মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এক স্বপ্ন জয়ের গল্প। ঘটনার শুরু সেই ২০০৪ সালে। এক ধ্বংসাত্মক সুনামি লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল গল ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা। গল শহর থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে এক ১৫ বছর বয়সী কিশোর অপেক্ষায় আছেন স্বপ্নের পথে অগ্রসর হওয়ার।
নিজের ঘরে বসে তিনি হয়ত কল্পনা করছিলেন নিজ দেশের জার্সি গায়ে তাকে ঠিক কেমন লাগবে। পরম যত্নে তিনি সাজিয়ে রেখেছিলেন নিজের ক্রিকেট কিট ব্যাগ। বারবার হয়ত আনমনে তিনি তাকাচ্ছিলেন সেই ব্যাগের দিকে। অন্যমনষ্ক হয়ে বারবার তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন ভাবনার দুনিয়াতে।
তার সেই ঘোর কাটে মায়ের প্রচণ্ড চিৎকারে। এক ভারত মহাসাগর থেকে রীতিমত এক দৈত্য ছুটে আসছে প্রচণ্ড আগ্রাসন নিয়ে। না, রুপকথার কোন দৈত্য নয়। সেটা ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুনামি। দিনেশ চান্দিমাল সেই সুনামিকে দৈত্য বলেই আখ্যায়িত করেছিলেন।
১৫ বছরের দিনেশ তখন প্রাণপণে ছুটে চলে যান এক পাহাড়ের উপরে। উপর থেকে দেখেছেন সমুদ্রের ধ্বংসলীলা। যেই সমুদ্র শ্রীলঙ্কাকে বানিয়েছে অপার্থিব সৌন্দর্য, সেই একই সমুদ্র দৈত্য রুপে ধরা দিয়েছিল দিনেশ চান্দিমালের সামনে। তিনি স্রেফ অপলক দৃষ্টিতে দেখলেন সবকিছু তছনছ হয়ে যেতে।
পরদিনই তার যাওয়ার কথা ছিল লঙ্কান রাজধানী কলম্বোতে। তার যে ডাক এসেছিল শ্রীলঙ্কার অনূর্ধ্ব-১৫ দলের ট্রায়ালে। তিনি প্রস্তুত ছিলেন, নিজের মাথায় ছক কষছিলেন ‘কিভাবে নজর কাড়া যায়?’ কিন্তু এক লহমায় সবকিছু ধ্বংস হতে দেখলেন।
সুনামির ভয়াল থাবা শেষে, চান্দিমাল খুঁজতে গিয়েছিলেন তার সেই ক্রিকেট কিট ব্যাগ। সমুদ্রের নোনা জল তা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। জলের ঝাপটায় ব্যাগে থাকা সবকিছুই হয়ে যায় বাতিল। তবে অনঢ় থেকেছে সেই ছোট্ট চান্দিমালের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন।
২০০৪ সালের সেই সুনামি তাকে এক দৃঢ়চেতা চরিত্রে পরিণত করে। চোখের সামনে পরিচিতজনদের নিথর দেহ ভেসে যেতে দেখা চান্দিমালের কাছে ক্রিকেট পরিণত হয় পোক্ত এক খুঁটি হিসেবে। সেই চান্দিমাল ঠিকই তার স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখেছে। এমন শ্রীলঙ্কার সমৃদ্ধ ক্রিকেট ইতিহাসে তিনি অধিনায়ক হিসেবেও ঠাঁই করে নিয়েছিলেন। সেই সুনামির পর অবশ্য তার কষ্ট থেমে থাকেনি।
ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছে মনের ভীতর লালন করে তিনি ঠিকই পরবর্তীতে হাজির হয়েছিলেন কলম্বোতে। পরিবার থেকে দূরে একা থেকেছেন হোস্টেলে। খেয়ে না খেয়ে স্রেফ নিজের স্বপ্নকে সত্যি করার সংগ্রাম করেছে। যখন হাল ছেড়ে দিতে চেয়েছেন, তখনই সেই দৈত্য সামনে এসেছে, হয়ত কল্পনাতে বলেও গেছে, ‘তোকে নিশ্চয়ই এজন্যে বাঁচিয়ে রাখিনি।’
প্রকৃতির রুঢ়তা মানুষের সকল দূর্বলতাকে ভেঙেচুড়ে ফেলে ভীষণভাবে। শক্তপোক্ত হতে শেখায়। বোঝায় জীবনের মানে। জীবনকে একটা নতুন মাত্রা দেওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। প্রেষণা দেয় স্বপ্ন জয়ের। তাইতো চান্দিমাল এই ৩৫ বছর বয়সেও দিব্যি আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন।