ক্রিকেটটা ভারতের মানুষের কাছে যেন জীবনেরই একটা অংশ হিসেবে ধরা হয়। সেখানকার মানুষ জয়ে যেমন অনন্দিত হয় ঠিক তেমনি পরাজয়েও কষ্ট পেয়ে থাকে। খেলোয়াড়দের বাড়ি ঘরে হামলা করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। তবে মাঠের ক্রিকেটটা খারাপ খেললে র্যাংকিংয়ের মতোই আয়-ব্যয়ে প্রভাব পড়ে। ফেবারিট হিসেবেই এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল ভারত।
সময়ের সেরা টি-টোয়েন্টি খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ভারতীয় ক্রিকেট দল যে এবার শিরোপার অন্যতম দাবিদার, সেটা যেমন ধরে নেওয়া হয়েছিল ঠিক তেমনি শত্রুও এটি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে সুপার টুয়েলভের প্রথম দুই ম্যাচ হেরে নিন্দার ঝড় ওঠে থাকেন কোহলিরা।
তৃতীয় ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পরও এ কারণে তাঁদের এখন সেমিফাইনালে যাওয়ার পথই অনেকটা কঠিন হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট আরও অনেকের ব্যবসাও তাই পড়েছে হুমকির মুখে। নিঃসন্দেহে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটির নাম ক্রিকেট।
আর সে কারণেই উপলক্ষটা যদি হয় কোনো ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ভারতের মানুষের মধ্যে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে। যার প্রভাব পড়ে ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট সব ধরনের ব্যবসায়। ভক্ত-সমর্থকেরা জার্সি থেকে শুরু করে আরও নানা সরঞ্জামাদি কেনার জন্য যেমন ফরমাশ দেন, ঠিক তেমনি বন্ধুরা মিলে রেস্টুরেন্টে বা পানশালায় বসেন একসঙ্গে ভারতের খেলা উপভোগ করার জন্য। দেশের বেশির ভাগ স্থানে লাগে উৎসবের ছোঁয়া রং।
নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডও তখন ক্রিকেটে আরও বেশি করে বিনিয়োগ করতে থাকে, কারণ অগণিত মানুষ এই খেলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু যখন কারও পছন্দের দল একটার পর একটা ম্যাচ হারতে থাকে, তখন কী আর সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে? সমর্থকেরা যেমন হতাশ হন, পছন্দের দল ম্যাচ জিতলে যে বিজ্ঞাপন সম্প্রচার করার কথা, সেটা আর আগের সময়ের মতো করা হয় না।
রেস্টুরেন্টগুলোও এরপর আস্তে আস্তে খালি হতে থাকে। যেখানে ভারতের মতো ক্রিকেটপাগল জাতির কাছে বিশ্বকাপে এক ম্যাচ হারাই তাই অনেক বড় ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। সেখানে ভারত এবার চরমভাবে হতাশ করে হেরে গেছে পরপর দুই ম্যাচ। ২৪ অক্টোবর রোববার ভারতে সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে পাকিস্তানের কাছে ভারতের ১০ উইকেটের শোচনীয় পরাজয় দেখে পরদিন নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন অনেক ভারতীয়।
এরপর দ্বিতীয় ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের কাছে আবার হেরে বসায় ভারতের সমর্থকেরা এই বিশ্বকাপ নিয়ে তাঁদের সমস্ত আগ্রহই একরকম হারিয়ে ফেলেছেন। ম্যাডিসন মিডিয়া গ্রুপের অংশীদার এবং প্রধান নির্বাহী বিক্রম সাখুজা ভারতের এই হারের কারণে টেলিভিশনগুলোর রেটিং কমে যাবে বলে পাকিস্তানের বিপক্ষে হারের পর থেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘ক্রিকেট খেলাটি ভারতের জনগণের কাছে অনেকটা নেশার মতো। বিশ্বকাপে দলের এমন বিপর্যয় চ্যানেলগুলোর ওপর চরম নৈতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে যখন ভারত জিততে থাকে, তখন চ্যানেলগুলোর রেটিং বেড়ে যায় এবং হারলে আবার কমে যায়। এবার সেরকমটিই হয়েছে।’
