ক্ষুধার হাসিতে যার গোলাপ ফোটে, ফুটবলে মুছে যুদ্ধ

১.

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪ এর মাঝামাঝি সময়। ফ্রান্সের ফ্ল্যান্ডার্সের বিস্তীর্ণ সীমান্তে গোলাবারুদের শব্দগুলো তখন অবরুদ্ধ করেছে ইমু পাখি গুলোর অনাবিল বিচরণ। বিশ্ব তখন ঘুমাতে যায় মৃত্যুর আতঙ্কে, আর ঘুম ভাঙে সাইরেনের শব্দে।

এমনই এক রক্তিম দিনে হঠাৎ বৃষ্টির ভ্রুকুটি। শালগমের ছায়াঘেরা ফ্ল্যান্ডার্সে প্রায় পাশাপাশি অবস্থিত ইংল্যান্ড আর জার্মানির সৈনিকরা বেরিয়ে আসে তাঁবু সারাতে। ইংল্যান্ড আর জার্মানি – দুই যুযুধান বিপক্ষ। ইংরেজের এক সৈনিক হঠাৎ পকেট থেকে বের করে ক্রিস্টমাসের উপহার পাওয়া একটা ফুটবল। লাথি মেরে দূরে ভাসিয়ে দেয় তাকে।

সেই চর্মগোলকের আকর্ষণ সেদিন এড়াতে পারেনি অবশিষ্ট ইংরেজ আর জার্মানির সেনারা। দুই শিবির মেতে ওঠে সেই দুর্নিবার চর্মগোলকের অনাবিল মোহে। এরপর হয়ে যায় আরো কয়েকটি ম্যাচ। আস্তে আস্তে নিভে যায় বিশ্বযুদ্ধের আগুনটা। শান্ত হয় পৃথিবী।

২.

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রায় নব্বই বছর কেটে গেছে। সালটা ২০০৫ এর অক্টোবর। চিরহরিৎ অরণ্যে ঘেরা যুদ্ধবিদ্ধস্ত আইভরি কোস্ট সেদিন অর্জন করেছে ২০০৬ এর জার্মানি বিশ্বকাপের যোগ্যতা। নেপথ্য নায়ক লম্বা চুলের এক শান্তিদূত।

ম্যাচটা জেতার পর ড্রেসিংরুমে পৌঁছাবার আগেই মাঠের মাঝেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সব খেলোয়াড়রা। বলতে শুরু করেন একজন – ‘আমি চাই দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি। আমরা এক ও অভিন্ন। বিশ্বকাপে উত্তর দক্ষিণ বিবাদকে ছিন্ন করে একটা আইভরি কোস্টই মাঠে নামবে।’

দীর্ঘদিনের তর্ক-বিতর্ক-চুক্তি-রক্ত- লাশগুলো যেটা পারেনি, পেরেছিল ফুটবল। নেপথ্যে ছিলেন লম্বা চুলের সেই বক্তা। এরপর আফ্রিকান নেশনস কাপে মাদাগাস্কারের সাথে একটি খেলায় আইভরি কোষ্টের সেনাবাহিনী ঘিরে ধরে সম্মান দেয় সেই সুবক্তাকে। রক্তেমাখা লাশগুলোর সমাপ্তি হয়েছিল ফুটবল নামক গোলাপে। আর গোলাপটা দিয়েছিল কে? – দিদিয়ের ইয়েভেস দ্রগবা টেবিলি।

যেটাকে আমরা ফুটবল বলি, সেটা আসলে ফুটবল নয়, একটা শান্তির পায়রা যা নিমেষে নিস্তেজ করে দেয় যুদ্ধের রক্তচক্ষুকে, আর বারেবারে শান্তির পায়রা হয়ে ওঠেন একজন দিদিয়ের দ্রোগবা কিংবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই বেনামী সৈনিক। ২০ বছরের একটা জ্বলন্ত ক্যারিয়ার। লম্বা চুলের সাথে মুখের হাসিটা কখনোই  জানতে দেয়নি, ছেলেবেলার ক্ষুধাযন্ত্রণাগুলো, রিফিউজি হয়ে ফ্রান্সে কাকা মাইকেল গোবার সাথে কাটানো সেই নিষ্ঠুর রাত্রি।

মা বাবার থেকে অনেক দূরে একাকী সংগ্রাম। জানতে পারেনি কেউ। তারকা হয়েও যাপন করেছেন সাধারণ জীবন,আর ভালোবাসা ছড়িয়ে দিয়েছেন যুদ্ধের গোলাবারুদে। তাঁর জীবনকে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় – মার্সেইয়ের আন্ডাররেটেড স্ট্রাইকার থেকে ইউরোপ জয়ের কাহিনী। কিন্তু সেই কাহিনী আমার কাছে নেহাতই তুচ্ছ,কারণ ইউরোপজয়ী ফুটবলার দ্রগবাকে বারেবারে হারিয়েছেন যুদ্ধজয়ী ‘মানুষ দ্রগবা।

ইউরোপের নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে যিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন জন্মভূমির যুদ্ধ সমাপ্তির। শ্বাশত ভূমিপুত্র হিসাবে ইতিহাস মনে রাখবে ফ্রান্সিসকো টট্টি, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা কিংবা জাভি হার্নান্দেজকে, আর ভালোবাসার গোলাপ ছড়িয়ে তাদের সবার উপরে বসবাস করবেন একজন দিদিয়ের দ্রগবা, যিনি দেশকে কিছু ট্রফি না দিয়েও, দিয়ে গেছেন তার থেকেও বেশি।

ক্ষুধার সাথে লড়াই করে বড় হওয়া, নীলরক্তবঞ্চিত হয়েও মার্সেই থেকে নীলরঙা কেতনে ‘blues’ দের হয়ে করেছেন বিশ্বজয়,পাশে পেয়েছিলেন মোরিনহো নামের এক ভদ্রলোককে,কিন্তু এসবকিছুর ঊর্ধ্বে বাস করবেন একজনই – মানুষ দ্রগবা, যাঁর আভিজাত্যের নীল রঙ নেই, আছে মনুষ্যত্বের কালো রঙ। মনুষ্যত্বের ধ্বজা উড়িয়ে যেন বলে গেলেন এই রঙ আমাদের গর্ব, এই মেলানিন আমার গর্ব।

আর যেবার বিদায় নিলেন, গোটা স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ সেজে উঠেছিল এগারো নম্বর জার্সিতে, টিফোতে লেখাছিল- ‘You’ll always remain in our hearts।’ কতটা আছেন জানি না, কতটা থাকবেন জানিনা, কারণ ট্রফি-মেডেল-নাম-বেনাম এসবই পরিবর্তনশীল, স্ট্যাটিক শুধু বিশ্বযুদ্ধ বন্ধকরা ‘ফুটবল’ নামক বস্তুটির একমুঠো গোলাপী পাপড়ি, যে পাপড়িটা ছিল দ্রগবার, এবং শুধু দ্রগবারই।

বিশ্বকাপ না জিতেও কেউ কেউ বিশ্বজয়ী হয়, সবার উপরে মানুষ সত্য,তাহার উপরে নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link