১.
বাংলার সর্বকালের সেরা এক পেসারকে নিয়ে একটা লেখা লিখতে গিয়ে বাংলার ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমের একটা রঞ্জি ট্রফি ম্যাচের স্কোরবোর্ড দেখে (ইনিংস ও ২৮২ রানে সেই ম্যাচ জিতেছিল বাংলা) চমকে গিয়েছিলাম সপ্তাহদুয়েক আগে। সেই পেসার সেই ম্যাচে কোন উইকেট পাননি। প্রথম ইনিংসে মাত্র চার ওভার বল করে (একটি মেইডেন) চার রান দিয়েছিলেন আর দ্বিতীয় ইনিংসে বলই করেন নি। এবং চমকটা সে জন্য নয়।
২৭ ডিসেম্বর ১৯৭৪ থেকে এক জানুয়ারি ১৯৭৫ হাই ভোল্টেজ ভারত বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট ম্যাচ হয়েছিল ইডেনে। আর তার ছয় দিন আগে ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমের রঞ্জি ট্রফিতে পূর্বাঞ্চলের লিগে ২১-২৩ ডিসেম্বর ১৯৭৪ তারিখে বাংলা বনাম আসাম তিন দিনের ম্যাচ ছিল জোড়হাটে।
২১ আর ২২ ডিসেম্বর, এই দুই দিনেই শেষ হয়েছিল ম্যাচটা। দুই ইনিংসে আলাদা করে এবং গোটা ম্যাচেও বাংলার বিরুদ্ধে রঞ্জি ট্রফিতে কোন দলের সর্বনিম্ন রানের রেকর্ড গড়া হয়েছিল সেই ম্যাচেই। আসাম প্রথম আর দ্বিতীয় ইনিংসে সেদিন করেছিল যথাক্রমে ৩৫ আর ৩৩ রান, বাংলার প্রথম ইনিংসে ছয় উইকেটে ৩৫০ ডিক্লেয়ারের জবাবে।
প্রথম ইনিংসে ০-২৩ থেকে ৩৫ রানে শেষ হয়ে গিয়েছিল আসাম, সর্বোচ্চ ১১ করেছিলেন এন বেজ বরুয়া। আর দ্বিতীয় ইনিংসে শুরু থেকেই উইকেট হারিয়েছিল আসাম, কেউ দু’অঙ্কে পৌঁছতে পারেন নি, এন বেজ বরুয়াই করেছিলেন সর্বোচ্চ অপরাজিত ৮ রান। সে ম্যাচের স্কোরবোর্ড দেখে চমকে ওঠার প্রথম কারণ ছিল এই ৩৫ আর ৩৩।
আর চমকে ওঠার দ্বিতীয় ও শেষ কারণটা ছিল সেই ম্যাচে বাংলার এক অলরাউন্ডার-স্পিনারের বোলিং পরিসংখ্যান। প্রথম ইনিংসে ৪.১-২-৪-৩ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৮.১-৪-৭-৭। ম্যাচে ১২.২-৬-১১-১০। সম্ভবত এক ম্যাচে এর চেয়ে ভালো বোলিং বাংলার আর কেউ আজ অবধি করেন নি।
অপর স্পিনার দিলীপ দোশিকেও (ম্যাচে ৬ উইকেট) ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তিনি সে ম্যাচে। তার নাম অলোক ভট্টাচার্য। আমার অলোকদা। চমকে দেওয়া স্কোরবোর্ডটা মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়িয়ে দিয়েছিল অলোকদাকে নিয়ে আমার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি। যেটা আমার আজও হয় মাঝে মধ্যেই।
২.
সেই স্মৃতি মনে পড়ায় যে ১৯৭০-৭১ থেকে ১৯৮৬-৮৭ মৌসুম পর্যন্ত ৪২ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে ১৩৪ উইকেট নিয়েছিলেন হাওড়ার ভূমিপুত্র, তখনকার সাড়া জাগানো স্পিনার অলোকদা৷ সেরা বোলিং ছিল ওই আগে বলা ৭ রানে ৭ উইকেট৷ ব্যাটে রান করেছিলেন ৫৭৫। তিনি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছিলেন ৮ টি৷
ওই সময়ের সব ক্রিকেটপ্রেমীই মনে করতে পারবেন যে কলকাতার ময়দানী ক্রিকেটে দীর্ঘদিন বড় তারকা ছিলেন অলোকদা৷ মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মোহামেডান স্পোর্টিং সমেত অনেক ক্লাবেই প্রবল দাপটের সঙ্গে খেলেছিলেন তিনি। তার শেষ ক্লাব ছিল শ্যাম বাজার৷
প্রায় ২৬ বছর কলকাতা ময়দানে উজ্জ্বল ছিলেন অলোরাউন্ডার অলোকদা। নয়ের দশকের মাঝামাঝি মধ্য চল্লিশেও লিগে ৩০ ওভার করে বল করতেন নিয়মিত৷ ১৯৯৬ সালে শ্যাম বাজারের হয়ে যখন রণদেব বসুর ক্লাব ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে, তখন সেখানকার ক্রিকেটার ছিলেন অলোকদা৷
ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছিলেন পরে, সময়ের নিয়মে। কিন্তু অলোক ভট্টাচার্যকে ক্রিকেট ছাড়েনি। খেলা ছাড়ার পর নিয়মিত আম্পায়ারিংয়ে আসেন তিনি। ক্লাব ক্রিকেটে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ বা ঘরোয়া ক্লাব ক্রিকেটের ফাইনাল মানে আম্পায়ার অলোক ভট্টাচার্যর পোস্টিং ছিল নিশ্চিত৷
তিনটে আন্তর্জাতিক ওয়ান ডেতে আম্পায়ারিং করেছেন। সেখানে একবার জহির খানকে দেওয়া তাঁর ধমকের গল্প এখনও ময়দানে ঘোরে। বাংলার নির্বাচক কমিটিতেও ছিলেন। সিএবি আম্পায়ার্স কমিটিতেও তাঁকে দেখা গিয়েছে।
৩.
