দিলীপ দোশিকে যখন প্রথম দেখি তখন সমগ্র কায়নাত আমায় বাঁ হাতি স্পিন বোলিং করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ভুল বললাম, আমার বাবা ভেবেছিলেন, ছেলে রোগাটোগা আছে, আঙুলগুলো বড় বড়, আর তেরেকেটে বাঁহাতি। হাতের কাছেই উদাহরণ, বার বার করে দেখাও, বাংলা থেকে নিয়মিত টেস্ট ক্রিকেট তখন পঙ্কজ রায়ের পরে প্রথম কেউ খেলছেন। দিলীপ রসিকলাল দোশির আমার আইডল হবার জন্য আর কোনও চন্দ্রাহত মোক্ষমুহূর্তের প্রয়োজন পড়েনি।
প্রফেসর ফ্রেমের কালো চশমা পরিহিত বাঁ দিকে পাট করে আঁচড়ানো চৌকো মুখ, ফুল হাতা জামা পরে ফিল্ডিং বা ব্যাটিং নিয়ে পরিশ্রমের জায়গা নেই। দিলীপ রসিকলাল দোশির বাঙালি হওয়া আটকায়নি কোথাওই। অনেক ছোটবেলায় পশ্চিমতম প্রান্ত থেকে বাংলায় চলে আসেন।
ভুল বললাম আবার, তাঁর বাবা আসেন ব্যাবসাপত্র পরিবার নিয়ে, তারপর সেন্ট জেভিয়ার্স আর স্পোর্টিং ইউনিয়ন ধরে দিলীপ দোশীর বাঙালি হওয়া কেউ আটকাতে পারেনি। তিনজনের নাম ওঠে, যাঁদের নাকি বিষেণ বেদি ক্যারিয়ার শেষ করে দিয়েছিলেন। হরিয়ানার রাজিন্দার গোয়েল, মুম্বইয়ের পদ্মাকর শিভালকর আর বাংলার দিলীপ দোশি। বেদি যখন জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ছেন বা অবসর নিচ্ছেন, তখন রাজিন্দার গোয়েলের বয়স ৩৭, শিভালকর ৩৯।
সে তুলনায় দোশী তো তরুণ। হোক না তাঁর বয়স তিরিশ পেরিয়ে গেছে। অপর দিকে রাজিন্দার সিং হন্সের হাতে সময় হয়তো আরও আছে। এই অবস্থায় প্রথমে বেদীর জায়গায় সুযোগ পান ধীরাজ পারসানা। ব্যাটের হাতটা একটু ভালো ছিল আর প্রয়োজনে কার্সন ঘাউড়ির মতো বাঁহাতি পেসটাও করতে পারতেন সেই কারণে। দুটো টেস্ট অপেক্ষা করে প্যাকার সিরিজের ফলে মালাইহীন ছাঁচের মতো পড়ে থাকা কিম হিউজের অধিনায়কত্বে আসা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম সুযোগ।
আর প্রথম দর্শনেই বাজিমাত। সেই চশমা চোখে বাঁদিকে থেকে ওরা থাকে ওধারে চুল, বাঁ দিকে সামান্য ঘুরে দুলকি চালে দৌড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ডানদিকের কপালের উপরে উঠছে নামছে। হাতের বলটা যেন একটা বোতলের ঢাকনা, যা বার তিনেক খেলার চেষ্টা করতে করতেই বোলিং ক্রিজ এসে গেল তারপর ট্র্যাঞ্জিস্টরের অ্যান্টেনার মতো ডান হাত উঠল আর বাঁ হাত তার তালে তালে চাকার মতো ঘুরতে শুরু করল, যেন বোতলটার ঢাকা না খুলতে পেরে তিনি ছুঁড়ে দিলেন ওই বাইশ গজ দূরে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাটারের দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গেই এক অদৃশ্য সুতো দিয়ে ঝুলিয়ে রাখলেন বোতলরূপী বলকে, ব্যাটার তার অমোঘ নিয়তিকে উপেক্ষা না করে ব্যাট বাড়িয়ে দিল আর বিশ্বস্ত কিরমানীর কালো দস্তানায় বোতলবন্দী হল বল ব্যাটের ধার চুম্বন করে।
