দুই আঙুলে গাপটিল

ক্রিকেট কেন, জীবনটাই শেষ হয়ে যেতে পারতো। মালামাল তোলার একটা গাড়ির নিচে পড়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে জীবনটা বেঁচে গেলেও লম্বা সময় হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো এবং বাম পায়ের তিনটে আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছিলো।

সুকুমার রায়কে প্রফেসর হিজিবিজবিজ বলেছিলেন- ষড়াঙ্গুল মহাশয়।

কারণ, লেখক ভদ্রলোকের এক হাতে বাড়তি একটা মিলিয়ে ছয়টা আঙুল ছিল। আমাদের মার্টিন গাপটিলের হাতে বা পায়ে, কোথাও ৬ আঙুল নেই। বরং তার বাম পায়ে আঙুলের রীতিমতো টানাটানি; কেটে ফেলার পর মাত্র দুটো আঙুল আছে। বন্ধুরা তাই বলে-দু আঙুলে; টু টো গাপটিল!

এই দু আঙুলে গাপটিল আরও একবার কোনো সোরগোল তৈরী না করে একটা রেকর্ড নিজের করে নিলেন। রোহিত শর্মাকে ছাড়িয়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ছক্কার মালিক হয়ে গেলেন গাপটিল। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫০ বলে ৯৭ রানের ইনিংস খেলার পথে আটটি ছক্কা মেরেছেন।

ভারতের রোহিত শর্মাকে টপকে যান সেদিনই। এখন ভারতের হিটম্যান খ্যাত রোহিতের টি-টোয়েন্টির আন্তর্জাতিক ময়দানে ১৩৩ টি ছক্কা। সেটাকে টপকে এখন ১৪৭ ছক্কার মালিক গাপটিল। নীরবে নীরবেই সবার ওপরে উঠে গেলেন। অথচ, সেই গাপটিলকে ছাড়াই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে যাবে নিউজিল্যান্ড। ক্যারিয়ারের শেষটা যে তিনি দেখে ফেলেছেন – এ কথা দিব্যি বলা যায়। তবুও কোনো হইচই নেই। কেন তিনি  নেই? – সেই নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ নেই।

গাপটিলের ক্যারিয়ার বিজ্ঞাপন অবশ্য এই নীরবতাই। তাঁর কোনো কিছুতেই সোরগোল নেই। তিনি মোটেও মহাতারকা নন।

রোহিত শর্মা, ক্রিস গেইলদের কথা বাদ দিন। তার নিজের দেশ নিউজিল্যান্ডের ব্রেন্ডন ম্যাককালাম বা কেন উইলিয়ামসনের তুলনায়ও তিনি একেবারে লো প্রোফাইল মানুষ। তাকে নিয়ে নিলামের আগে ফিচার হয় না, তার নামের আগে ‘হিটম্যান’ টাইপের কোনো বিশেষন বসে না। কিন্তু দিনশেষে মার্টিন গাপটিল আজকের এই মারকাটারি ব্যাটিং দুনিয়ার অন্যতম বড় তারকা।

গাপটিল নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটে উঠে এসেছেন যুব ক্রিকেট থেকে।

একেবারে ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের সাথে বেড়ে উঠেছেন। তবে ক্রিকেট কেনো, জীবনটাই শেষ হয়ে যেতে পারতো। মালামাল তোলার একটা গাড়ির নিচে পড়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে জীবনটা বেঁচে গেলেও লম্বা সময় হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো এবং বাম পায়ের তিনটে আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছিলো। এই সময় ছেলেকে সাহস দেওয়ার জন্য গাপটিলের বাবা অনেক দৌড়ঝাপ করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন তখনকার নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক স্টিভেন ফ্লেমিংকে।

কে জানতো, একদিন সেই ফ্লেমিংয়ের মতোই জাতীয় দলে খেলবেন গাপটিল!

২০০৭-০৮ মৌসুমে স্টেট শিল্ডে সর্বোচ্চ রান করেন এবং অকল্যান্ডকে ফাইনালে তোলেন। এই পারফরম্যান্সই মূলত নির্বাচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দূরন্ত ফর্মের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় দলে ডাক পান।

২০০৯ সালে সব ফরম্যাটেই অভিষেক গাপটিলের। টেস্টে খুব ভালো নন। তারপরও ৩টি সেঞ্চুরি আছে এই ওপেনারের। একটা ছোট্ট রেকর্ডও আছে। পিংক টেস্টের ইতিহাসে প্রথম বলটি খেলা ব্যাটসম্যান গাপটিল এবং প্রথম আউট হওয়া ব্যাটসম্যানও তিনি। একটু শক্ত হাতে ব্যাটিং করার প্রবনতার কারণে টেস্টে ভালো করতে পারেন না বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তিনি রীতিমতো রাজা।

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনি তৃতীয় সর্বোচ্চ, ২৭১৮ রানের মালিক। সবার ওপরে থাকা বিরাট কোহলির রান খুব দূরে নয়-২৯২৮। টি-টোয়েন্টিতেও দুটি সেঞ্চুরি আছে গাপটিলের। তবে ক্রিস গেইল বা ম্যাককালামের মতো কেনো যেনো তিনি ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের হটকেক হয়ে উঠতে পারেননি।

ওয়ানডেতেও গাপটিল অনন্য। ২০১৫ বিশ্বকাপে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে করা সেই অপরাজিত ২৩৭ রানের ইনিংস বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ। এটা ছিলো বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি; প্রথমটা ওই বিশ্বকাপেই গেইল করেছিলেন।

২০১৫ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের ফাইনালে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিলো গাপটিলের ভয়াবহ ফর্ম। ২০১৯ বিশ্বকাপের আগেও এরকম ফর্মে ছিলেন তিনি। কিন্তু বিশ্বকাপে খুব ভালো কিছু করতে পারেননি।

গাপটিল অবশ্য নিজেকে ফিরে পেতে খুব একটা সময় নেননি। তার তাণ্ডব চলছেই। আস্তে আস্তে গোপনে গোপনে যেনো এক কিংবদন্তি হয়ে উঠছেন। ক্যারিয়ারের শেষ বেলায় অন্তত এই মার্টিন গাপটিলকে কিংবদন্তি বললে কেউ হয়তো আপত্তি করবে না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...