমি শুনি ওনার রুমে ধুপধাপ শব্দ। ভাবলাম, মাথা টাকাচ্ছেন। পরে সারাটা সময় ওনাকে পাহারা দিয়ে রেখেছি।’
ফুটবলের গল্প এখানেই শেষ নয়।
আরমান খান একদিন জসীমউদ্দিন রোডের বাসায় গিয়ে দেখেন পায়ে ব্যান্ডেজ করে শুয়ে আছেন। আরমান অবাক-কী, খেলতে গিয়ে ব্যাথা পেলেন? আজম খান মুখটা কালো করে বললেন, ‘আর বইলো না। স্বপ্ন দেখছি, জিকো আমারে বল পাস দিসে। আমি বল রিসিভ কইরা গোলের দিকে মারছি লাথি। ব্যাথায় ঘুম ভাইঙা দেখি মিটসেফে লাথি লাগছে। তারপর এই অবস্থা।’
হাসতে হাসতে আরমান খান অস্থির হয়ে যান। বলেন, ‘এই আমার চাচার খেলা নিয়ে পাগলামি।’
আজম খান কেবল পাগলামি করে শান্ত থাকেননি। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে অনেকেই আছেন খেলাপাগল, ক্রিকেট পাগল। তারা টিভিতে বা স্টেডিয়ামে খেলা দেখেন। কিন্তু আজম খান এই পাগলামিটাকে নিজের খেলা পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের খেলা থাকলে সেদিন আর কোনো কাজ না; শুধুই খেলা দেখা। দল হারলে কারো সাথে কথা নেই। জিতলে উৎসব। আরমান বলেন, ‘১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি আমরা এক জায়গায় বসে রেডিওতে শুনেছি। জেতার পর ওনার যে বাচ্চাদের মতো আনন্দ করা, সেটা ভোলা যাবে না।’
কাছের লোকেদের প্রায়ই বলতেন, ‘দেশটা স্বাধীন করেছি, একবার সেই দেশের জার্সিটা পরতে পারলে হতো।’
সব স্বপ্নপূরণ হয় না। কিছু মানুষ অন্যের স্বপ্ন পূরণ করে চলেন। আজম খান সেই মানুষদের একজন। আমাদের একটা স্বাধীন দেশ এনে দেওয়ার জন্য লড়াই করেছেন। সেই দেশটাকে সমৃদ্ধ করতেও লড়েছেন। শেষ অবধি দেশের খেলাধুলার জন্যও প্রানাতিপাত করেছেন।
এই মানুষটার নাম তাই কেবল পপগুরুতে আটকে রাখার উপায় নেই। তিনি যে ক্রিকেটেরও গুরু।