কিন্তু এসব তো না, আমি প্রথম দেখি বাংলা দলের নেটে, দুই দীর্ঘকায় প্রতিভাবান স্পিনার অলোক ভট্টাচার্য আর অরূপ ভট্টাচার্যের সঙ্গে বাংলা ক্রিকেটের অধিনায়ক ও সুপারস্টার বল করছেন নেটে। চাকা ঘুরছে, বল পড়ছে গুডলেন্থে আর স্পিন আর বাউন্স নিয়ে ব্যাটসম্যানের ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে পিছনের নেটে। অভীক মিত্র, প্রণব রায়, মলয় ব্যানার্জী, রাজা বেঙ্কট, সুজন মুখার্জী। বাম কিংবা ডান, লেন্থে নড়চড় নেই। সাবলীল অ্যাকশন আর লুপ আর স্পিন।
পাকিস্তান এসে ফিরে গেছে তখন, অস্ট্রেলিয়া থেকে মেলবোর্ন টেস্টে কপিলের গৌরবগাথা লেখা হয়ে গেছে। কিন্তু জনান্তিকে বলছে তখন, দোশী চতুর্থ দিন ডান পায়ের ভাঙা বুড়ো আঙুল নিয়ে কপিলের অনুপস্থিতিতে টানা এক প্রান্ত থেকে বল করে উড এবং হিউজকে না তুললে পরের দিনের গৌরব গাথার জন্য পাতার অভাব পড়ত।
নিউজিল্যান্ড আর ইংল্যন্ডে সাফল্য কম এলেও সর্বনাশটা করল ইমরানের পাকিস্তান। সে সিরিজটা কেরিয়ার খতমের সিরিজ। সেই যে গুন্ডাপ্পা রঙ্গনাথ বিশ্বনাথ রিভার্স স্যুইং বুঝতে না পেরে আত্মসমর্পন করলেন বিশ্বজয়ী ভারত বোম্বেতে যখন নামল তখন তিনিও ফিরছিলেন, অত্যুৎসাহীরা তাঁর ট্রলির উপর দাঁড়িয়েই বিশ্বজয়ীদের অভ্যর্থনা করল। তেমনই দিলীপ রসিকলাল দোশিরও।
দোষের মধ্যে পেস সহায়ক উইকেটে উইকেট না পাওয়া এবং ব্যাটিং ও ফিল্ডিং-এর দুর্বলতা। অথবা তদানীন্তন অধিনায়ক সুনীল গাভাসকারের গুডবুকে না থাকা। অথবা তরুণ রবি শাস্ত্রীর মঞ্চে প্রবেশে একই রঞ্জি দলের খেলোয়াড়ের প্রতি অধিনায়কের পক্ষপাতিত্ব।
আসলে পাকিস্তান সফর থেকে ফিরে যখন গাভাসকারের জায়গায় কপিল দেব ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং বিশ্বকাপের ইংল্যন্ড ঘুরে দেশে ফিরলেন তারপর প্রতিহিংসাকামী বিধ্বংসী ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতের মাটিতে কপিলের দলকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পর গাভাসকার আবার ফিরলেন এবারে ব্যাঙ্গালোরের চিন্নাস্বামীতে জাহির আব্বাসের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট খেলতে। আর সেটাই দোশীর শেষ টেস্ট ছিল।
