টানা দুই আসর ধরেই ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) নজর কাড়ছিলেন বাঁ-হাতি পেসার আর্শদ্বীপ সিং। স্লোয়ার ইয়র্কার, স্লোয়ার বাউন্সারে রান আটকে দিতে বেশ পটু তিনি। সেই সাথে ডেথ ওভারে দুর্দান্ত বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে বেঁধে ফেলতেন অল্পতে। পঞ্চদশ আসরেও পাঞ্জাব কিংসের জার্সি গায়ে ছিল নজরকাড়া পারফরম্যান্স। ছিলেন ডেথ ওভারের অন্যতম সেরা পারফরমার। আর দুর্দান্ত পারফরম করে প্রথমবারের মত ডাক পেয়েছেন জাতীয় দলে।
প্রতি ম্যাচের আগে মা বালজিৎ কৌরকে ফোন করতেন, আশীর্বাদ নিতেন। সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে ম্যাচের আগেও মাকে ফোন করলেন। জানালেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি স্কোয়াডে সুযোগ পেয়েছেন। ছেলের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা মূহুর্তে মা অশ্রসিক্ত হলেন খুশিতে।
ছেলের আনন্দঘন মূহুর্ত নিয়ে বলজিৎ বলেছেন, ‘আর্শদ্বীপ আমাকে ফোন করে প্রতি ম্যাচের আগে। সে আজকেও আমাকে যথারীতি ফোন করলো। জানালো সে ভারত জাতীয় দলের স্কোয়াডে ডাক পেয়েছে। আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমি যখন ভিডিও কলে দেখলাম সে সতীর্থদের সাথে বাসে উদযাপন করছে – বুঝতে পারছিলাম ওর জন্য এই মূহুর্তটা কেমন। সে কখনোই ক্লান্ত হয়না। আমাকে সবসময় বলে অনুশীলনের পর তাঁকে মেসেজ করতে।’
মুখে হাসি টেনে আর্শদ্বীপের মা বলছিলেন, ‘এবার সে ফিরলে ভারতের হয়ে সফরে যাওয়ার আগে লম্বা মেসেজ দিতে হবে। তাঁর জন্য এটা খুব কঠিন একটা সফর ছিল। ওকে ভারতের জার্সি গায়ে দেখাটা আমাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের হবে।’
আর্শদ্বীপকে ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়তে সমর্থন দিয়েছিলেন তাঁর বাবা সিকিউরিটি অফিসার দর্শন সিং। ছোট থেকেই আর্শদ্বীপের পাশে ছিলেন তিনি। অনুশীলনের সময় ছেলের ইনস্যুইং লক্ষ্য করতেন। চন্ডিগড়ে কোচ যশন্ত রায়ের অধীনে শিখছিলেন আর্শদ্বীপ। থাকতেন চন্ডিগড় থেকে বেশ দূরে খড়ার নামক জায়গায়। সেখান থেকে প্রতিদিন সাইকেলে চড়েই অনুশীলনে আসতেন এই বাঁ-হাতি পেসার।
কোচ যশন্ত রায় বলছিলেন, ‘আর্শদ্বীপ যখন অ্যাকাডেমিতে আসে – আমি ওর ইনস্যুইং দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। তাঁর উচ্চতাও ভাল ছিল। আমার মনে আছে সে চেষ্টা করছিল ওভার ছয়টি বলই ভিন্ন ভিন্ন ডেলিভারি করার। সেসময় সে নিঁখুত ছিল না। কিন্তু তাঁর স্যুইংয়ের দক্ষতায় আমার তখন মনে হয়েছিল সে লম্বা ক্যারিয়ার গড়বে।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘এটা ছিল গ্রীষ্ম। আর্শদ্বীপ একটু দেরীতে অনুশীলনে আসে। সকাল ৫.৩০ এ অনুশীলনে শুরু হলেও খানিকটা দেরী হয় তাঁর। আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম দেরী করলে কেন? সে বলল, স্যার, যেকোন শাস্তি দিন সমস্যা নেই। আমি খেয়াল করলাম পার্কিংয়ে তার সাইকেল নেই। জিজ্ঞেস করলাম সাইকেল কোথায়? জবাবে ও বলে, সাইকেল ভেঙে গেছে এবং সে অ্যাকাডেমি পর্যন্ত হেটেই এসেছে। সে আমাকে আগেই বলতে পারতো, কিন্তু বলেনি। সেদিন আমি ভেবেছিলাম ওর এই প্যাশন ওকে ভারত জাতীয় দল পর্যন্ত নিয়ে যাবে।’
