অবশেষে বাংলাদেশের কোচিংয়ের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন রাসেল ডোমিঙ্গো। এমন খবর অবশ্য মাস তিনেক আগেই একবার চাউর হয়েছিল। তবে সেবার সেটা গুঞ্জন পর্যন্তই আটকে ছিল। তবে এবার ভারত সিরিজ শেষ হওয়ার পর গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) একটি ই-মেইলের মাধ্যমে তিনি জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে রাসেল ডোমিঙ্গোর অধ্যায় এখানেই শেষ।
ডোমিঙ্গোকে নিয়ে বিসিবি আরো এক মেয়াদে আগ্রহী ছিল কিনা তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা এখনও রয়েছে। কারণ কাকতালীয় ভাবে রাসেল ডোমিঙ্গোকে যখই সরানোর পরিকল্পনা করা হয় ঠিক তখনই যেন তাঁর অধীনে বাংলাদেশ দল ভাল করতে শুরু করে।
এর আগে যেমন ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে ঘরের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডকে সিরিজ হারিয়ে নিজের চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন তিনি। আর এবার ভারতকে ওয়ানডে সিরিজ হারিয়ে আবারো নিজের দায়িত্বটা পাকাপোক্ত করার দৌড়েই ছিলেন। কিন্তু এবার নিজে থেকেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাথে তাঁর সম্পর্কের ইতি টানলেন।
ভিতরের খবর কিংবা ভেসে আসা গুঞ্জনে একটা বার্তা বারবারই আসছে, রাসেল ডোমিঙ্গো নাকি অনেকটা অসন্তোষের জেরেই বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এটা কতটুকু সত্য কিংবা মিথ্যা, তা নির্ণয় করার পথ আপাতত বন্ধ।
তবে, বাংলাদেশের চিরন্তন ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি বলে, বাংলাদেশ দলের কোচিংয়ে এসে পুষ্পমাল্যের মাধ্যমে বিদায় নিয়েছেন, এমন সংখ্যা হাতেগোনা কয়েকজন। তাই খুব যে সুখ স্মৃতি নিয়ে রাসেল ডোমিঙ্গো বাংলাদেশ ছাড়ছেন না, সেটি অন্তত বলাই যায়।
প্রথমত রাসেল ডোমিঙ্গো শুরু থেকেই বাংলাদেশের সমর্থকদের কাছে চক্ষুশূল ছিলেন। ব্যাপারটা এমন এক পর্যায় গিয়েছিল যে, রাসেল ডোমিঙ্গোর অধীনে বাংলাদেশের সফলতা মানে দলের সাফল্য, কিন্তু ব্যর্থতা মানে তাঁর একান্ত দায়। সমর্থকদের এমন রোষানলের সুর বইয়ে গিয়েছিল বিসিবির মধ্যেও।
তারাও ঠিক ডোমিঙ্গোর সময়ে একেক সময়ে একেক উদ্ভট সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁকে একটা বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কখনও খালেদ মাহমুদ সুজনকে দলে আনা হয়েছে ডোমিঙ্গোর উপর নজরদারির জন্য, আবার প্রধান কোচ থাকা স্বত্ত্বেও টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট হিসেবে উড়িয়ে আনা হয়েছে শ্রীধরন শ্রীরামকে।
স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের কাজগুলো প্রধান কোচ পদে থাকা একজনকে বিব্রত করে। রাসেল ডোমিঙ্গো ঠিক বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেই সংস্কৃতির বলয়েই ঢুকে গিয়েছিলেন। অবশ্য কিছুটা সময় নিয়ে বেরও হয়ে গেলেন। কিন্তু যখন বের হলেন, সবার মধ্যে ব্যাপারটা এমন যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট মুক্তির একটা পথ খুঁজে পেল। যেন ডোমিঙ্গোর প্রস্থানই সব সমস্যার সমাধান।
আসলেও কি তাই? রাসেল ডোমিঙ্গো তাঁর সময়কালে কি এতটাই ব্যর্থ ছিলেন? সেই প্রশ্নের উত্তরে পরে আসা যাক। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কিংবা সমর্থকরা, সবাই এক বাক্যেই হাথুরু সিংহের কর্তৃত্ব, দলে দখলদারিত্ব মেনে নেন। সমর্থকদের মত এমন ভাবনার স্রোতে গা ভাসিয়ে বিসিবিও মনে করে, বাংলাদেশ দল পরিচালনা করার জন্য একজন কড়া হেডমাস্টারের প্রয়োজন।
সেটাই যেন বাংলাদেশ দলের সফল হওয়ার একমাত্র গোপন সূত্র। বিসিবিও তাই এমন কোচকে অগ্রাধিকার দেয়। সেই যাত্রায় তারা আগের কোচ স্টিভ রোডসকে সরিয়েছিল এই একমাত্র ক্রাইটেরিয়াকে বিবেচনা করেই। রোডস ক্রিকেটাদের সাথে একটু বেশি নম্র ছিলেন- এই এক কারণেই বিসিবি তাঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল।
