১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ফিলিস্তিনিদের হাতে ইসরায়েলি খেলোয়াড়েরা নিহত হলে খেলার মাঠ হয়ে ওঠে খোদ রাজনীতির মাঠ। এই রাজনীতির কারণে আফ্রিকায় শুরু হয় ভয়ংকর বর্ণবাদের আক্রমণ যার কারণে তাদের ক্রিকেট ছিল অনেকদিন বন্ধ। স্নায়ু যুদ্ধের সময় খেলা হয়ে গিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী বিশ্বের পরস্পর দ্বন্দ্ব প্রদর্শনীর ক্ষেত্র।
আর এই খেলাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের যুদ্ধেরও ইতিহাস আছে। ১৯৬৯ সালে হন্ডুরাস আর এল সালভাদরের মাঝে যুদ্ধ হয়েছিল একটা ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে৷ ইতিহাসে সে যুদ্ধ ‘১০০ ঘন্টার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত ৷ বিখ্যাত এশেজে মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া আর সেটিও কিন্তু পরস্পর জাতিগত মর্যাদার লড়াইয়ে খেলে। অর্থাৎ, আপনি দিনের শেষে খেলা থেকে রাজনীতিকে কোনো ভাবেই আলাদা করতে পারবেন না।
স্পোর্টস ডিপ্লোম্যাসি এমন এক জিনিস যেটার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক খেলার রাজনৈতিক ব্যবহারও ঘটে ৷ দুই দেশ যখন খেলার মঞ্চে মুখোমুখি হয় তখন খেলাটা স্রেফ দর্শকদের আনন্দের খোরাকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।। হয়ে ওঠে দুই দেশের সম্মানের ক্ষেত্র, হয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদ চর্চার চরম এক ক্ষেত্র।
ঔপনিবেশিক কাল থেকে খেলা যে একটি জাতির পরিচয় নির্মাণের হাতিয়ার হয়ে আসছে সেটির মোক্ষম এক উদাহরণ ভারতীয় ‘লগান’ ছবিটা। ফুটবল বিশ্বকাপ – দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে মাঠে ৯০ মিনিটে দুই দেশের ফুটবল চর্চার বাইরেও স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ফুটে ওঠে দুই দেশের জাতিগত বিদ্বেষ। আর ক্রিকেটে উপমহাদেশে এই জিনিসটা চলে গিয়েছে অন্য এক পর্যায়ে।
বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচে স্ট্যান্ডে বাংলাদেশি দর্শকরা ‘ম্যারি মি আফ্রিদি’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে নাচানাচি করেছে কিছু কাল আগেও। আর এই ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেটীয় পক্ষ বিপক্ষ নিয়ে দ্বন্দ্ব তাদের নিজ দেশ থেকে আমাদের দেশে বেশি হয়। ছোট কাল থেকেই চায়ের দোকান বা যেকোনো আড্ডার জায়গায় মুখ্য বিষয় ছিল ভারত বা পাকিস্তান সাপোর্ট।
তবে, হ্যাঁ, বর্তমান সময় কিছুটা পাল্টেছে। বাংলাদেশের খেলা থাকলে দেশের পতাকা হাতে আমাদেরই বেশি মাঠে দেখা যায় কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক উল্টোদিকে চলে আসে তখন তারা জানান দেয়, কে ভারত সাপোর্টার বা কে পাকিস্তান। হাতের উল্টোদিকে যতোই তারা বলুক না কেন খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না। কিন্তু ঠিকই তারা এসে পক্ষপাতী হয়। কারণ, আমরাও উপমহাদেশীয় রাজনীতির চেতনার অংশ।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত বই ‘বিয়ন্ড দ্য বাউন্ডারি’ বইটি লেখার উদ্দেশ্য বলতে গিয়ে লেখক সি এল আর জেমস বলেছেন, যারা শুধু ক্রিকেট জানে তারা আদতে ক্রিকেটে কি জানে? আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই তিনি হাতে কলম ধরেছেন। বইটির পঞ্চাশ বছরপূর্তির বিশেষ সংস্করণে হেনরি লিখেন – সমাজ ও সংস্কৃতিতে খেলার বিশেষ করে ক্রিকেটের গুরুত্ব তুলে ধরা এই বই এখনো সমান গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আমরা পত্রিকায় ক্রিকেটীয় দৈন্যতা বিষয়ে কোনো লেখা উঠে আসলে পন্ডিত ভাব নিয়ে বলি – ‘খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না।’
ক্রিকেটার তৈরী হওয়ায় উপমহাদেশের দেশগুলোতে ক্রিকেট এখন বিনোদনের সর্বোত্তম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। ফুটবলকে বলা হতো শ্রমজীবীদের বিনোদনের খেলা আর ক্রিকেটকে অভিজাতদের খেলা হিসেবে বলা হতো। আর তাইতো কোনো এক বিলেতি বিশ্ববিদ্যালয় ফুটবলের নিয়ম কানুন তৈরী করেও শ্রমিকরা ফুটবলে পা লাগানোর সাথে সাথে তারা সরে গেল।
আর এদিকে উপমহাদেশে শ্রমিক পাড়ার গড়ে ওঠা ফুটবল সংস্কৃতির বিপরীতে গড়ে ওঠা বিলেতি বড় লোকদের অবসরের ক্রিকেটকে তারা একটানে পথে নিয়ে এসেছে তারা। ক্রিকেটের বিখ্যাত বড়লোকি ভাবকে লিওনেল মেসি বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো স্টাইলে কিক মেরে সর্বসাধারণের খেলা বানিয়ে ফেলেছে উপমহাদেশীয় মানুষেরা। তবে ক্রিকেট এমন এক দেশে এসে সম্প্রসার হলো যে দেশের মানুষ এখনো জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করে।
যাদের জীবনে গ্রহ নক্ষত্রের এমন প্রভাব যে, খেলা হারলেও সেটাকে ‘ভাগ্যর খেলা’ বলে ছেড়ে দেয়। আশির দশকে উত্থান হওয়া উপমহাদেশীয় ক্রিকেটের পর ব্রিটেনের লর্ডস থেকে ক্রিকেটে কেন্দ্র সরে স্বস্তি পাকিস্তানের পত্রিকা ডনেও ফুটে উঠেছে। এরপর ভারত পাকিস্তানের রাজনৈতিক কোন্দলের সাথে শুরু হয় ক্রিকেটীয় শক্তিমত্তা প্রদর্শনের লড়াই আর এদিকে আমরা তখন নিরব দর্শক।
বাংলাদেশ তো এই সেদিনের ছেলে সবে মাত্র ওয়ানডেতে উপরে উঠছে, টেস্ট বা টি-টোয়েন্টিতে এখনো ভয়ানক পেছানো। তবে সাউথ এশিয়ান বা উপমহাদেশীয় ক্রিকেটে বাংলাদেশের উত্থান কিন্তু এদিকের ক্রিকেট বাজারে সম্প্রসারণের পাশাপাশি ক্রিকেটীয় পাঠশালায় নতুন অধ্যায় যুক্ত করছে। আমাদের খেলোয়াড়রা র্যাংকিংয়ের অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে উপরে উঠছে। আর এতে ক্রিকেটীয় লড়াইয়ে দ্বিজাতিতত্ত্ব চেতনায় গড়া সাম্প্রদায়িকতার বাতাসে ভাটা পড়ে। তবে এদিকে সোশ্যাল মিড়িয়ায় শুরু হয় তিন দেশের ঘৃণা চর্চার প্রদর্শনী।
বিশ্ব টুর্নামেন্ট গুলোর বাইরে আঞ্চলিকভাবেও বড় টুর্নামেন্ট হচ্ছে। বিগ ব্যাস, কাউন্টিতো আছে পাশের দেশ ভারতে চলে আইপিএলের মহড়া। টাকার ঝনঝনানি থেকে শুরু করে সল্পবসনার চিয়ার গার্ল আর বলিউডের নায়ক নায়িকারা কি দেশের নাম টিমের প্রতি কোনো মাদকতা আনতে পারছে।