২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ছিলেন ভারত দলের সদস্য। সেবার ভারত যুবারা শিরোপা ঘরে তুললেও মাত্র দুই ম্যাচে খেলার সুযোগ পান তিনি। ২০১৯ সালে বিজয় হাজারে ট্রফিতে অভিষেক। ওই বছরই কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে আইপিএলে দল পান তিনি। তিন ম্যাচে তিন উইকেট শিকার করেন তিনি।
এরপর ২০২০ আইপিএলে আরব আমিরাতে ৮.৭৭ ইকনমিতে শিকার করেন ৯ উইকেট; দলের পক্ষে তৃতীয় সর্বোচ্চ। গেল আসরে ১২ ম্যাচে ১৮ উইকেট নেন ৮.২৭ ইননমিতে।
আর্শদ্বীপের কোচ বলেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পরে সেই রিস্ট পজিশন আর অ্যাঙ্গেল নিয়ে কাজ করেছে। আইপিএল ও বিজয় হাজারে ট্রফিতে খেলে সে আরও উন্নতি করেছে। আমি বাঁ-হাতি স্পিনার ছিলাম। সে হিসেবে তাকে বলেছি কিভাবে তর্জনি আঙুলের ব্যবহার করে ইনস্যুইং করতে হবে ও রিস্টের ব্যবহার করে আউটস্যুইং করতে হবে। আমরা তাকে অনুশীলনে ৫, ৬, ৭, ৮ মিটারের বাক্স রেখে বল করাতাম। ইনস্যুইংয়ের জন্য ৫মিটার লক্ষ্যে বল করতে হত, বল পুরনো হলে ৬। তার নিজের বোলিংয়ের ভিডিও ছাড়াও আমি তাকে ওয়াসিম আকরামের বোলিংয়ের ভিডিও দেখাতাম; সে কিভাবে উইকেটের কাছে বল ফেলে স্যুইং করাতো।’
এবারের আসরের আইপিএলে ডেথ ওভারে আর্শদ্বীপ ছিলেন দুর্দান্ত। ডেথ ওভারে এবারের আসরের অন্যতম সেরা বোলার ছিলেন তিনি। ডেথ ওভারে কিপটে বোলিংয়ে উইকেট নেওয়া, স্লোয়ার ইয়র্কার – সব কিছুতেই নজর কাড়েন তিনি। আর সুযোগ পেয়ে যান দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে।
কোচ জানিয়েছেন, ‘এবারের আসরে আমরা তার বোলিং ট্যাকটিস নিয়ে আরও কাজ করেছি। নিখুত ইয়র্কার দিতে পারে সেটা নিয়ে কাজ করেছি। অফ স্টাম্প লক্ষ্য করে ইয়র্কার দেওয়া অনুশীলন করানো হয়েছিল, সেই সাথে স্লোয়ার ইয়র্কারও। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলা হবে ভিন্ন ভিন্ন ভেন্যুতে। ওই পিচ গুলোতে ইনস্যুইং দিতে হবে যেখানে বল গ্রিপ করবে। আর পাটা উইকেট গুলোতে হার্ড লেন্থে বল করতে হবে।’
আর্শদ্বীপের বাবা দর্শন বলেছেন, ‘ একটা জিনিস তার অভ্যাস ছিল সেটা হচ্ছে নিজের নীতি ভঙ্গ না করা। সে সাইকেলেই যেত অ্যাকাডেমিতে; ১৮ বছরের আগে স্কুটার নিবে না। সে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম সিরিজে ভাল করার আগ পর্যন্ত কোনো উদযাপনও করবে না। সিরিজের আগে নিজের বোলিংয়ের ভিডিও দেখবে, ভুলগুলো নিয়ে কাজ করবে।’
আইপিএলের মঞ্চ মাতানোর পর আর্শদ্বীপের লক্ষ্য এবার জাতীয় দল। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে সুযোগ পেলে নিশ্চই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সেরাটা দিবেন সেটাই প্রত্যাশা আর্শদ্বীপের কোচ ও পরিবারের।