পাঁচ বছর আগে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টেন পর্বে চার ম্যাচের মধ্যে তিন ম্যাচে জয় পায় ভারত। ফলে তখন পুরুষ দর্শকেরা বিভিন্ন চ্যানেলে স¤প্রচারিত সুপার টেনের খেলাগুলোকে সর্বোচ্চ ৪.৪ রেটিং দিয়েছিল। কিন্তু এবার যেহেতু ভারতের পারফরম্যান্স মোটেও ভালো হয়নি, ফলে এই বিশ্বকাপের রেটিং ৩ হলেও ব্যবসায়ীরা মোটেও অবাক হবেনা না।
যেসব কোম্পানি খেলা উপলক্ষে চ্যানেলগুলোয় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, তাদের জন্য ভারতের এমন হার বড়সড় ধাক্কার মতোই লেগেছে তাদের কাছে। কিন্তু কোনোভাবে ভারত যদি সেমিফাইনালে যেতে পারে, তখন আবার রেটিং তরতরিয়ে বেড়ে যাবে। এ কারণে সমর্থক ও বিজ্ঞাপনদাতারা এখন সেই প্রার্থনাই করে চলেছেন।
গো-জুপ কোম্পানির মিডিয়া পরিচালক সুশীল অনন্তমনের মতে এবার বিজ্ঞাপনদাতারা যত খরচ করেছেন, তত পরিমাণ ব্যবসা কোনভাবেই করতে পারবেন না, ‘যেসব বিজ্ঞাপনদাতা টুর্নামেন্টের শুরুতেই টাইটেল স্পনসর থেকে শুরু করে আরও নানা খাতে এককালীন যে টাকা খরচ করেছেন, তারা অবশ্যই ভারতের এমন হারের জন্য যেমন ভুক্তভোগী হবেন পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, ভারত সেমিফাইনালে না গেলে অনেক মানুষ আর টিভি পর্দায় খেলাই দেখবেন না। এ কারণে তারা তাঁদের পণ্য যে পরিমাণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে ভেবেছিলেন, সে পরিমাণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে না তেমনি আশানুরূপ ব্যবসাও হবে না। কিন্তু ভারত যদি অলৌকিক কান্ড ঘটিয়ে সেমিফাইনালে চলে যায়, তখন বিজ্ঞাপনদাতাদের চিন্তার তেমন বড় কোনো কারণ থাকবে না।’
তবে এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে ভারতীয়রা অন্যান্যবারের তুলনায় একটু বেশিই উত্তেজিত ছিলেন, সেটি সাম্প্রতিক সময়ে দলটির মাঠের ক্রিকেটের কারণেই। এই কারণে ব্র্যান্ডগুলোও টেলিভিশন এবং অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপনের পেছনে অঢেল টাকা খরচ করতেও কার্পণ্য করেননি। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ উপলক্ষে স্টার স্পোর্টস বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় প্রায় ১ হাজার কোটি রুপি আয় ছাড়িয়েছে।
বাইজুস, ড্রিম ইলেভেন, কোকাকোলা, বিমল, রিলায়েন্স ট্রেন্ডজ, আপস্টক্স, ক্রেড ও স্যামসাংয়ের মতো বড় বড় কোম্পানি বিজ্ঞাপন সম্প্রচারের জন্য স্টার স্পোর্টসের সঙ্গে আগে থেকেই চুক্তি করেছিল। এর বাইরে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম ডিজনিপ্লাস হটস্টারে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছে ড্রিম ইলেভেন, ওপ্পো, মারুতি, ফোনপে ইত্যাদি কোম্পানি। ভারত সুপার টুয়েলভ থেকে বাদ পড়লে তারা প্রত্যেকেই বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। সেটি যাতে না হয় সেই প্রার্থনা যেমন ব্যবসায়ীরা করছেন ঠিক তেমনি সমর্থকরাও।