এইখানে তাদের দ্বিজাতিতত্ত্ব সেই বাঁধ রয়েই গেল পাকিস্তানিদের সাথে। আইপিএলের ছোট ভাই বিপিএল, না এইখানে অত আহামরি চিয়ার গার্ল বা সেলিব্রেটিরা নেই। ফলে খেলার প্রতি দর্শকদের নেই কোনো মাদকতা। গ্রামের মানুষজন বিপিএলে আগে তারা দেখে আইপিএল। তাদের আকর্ষণ থাকে ওইদিকে। বাজি ধরে বড় দানে। ক্রিকেটীয় প্রদর্শনের পাশাপাশি বাণিজ্য প্রসারেও দরকার।
ভারত পাকিস্তানের রাস্ট্রীয় কোন্দল ক্রিকেট মাঠের বানিজ্য রীতিমতো লা লিগা কিংবা চ্যাম্পিয়নস লীগ খেলে। এই দুই দেশের ম্যাচ হলেই হলো আপনি মাঠের কোনো অংশেই ফাঁকা পাবেন না একটা সিটও৷ সীমান্তে মারামারি কিংবা জম্মু-কাশ্মীর বিভেদ তো আছেই সাথে আছে হিন্দি আর উর্দূর ভাষাগত প্রতাপ। সব কিছু গিয়েছে ক্রিকেটের সেই মাঠে। রাস্ট্রীয় রাজনৈতিক পরিচয়ের বাহিরে দেশের ভাষাও একটা দেশকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড় করায়৷
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের দুটি অংশ ভারতে দুইপাশে চলে আসে। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। একদিনে উর্দু আরেকদিকে বাংলা। আর পশ্চিম পাকিস্তানিরা চাইতো পূর্ব পাকিস্তানের উপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে ৷ তাইতো ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলাকে নিজের মাতৃভাষা হিসেবে পাওয়ার জন্যই না নিজের দেশকে নিজের মতো পাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ১৯৭১ এর যুদ্ধে পাকিস্তানের আক্রমণকে রুখে দিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশের। আর এদিকে শুরু হয় ক্রিকেটীয় মাঠে দুই দেশের রাজনীতি ৷
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে ছিল ভারত। কিন্তু তাদের সীমান্তরক্ষীরাই আমাদের দেশের নাগরিককে সীমান্তে হত্যা করে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে উল্লাস করেছে। কিন্তু এদিকে ঠিকই অনেককে ভারতের ম্যাচে ভারতের পতাকা হাতে নিয়ে স্টেডিয়ামে উল্লাস করতে দেখি।
ভাষা, সংস্কৃতি, দেশ আর ধর্ম – সব মিলিয়ে জাতিগত বিরোধের সৃষ্টি। ভারত পাকিস্তানের বিদ্বেষ চাপিয়ে এখন বাংলাদেশ-ভারত বা বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিদ্বেষ। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিড়িয়ায় একে অন্যর প্রতি ঘৃণা চর্চা চলে গিয়েছে এক শিল্পের পর্যায়ে। এই তিন দেশের ক্রিকেট নিয়ে কথা বলতে চাইলে রাজনীতি সামনে আসবেই।
আর উপমহাদেশে ক্রিকেটের রাজনীতি ও এর প্রসারণের কারণেই হয়তো আশিষ নন্দী বলেছেন, ‘ক্রিকেট খেলা আসলে উপমহাদেশের জন্য, কিন্তু দূর্ঘটনাবশত খেলাটির জনক ব্রিটিশরা৷’ আপনি যতোই বলুন না কেন – খেলার সাথে রাজনীতি মেশাবেন না। কথাটা উপমহাদেশে প্রযোজ্য না। এ দেশে ক্রিকেটের চাইতেও রাজনীতি চর্চা হয় বেশি৷