মহসিন কামাল ও ‘সিধা খেলো ভাই’ দর্শন

চ্যাপেলদের ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেলকে যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সেই স্বপ্ন আদৌ পূরণ হয়নি। বরং এক পা এগিয়ে দুই পা পেছাতেই হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। টেস্ট খেলা শুরু করার পরই এমন একজন কোচের অদ্ভুত কৌশলহীন ক্রিকেটের বলি হয়েছিল বাংলাদেশ দল।

চ্যাপেলদের ছোট ভাই ট্রেভর চ্যাপেলকে যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সেই স্বপ্ন আদৌ পূরণ হয়নি। বরং এক পা এগিয়ে দুই পা পেছাতেই হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। টেস্ট খেলা শুরু করার পরই এমন একজন কোচের অদ্ভুত কৌশলহীন ক্রিকেটের বলি হয়েছিল বাংলাদেশ দল।

বিসিবি তাই এরপর হাঁটে উপমহাদেশীয় কোচের দিকে। ক্যারিবিয়ান গ্রেট অ্যান্ডি রবার্টস কিছুদিন অন্তবর্তীকালীন কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আসেন দুই পাকিস্তানি – মহসিন কামাল ও আলী জিয়া। তখন সময় ২০০২ সাল।

মহসিন কামালকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অভিজ্ঞই বলা যায়। পাকিস্তানের হয়ে নয়টি টেস্ট ও ১৯ টি ওয়ানডে খেলেছেন। মহসিন ফাস্ট বোলার ছিলেন। ১৯৮৪ সালে অভিষেক, শেষ জাতীয় দলে খেলেন ১৯৯৪ সালে। তবে, ১২৯ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ৩২০ টি উইকেট নেন। ইমরান খান, ওয়াসিম আকরামদের যুগে তাঁর ক্যারিয়ার খুব লম্বা হয়নি।

যদিও, তাঁর বন্ধু আলী জিয়ার কোনো টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতাই ছিল না। তবে, তিনি পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার ছিলেন। ১৩ টি সেঞ্চুরি সহ সাড় আট হাজারের মত রান করেন ক্যারিয়ারে, যদিও তাতে কখনোই জাতীয় দলের দরজা খোলেনি।

মহসিন কামালের সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় টেস্টে। যে একজন বাংলাদেশি ব্যাটারই টেস্টের মেজাজটা সবচেয়ে ভাল ‍বুঝতেন সেই আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে তিনি ছেটে ফেলেন। দলে আকরাম খানের জায়গাটাও নড়বড়ে হয়ে যায়। প্রাপ্তি বলতে এই সময়ে অভিষেক হয় ভবিষ্যতের দুই সম্ভাবনা অলক কাপালি ও তাপশ বৈশ্যর।

মহসিন কামালের কোচিংয়ের ধরণ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে টেস্ট ম্যাচ চলাকালে ড্রেসিংরুম থেকে তাঁর চিৎকার করে বলা ‘সিধা খেলো ভাই’ রীতিমত হাসি তামাশার জন্ম দিত। এমনকি নেট সেশনেও ব্যাটারদের নাকি মহসিন ওই সিধা খেলার পরামর্শটাই দিয়ে যেতেন। ট্রেভর চ্যাপেলের জমানাতেও যা একটু কোচিংয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল, মহসিন কামালের সময়ে তাও ছিল না।

কেবল সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া তাঁর তেমন একটা ভূমিকা ছিল না দলে। বলাই বাহুল্য, তাঁর অধীনে একটাও ম্যাচ জিততে পারেনি বাংলাদেশ। কোনো ফরম্যাটেই না। সেই বছর, মানে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কায় বসে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আসর। সেই আসরে পুল ওয়ানে যথারীতি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ‍- দুই প্রতিপক্ষের বিপক্ষেই হারে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৩৩ রান করলেও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৭৭ রান করে অল আউট হয় বাংলাদেশ।