১৯৭৯-৮০-তে কিম হিউজের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হাফসেঞ্চুরি করেছিলেন পূর্বাঞ্চলের অলোক ভট্টাচার্য। ছিয়াত্তরে টনি গ্রেগের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পূর্বাঞ্চলের হয়েই এমন বল করেছিলেন যে, প্রায় জাতীয় দলের ডাক পেয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। আর ফিল্ডিংয়ে বাংলা বনাম দিল্লির এক রঞ্জি ম্যাচে তিন তিনটে রান আউট করেছিলেন অলোক ভট্টাচার্য।
১৯৮০ সালে আজকের মতই এক শীতের ঠাণ্ডা সকালে ইডেনে আসিফ ইকবালের বিদায়ী টেস্টে ভরা ইডেন দেখেছিল, সুনীল গাভাস্কারের জায়গায় সাদা জার্সি পরা এক বাঙালি ক্রিকেটার ফিল্ডিং করতে নামছেন গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, কপিল দেব, সন্দীপ পাতিলদের সঙ্গে৷ সানির গলায় সেদিন ছিল মারাত্মক যন্ত্রণা৷ সেই বাঙালি তরুণ সেদিন মাঠে নেমে নজর কেড়েছিলেন দুরন্ত ফিল্ডিংয়ে৷ তিনি অলোক ভট্টাচার্য, ছিলেন ময়দানের সেই সময়ের সেরা ফিল্ডার৷
৪.
সে ছিল চার বছর আগের এক ২৫ ডিসেম্বর। বকখালি থেকে করুণাময়ী ফিরছিলাম সেদিন। দুপুর ১২টা। আমতলা ঢোকার একটু আগে একটা খাবারের রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে দুঃসংবাদটা পড়েছিলাম, সেদিনের আনন্দবাজারে। আগের দিন, ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৬৩ বছরের হৃদরোগের আক্রমণে আউট হয়ে অলোক ভট্টাচার্য চলে গিয়েছিলেন না ফেরার প্যাভিলিয়নে।খবরটা পড়ে কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন – ছোটবেলার কসম।
আমার ছোটবেলায় বাঁচার কয়েকটা মানদণ্ড ছিল। তার মধ্যে একটা মানদণ্ড ছিলেন অলোকদা। বাকসাড়ায় থাকতাম। আর চৌধুরীপাড়ায় থাকতেন অলোকদা। টেনিস বলে ক্রিকেট ম্যাচের হিরো তিনি, আমার ছোটবেলার ডায়েরীর অনেকগুলি পাতা জুড়েই ছিলেন অলোকদা। কত যে দেখেছি তার খেলা!
কোন রকম ক্রিকেটীয় কচকচি করা সেদিন অসম্ভব ছিল – ঝাপসা চোখে। কপাল খারাপ, তাই প্রসন্ন-ভেঙ্কটের সময়ে ভারতের ক্যাপ পাননি, একবার ছাড়া (দ্বাদশব্যক্তি)। সেই বড় দিনে ‘ছোট’ (কাগজের এককোণে একটুখানি) খবরটা মন ভেঙে দিয়েছিল। চুরি হয়ে গিয়েছিল আমার ছোটবেলায় বাঁচার আর একটা ‘সলিড’ মানদণ্ড।
এক তুমুল বৃষ্টির সকাল দুপুরের সন্ধিক্ষণ, বছরখানেক আগের। ১৯৭৩ সালে হাওড়ায় একটা নাইন-এ-সাইড টেনিস বল টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে এমনই অঝোর বৃষ্টি খেলাটাকে ভাসিয়ে দেবার আগে চোখের সামনে অলোকদার বোলিং গড় ছিল ৩.৪-২-৭-৫। হয়ত বৃষ্টির জন্যই সেদিন স্মৃতিতে এসেছিলেন অলোকদা। হয়ত নয়। আমার চোখ দুটো আজও ভেজা অলোক ভট্টাচার্যর স্মৃতির বৃষ্টিতে। আজও, এখনও প্রতিনিয়ত ‘স্পিন’ করান অমায়িক ব্যবহারের জন্য সুপরিচিত অলোকদা এই বাষট্টি পেরনো মনের পিচে। বাল্যস্মৃতি যে।ছাড়তেই চায় না। কিছুতেই।
২০১৬-এর ২৪ ডিসেম্বর ছক্কা মেরে অলোকদাকে জীবনমাঠের বাইরে ফেলে দিয়েছিল মৃত্যুর ব্যাট, সরকারীভাবে। যদিও আসলে অত সোজা নয় ব্যাপারটা। যতদিন আমি বাঁচব, অলোকদা থেকে যাবেন জীবন মাঠের মধ্যেই। তার বোলিংকে সঙ্গে নিয়ে। উইকেট নেবেন, ক্যাচ নেবেন, ফিল্ডিং করবেন আর সঙ্গে একটু আধটু ব্যাটিংও। আজও চোখ ঝাপসা, সব ভিজে ভিজে, ঠিক চার বছর আগের মতই। আজও সব কিছু ভোলা যায়না, ভাগ্যিস!