সময়টা মোটামুটি নভেম্বর নাগাদ। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট মৌসুমের শুরু। তাজা পিচ। পোলকের একটা ওভার শেষ হতেই, যেই ব্যাটসম্যান অন্য প্রান্তে স্টান্স নিতে যাবে, হালকা মাথা তুলে বোলিং মার্কের দিকে তাকালেই দেখবে মাখায়া এনটিনি ট্রাউজারে বল ঘষছেন।
টেস্ট জিততে চাই ৩৯৫ রান, কিন্তু সেটা গৌণ। বাঁচাতে খেলতে হবে ৯০ ওভার। ক্রিজে রাহুল দ্রাবিড়কে তখন সঙ্গ দিচ্ছেন আনকোড়া দীপ দাশগুপ্ত। দ্রাবিড়ের সেই সিরিজে যা ফর্ম চলছে, তাতে কানাঘুঁষো চলছে, ‘এ কি আদৌ তত বড়ো ব্যাটসম্যান যতটা আমরা ভাবি।’
দ্রাবিড়ীয় দেয়ালে তখন পলেস্তারা খসা শুরু হয়েছে। কিন্তু সেইদিন আবার চুন-সুরকি দিয়ে গোটা দেয়াল মেরামত করেন ভারতীয় ক্রিকেটের দেয়াল। আজকের খেলাটা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, রাহুল ‘দেয়াল’ দ্রাবিড়ের সেই মহাকাব্যিক খেলাটাকে ছুঁতে পারলেন কিনা বিহারি, অশ্বিন, পূজারা পান্তরা।
দেখে মনে হলো, শুধু ছুঁলেন না, কোথাও না কোথাও গিয়ে সেই মহাকাব্যিক প্রদর্শনের গ্রহণ ঘটালেন। আর ব্যক্তিগত ধারণা, ৪৮ তম জন্মদিনে এর চেয়ে ভালো উপহার আর পেতেন না দ্রাবিড়। আজকের প্রধান চার তারকার মধ্যে তিনজনই কোনো না ভাবে দ্রাবিড়ের সাথে যুক্ত। ঋষভ পান্তকে দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি, বিহারিকেও। আর পূজারা তো একপ্রকার দ্রাবিড়ের ভাবশিষ্যই।
ভারতীয় ক্রিকেটে বন্য সাহস ও বীরগাথার অভাব নেই। এর আগে বহু খেলোয়াড়, অপরিসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটে। অনিল কুম্বলে ভাঙা চোয়াল নিয়ে বল করেছেন। লক্ষণ পিঠে অসহ্য ব্যাথা নিয়ে এই অস্ট্রেলিয়াকেই ম্যাচ হারিয়ে দিয়েছেন। কোহলি ভাঙা আঙুল নিয়ে খেলেছেন, ধোনি তো পিঠের ব্যাথা নিয়ে দিনের পর দিন কিপিং করে গেছেন।
কয়েক দশক পিছিয়ে গেলে, মহিন্দার অমরনাথ মার্শাল, রবার্টস দের গোলাগুলি বুকে পিঠে নিয়ে ব্যাট করে গেছেন। বিশ্ব ক্রিকেটেও এমন উদাহরণ কম নেই। ডুডলে নার্স ভাঙা আঙ্গুল নিয়ে ২০০ করেছেন, গ্রেম স্মিথ, স্টিভ ওয়াহরাও একই ধরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু তখন সময়গুলো ছিল আলাদা।
আজকের আইপিএল বা টি-টোয়েন্টি অধ্যুষিত সময়ে দাঁড়িয়ে আজকের বিহারি, অশ্বিনের লড়াইটার মাহাত্ম কয়েকগুন বেড়ে গেছে। বাউন্সার গায়ে মাথায় নিয়ে কালশিটে গুলো পরবর্তীতে উপভোগ করতেন মহিন্দার অমরনাথ। লোকে বলতে চিতাবাঘের আঁচড়। আজকে অশ্বিনের গায়ের কালশিটে গুলোই বা কম কোথায়?
টি-টোয়েন্টি নামক কাঁচের বাড়ির অধিবাসী পান্থও আজ নিজের সেরা খেলাটা খেলে অজি সমর্থকদের পালস বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি টি-টোয়েন্টি যদি কাঁচের অত্যাধুনিক অট্টালিকা হয়, তাহলে টেস্ট ক্রিকেট হলো চুন-সুড়কি-সিমেন্ট দিয়ে গাঁথা মোটা মোটা দেয়াল ওলা সাবেক সাতমহলা। সেই অট্টালিকাতে আজ ড্রয়ের দ্রাবিড়ীয় সভ্যতার ইট গেঁথেছেন বিহারি।
এরপরেও তিনি নামকরা চলভাষের বিজ্ঞাপন তো দূরের কথা, মশলার বিজ্ঞাপনেও ঠাঁই পাবেননা। লোকে একটা দুটো ব্যর্থতার পর তাঁকে বাদ দেবার দাবি তুলবে। কিন্তু তিনি এই বাজারে অকিঞ্চন হলেও, ক্রিকেটীয় মননে অচঞ্চল। তাঁর ডিফেন্স দুর্ভেদ্য।
দেখলাম বাবুল সুপ্রিয় বলেছেন, বিহারি ভারতের জয়ের সুযোগকে খুন করেছেন। বিহারি ফেলুদার গোঁসাইপুর সরগরম পড়েননি। পড়লে ফেলুদার ভাষায় বলতেন, ‘জয়ের সুযোগ খুন হয়নি বাবুল বাবু। খুন হয়েছে অজিদের ঔদ্ধত্য। খুন হয়েছে অজিদের সমস্ত বোলিং স্ট্রাটেজি। আর হন্তারকের নাম? হনুমা বিহারি।’