মহসিন কামালের কোচিং অধ্যায়ের ইতি ঘটে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ দিয়ে। সেই বিশ্বকাপে অন্তত দু’টো ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। কারণ, গ্রুপ পর্বে প্রতিপক্ষ ছিল কানাডা ও কেনিয়া। কিন্তু, দু’টো ম্যাচেই বেশ বাজে ভাবে হারতে হয় খালেদ মাসুদ পাইলটের দলকে।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে প্রথম ওভারেই হ্যাটট্রিক, মানে ইনিংসের প্রথম তিন বলেই হ্যাটট্রিক করেন চামিন্দা ভাস।  প্রথম পাঁচ বলের মধ্যে পাঁচ রান করে চার উইকেট হারায় বাংলাদেশ। দলের ভেতরে কি চলছে, সেটাই যেন সেদিন দক্ষিণ আফ্রিকার পিটারমরিসবার্গের মাঠে দেখা যায়।

বিশ্বকাপ শেষে দলে অনেকরকমের রদবদল হয়। অধিনায়কত্ব হারান পাইলট। বিশ্বকাপে তাঁরও দলে ভূমিকা নিয়ে উঠেছিল প্রশ্ন। দলেও আসে একগাদা পরিবর্তন একই সাথে মহসিন কামাল ও আলী জিয়া যুগেরও অবসান ঘটে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। অবসান হয় ‘সিধা খেলো ভাই’ দর্শনের।

২০০২ সালের এপ্রিল-মে মাসে নিয়োগ পান দু’জন। সময়ের হিসেবে এক বছরেরও কম সময় ছিলেন তাঁরা বাংলাদেশের সাথে। আর এই অল্প সময়েই বাংলাদেশ ক্রিকেটে রীতিমত অন্ধকার যুগ নামিয়ে দিয়ে যান তাঁরা। বিশ্বকাপ শেষে যে ব্যর্থতার আলোচিত এক রিপোর্ট পেশ করা হয়, সেখানেও অধিনায়কের সাথে দায়ী করা হয় কোচকেই।

কোচ মহসিন অবশ্য পাল্টা অভিযোগ করেন বোর্ড ও খেলোয়াড়দের দিকেই। তিনি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘বিসিবির মনোভাবই তাঁদের ব্যর্থতার কারণ এবং উন্নতির অন্তরায়। দলের বাজে পারফরম্যান্সের জন্য বিসিবিও সমান ভাবে দায়ী। তাঁরা যখন তখন কোচকে বরখাস্ত করে, তাতে করে কেউই ওখানে স্থায়ী হতে পারে না।’

আরো বড় অভিযোগ করেন আলী জিয়া। তিনি দাবি করেন, নিজেদের গাফিলতি ঢাকার জন্যই অন্যের ওপর দোষ চাপায় বিসিবি। দু’জনের আঙুলই ছিল একদিকে। মনোভাবটা ছিল পরিস্কার। আর সেটা হল, মানসিকতা না পাল্টালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

বিসিবিও অবশ্য নিজেদের ভুলটা বুঝতে পেরেছিল। তৎকালীন বোর্ড সভাপতি ছিলেন আলী আসগর লবি। তিনি ঢাকায় প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে তিনি দু:খ প্রকাশ করে বলেছিলেন, কামাল ও জিয়াকে কোচ করে আনার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।

তবে, ইতিবাচক ব্যাপার হল, তাঁদের বিদায়ের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ ক্রিকেটে নতুন এক যুগের সূচনা হয়। কোচ হয়ে আসেন শ্রীলঙ্কাকে ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ জেতানো কোন ডেভ হোয়াটমোর। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল কোচের তালিকা করলে আজো হয়তো তাঁর নামটা থাকবে ওপরের দিকেই। বাংলাদেশকে তিনি ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে প্রথমবারের মত দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠান। সেটা আরেক গল্প, আরেক ইতিহাস। সেই গল্পটা তোলা থাকল আরেক দিনের জন্য।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...