বয়সও বাড়ছে, মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করতে শেখেননি তিনি, এই পরিস্থিতিতে বোধহয় ফ্লাইট ভেঙে এখানেই পড়ার কথা ছিল। রাজিন্দার গোয়েল বা প্যাডি শিভালকরের থেকে তিনি ভাগ্যবান। অন্তত: ১০০টি উইকেট পাবার মতো জায়গায় তিনি পৌঁছেছিলেন দেরিতে শুরু করেও। না সে ভাগ্য নিয়মিত খেলা মনিন্দর বা ভেঙ্কটপতি রাজুরও তাঁর পরে হয়নি। নিয়তি বা প্রতিভা যাই কারণ হোক না কেন, দিলীপ দোশী সেই রোমান্টিক জমানার অন্যতম শেষ প্রতিনিধি হয়ে রয়ে গেলেন ভারতীয় ক্রিকেটে। যিনি সপাট কথা বলেছেন, কারও প্রিয় হয়ে উঠতে যাননি, শুধুমাত্র পারফরম্যান্সের জোরে খেলে গেছেন।
আর রোম্যান্স? বাঁ হাতি স্পিনারদের বোলিং ছিল চোখের আরাম, দোশী পরবর্তী জমানায় ভারী ব্যাট ও প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বাঁ হাতি অর্থোডক্স স্পিনাররা ফ্লাইট, লুপ, ডিসেপশনের জায়গায় ডার্ট বোলার-এ ধীরে ধীরে পরিণত হল।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়াও সেই ছয়ের দশকের শেষ থেকে নিয়ে বিলেতে নটিংহ্যাম ও ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে কাউন্টি খেলে গেছেন চুটিয়ে। একবার সীমিত ওভারের ম্যাচে সাত ওভার বল করে ছয় মেডেন দিয়ে এক রানে এক উইকেটের কৃপণতম কীর্তির পরেও ক্লাইভ রাইসের অধিনায়কত্বে পরের ম্যাচে সুযোগ মেলেনি। বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলেছেন। ক্রিকেট প্রজ্ঞা অসামান্য। কিন্তু কখনই সরাসরি দেশের মাটিতে কোচিং-এ আসেননি। বা বলা ভালো, তাঁর প্রজ্ঞাকে ভারত ব্যবহার করতে পারেনি।
খেলা ছাড়ার পর তিনি পাকাপাকিভাবে ইংল্যন্ডেই বসবাস শুরু করেন। তাঁর পুত্র নয়ন কিছুদিন ইংল্যন্ডে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন বটে কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।
তবুও মাঝেমধ্যে চৌকো চশমার মধ্যে দিয়ে কাঁচা পাকা চুলের চোখা মুখচোখের ব্যক্তিত্বময় দিলীপ দোশী চাঁচাছোলা ভাষায় দিলীপ রসিকলাল দোশী টিভি বা ইন্টারনেটের পর্দায় এসে সুচারুভাবে ক্রিকেট বিষয়ে মতামত জ্ঞাপন করেন তখন মন চলে যায় সেই আটের দশকের গোড়ায়। ক্লাব হাউসে প্লেয়ার্স প্যাভিলিয়নটা তখন গ্যালারিতে উঠে যেতে হত, নিচে অফিস ছিল।
পেডেস্টাল ক্যালকাটা ফ্যানের হাওয়া পেরিয়ে ইডেনের নিরন্তর সবুজে পা রেখে ডানদিকে এখন যেখানে সিব্লক তার সামনে দূর থেকে দেখছে একটা হাফ প্যান্ট পরা বাচ্চা ছেলে, অপার বিষ্ময়ে। দুই দীর্ঘকায় প্রতিভাবান অপেক্ষাকৃত তরুণ স্পিনারের সঙ্গে একসঙ্গে হাত ঘোরাচ্ছেন, কালো চৌকো চশমা পরিহিত ফুলহাতা শার্ট কবজি অবধি সাঁটা এক নীরব অথচ মুখর শিল্পী, যুদ্ধে যিনি হার মানবেন না আবার ন্যায় নীতির উর্ধ্বে উঠেও অকারণ সুবিধা নেবেন না। আইডলরা তো এরকমই হন, তাই না?
কৃতজ্ঞতা: ময়দানী স্ক্র্যাপবুক