একই ভাবে, রাসেল ডোমিঙ্গো ঠিক তেমন কড়া ছিলেন না। বিসিবি থেকে সেই আভাস তিনি মাঝেমধ্যেই পেয়েছেন। উপরমহলের এমন সব চাপে তিনি একবার বলেই ফেলেছিলেন যে, বাইরে থেকে এত বেশি কথা আসা ঠিক না। বিসিবিও তাতে একটু তেঁতে গিয়েছিল। কিন্তু এখানে গলদটা দিনশেষে বিসিবিরই।
একটা টেস্ট প্লেয়িং ক্রিকেটে দেশের ইতিহাসে একজন কড়া কোচের মানদণ্ড নিয়ে পরবর্তী কোচকে বিবেচনা করা পুরোপুরিই অমূলক। কারণ একেক কোচের একেক দর্শন। কোচকে ঠিক তাঁর মতোই কাজ করতে দিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটে ঠিক এই চর্চাটা যেন পূর্ণতাই পায়নি। তাই হাসিমুখে কোচের দায়িত্ব নেওয়া ভিনদেশিরা বাংলাদেশ ছাড়েন তিক্ততায় ভরা সব স্মৃতি নিয়ে।
এবার আসা যাক, হাথুরু, রোডস নাকি ডোমিঙ্গো- কে বেশি সফল, এই প্রশ্নের উত্তরে। হাথুরুর অধীনে বাংলাদেশ বাংলাদেশ ৯৫ টি ম্যাচ খেলেছিল। সেখানে বাংলাদেশের জয়ের হার ছিল ৪৩ শতাংশ। কিন্তু সবাইকে অবাক করিয়ে দেওয়ার মত তথ্য হল, ডোমিঙ্গোর অধীনে এই জয়ের হার আরেকটু বেশি। তাঁর অধীনে বাংলাদেশের খেলা ৯০ ম্যাচে জয়ের হার ৪৪ শতাংস। স্টিভ রোডসের অধীনের সেখানে ৪৪ ম্যাচে ৫২ শতাংশ ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ।
হ্যাঁ। এটা ঠিক। বাংলাদেশের নিয়মিত জয়ের অভ্যাস গড়া শুরু হয়েছিল ঐ হাথুরুসিংহের অধীনেই। এ ছাড়া বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট গুলোতে তাঁর অধীনে বাংলাদেশ দল সফল হয়েছিল বেশি। সেই হিসেবে, ডোমিঙ্গো কিংবা রোডস কেউই তেমন সফলতা দেখাতে পারেননি। কিন্তু ডোমিঙ্গোর অধীনেও কিন্তু অনেক ছোট ছোট কার্যকারী কাজ হয়েছে। হাথুরুর অধীনে বাংলাদেশ জেতার অভ্যাস তৈরি করলেও বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ ঠিক তেমন বলার মত কিছু করে দেখাতে পারেনি।
কিন্তু ডোমিঙ্গোর সময়ে বাংলাদেশ বাইরের মাটিতে ওয়ানডে থেকে টেস্ট- দুই ফরম্যাটেই বেশ আলো ছড়িয়েছে। মূলত এক পাক্ষিক সমালোচনার স্রোতে তাঁর এ সাফল্য-গাঁথাগুলো আড়ালেই পড়ে গিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ দলকে স্পিন নির্ভর থেকে পেস কেন্দ্রিক দল সাজানোর ক্ষেত্রে তাঁর দারুণ একটা ভূমিকা রয়েছে। ইবাদাত, শরীফুল, হাসান মাহমুদদের মতো পেসারদের দলভুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাকে একেবারে অবজ্ঞা করা যায় না।
মূলত বিসিবি’র এক পাক্ষিক চিন্তাসহ অদ্ভুত সব ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির কারণেই রাসেল ডোমিঙ্গোর অধ্যায়টা অনেকের কাছে হয়তো বিভীষিকাময় এক অধ্যায় হয়ে থাকবে। কিন্তু আদৌতে সেটা নয়। ডোমিঙ্গো যে খুব সফল ছিলেন, সেটা বলার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু তাঁর সময়কালে তিনি সেভাবে বাইরে সহায়তাটা পাননি, সেটিও বলতে হবে। সমর্থক কিংবা মিডিয়ার সমালোচনার স্রোতে বিসিবিকেও সেভাবে পাশে পাননি। যেটার বড্ড প্রয়োজন ছিল। সেটা নিশ্চিতভাবেই তাঁর ব্যর্থতা ঢাকবার জন্য না, পেশাদারিত্বের খাতিরে তিনি এমন সহায়তার আশা করতেই পারেন।
আসন্ন বছরেই ক্রিকেট বিশ্বকাপ। বিসিবিকে তাই ডোমিঙ্গোর স্থলাভিষিক্ত খুঁজতে হচ্ছে দ্রুতই। তবে সেই ধারায় ক্রিকেটীয় সংস্কৃতিকে আরেকটু শক্তপোক্ত করার দায়িত্বটা বিসিবি’রই। নতুবা এমন ধারা বজায় থাকলে বৈশ্বিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভাবমূর্তি সামান্য পরিমাণও ভাল হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এখন দেখার পালা, বিসিবি এখান থেকে কিভাবে উত্তরণ ঘটাতে পারে। তবে ইতিহাসের সূত্র ধরে বললে, ভাল কিছু হওয়ার সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত বেশ ক্ষীণ। কোচ আসবেন, কোচের পালাবদল হবে, কিন্তু ক্রিকেট দল হিসেবে মাথা উঁচু করার প্রক্রিয়াটা শুধু ‘চলমান’ এর মাঝেই আটকে থাকবে- এটাই যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সংস্কৃতি, ইতিহাস কিংবা ঐতিহ্য।