অগ্নিরুদ্র বারুদরাজ

জীবন নামক সিনেমার বেশ খানিকটা দেখা শেষে তিনি যেন ডুব দিলেন সেলুলয়েডের দুনিয়ায়। এর আগে অবশ্য বেশ জীবনের অর্ধেক যেন পার হয়েছে সবুজের অভয়ারণ্যে। এরিক ক্যান্টোনা যেন ছিলেন সর্বত্র। প্রতিপক্ষের ডি-বক্স থেকে শুরু করে কারাগারের পেছনে। সবুজ বিস্তীর্ণ মাঠ থেকে বড় পর্দার দুনিয়ায়। ওল্ড ট্রাফোর্ডের রাজা খ্যাতিও জুটেছিল তাঁর ক্ষুদ্র ফুটবল ক্যারিয়ারে।

জীবন নামক সিনেমার বেশ খানিকটা দেখা শেষে তিনি যেন ডুব দিলেন সেলুলয়েডের দুনিয়ায়। এর আগে অবশ্য বেশ জীবনের অর্ধেক যেন পার হয়েছে সবুজের অভয়ারণ্যে। এরিক ক্যান্টোনা যেন ছিলেন সর্বত্র। প্রতিপক্ষের ডি-বক্স থেকে শুরু করে কারাগারের পেছনে। সবুজ বিস্তীর্ণ মাঠ থেকে বড় পর্দার দুনিয়ায়। ওল্ড ট্রাফোর্ডের রাজা খ্যাতিও জুটেছিল তাঁর ক্ষুদ্র ফুটবল ক্যারিয়ারে।

২৪ মে ১৯৬৬ সালে ফ্রান্সের মার্শেই শহরে জন্ম তাঁর। শহরের আর বাকি পাঁচটা ছোকড়ার মতই তাঁর প্রথম ভালবাসা ছিল শহরের সবচেয়ে বড় ক্লাব অলেম্পিক মার্শেই। ফুটবলটা যেদিন তিন ছুঁয়ে দেখেছিলেন সেদিন নিশ্চয়ই আলতো এক চুমুও এঁকে দিয়েছিলেন। শিশুরা যা করে আরকি। এরপর সময়ের পরিক্রমায় তিনি বড় হলেন। সখ্যতা বাড়তে থাকে ফুটবলের সাথে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাঁর বদ মেজাজ।

এই বদ মেজাজটাই যেন ফুটবলের সর্বকালের সেরাদের একজন হবার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবুও তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মত একটি ক্লাবের ইতিহাসে অন্যতম এক চরিত্র হয়ে রইলেন। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন যখন নতুন করে রেড ডেভিলদের সাজিয়ে তোলার কাজটি করছিলেন, ঠিক তখনই নায়ক হওয়ার সুযোগের হাতছানি এরিক ক্যান্টোনার সামনে। সুযোগটা হাতছাড়া করেননি ক্যান্টোনা।

লাল জার্সিটা গায়ে জড়িয়ে তিনি ‘থিয়েটার অব ড্রিম’ খ্যাত স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায় পা রেখেছিলেন। এর আগে অবশ্য লম্বা একটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল তাঁকে। সে পথের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ফ্রান্স। জন্মই তো সেখানে। চাকুরিজীবী বাবা-মা তাঁর। তিন ভাইয়ের দ্বিতীয়জন তিনি। তবে এই যে শিল্পের প্রতি যে তাঁর ঝোঁক সেটা ছিল তাঁর ডিএনএ-তে।

বাবা হাসপাতালে কাজ করার পাশাপাশি আঁকিবুঁকি করতেন সখের বসে। অন্যদিকে, মা পেশাগতভাবেই করতেন পোশাক ডিজাইন। সুতরাং এটা অবধারিতই ছিল যে তিনি শেষ জীবনে শিল্পের পথে ধাবিত হবেন। সে অন্য আলাপ। তবে মূল আলাপের শুরুটা তিনি করেছিলেন পনেরো বছর বয়সেই।

স্থানীয় এক ক্লাবের হয়ে গোলবারের নিচের দায়িত্বে শুরু তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার। তবে কালের বিবর্তনে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে। বছর পাঁচেকের মধ্যেই তিনি পেশাদার ফুটবলের আঁচ পেতে শুরু করেন। ফ্রান্সের ক্লাব অক্সেরে নামক ক্লাবের হয়ে পেশাদার ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু করেন।

সম্ভাবনাময়, ধূর্ত, আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় খুব বেশি সময় নেননি আলোচনায় চলে আসতে। কুড়ি বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান, ম্যাচও খেলে ফেলেন। অক্সেরেতে থাকার সময়ই নানান বিতর্কের জন্ম দিতে শুরু করেন ক্যান্টোনা।

বিতর্কের পুরোটা জুড়েই রয়েছে তাঁর বদমেজাজ। একেবারে ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ, তিনি জড়িয়েছেন নিজেকে বহু হাতাহাতির কাণ্ডে। সতীর্থ থেকে প্রতিপক্ষ। এমনকি দর্শকদেরওকে মারধর করার মত বাজে কাজটা তিনি করেছেন বারংবার।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি গায়ে তিনি সবচেয়ে আলোচিত কাণ্ডটাই করেছিলেন। কুংফু স্ট্রাইলে তিনি গ্যালারিতে থাকা এক দর্শককে প্রথমে লাথি মারেন, এরপর একের পর এক ঘুষি মারতে থাকেন সে দর্শককে। এর আগেই অবশ্য ক্যান্টোনি দেখেছিলেন লাল কার্ড।

যার জন্য তাঁকে যেতে হয়েছে চৌদ্দ শিকের পেছনে। ১২০ ঘন্টা করতে হয়েছে কমিউনিটির সেবা। এমন আরও বহুকারণে তাঁকে বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কার করা হয় ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে। তবে একমাত্র তাঁর ফুটবল মাঠের দুর্দান্ত পারফরমেন্স ও তার শৈল্পিক ফুটবল দক্ষতার কারণে তিনি খানিক ছাড় পেয়ে গেছেন। এই উ-শৃঙ্খলতার কারণেই তিনি ছেড়েছিলেন স্বদেশের ক্লাব ফুটবলকে।

সেবার পুরো ফুটবল ফেডারেশন ও লিগ কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে চলে যায়। দুই মাসের নিষেধাজ্ঞার মাথায় নিয়ে ক্যান্টোনা চলে যান ইংল্যান্ডে। অবশ্য সেটা তিনি করেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত মনোবিশ্লেষকের পরামর্শে। শুরুতে তিনি লিডস ইউনাইটেডের হয়ে খেলেন এক মৌসুম। এরপর সেখানেও সেই শৃঙ্খলার দায় মাথায় নিয়ে তিনি চিঠি দেন ক্লাব কর্তৃপক্ষকে। ক্লাব ছেড়ে দেওয়ার চিঠি।

ঠিক সে সময় হারের বৃত্তে ক্রমাগত ঘুরতে থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বেশ কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজছিল। আর স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের জহুরির চোখে এরিক ক্যান্টোনা আটকে যান। ব্যাস এরপর তো তিনি রীতিমত চলে আসেন রেড ডেভিল ডেরায়। ক্যান্টোনা আসার পর মাত্র দুইটি ম্যাচ হেরেছিল রেড ডেভিলরা।

তিনি গোল করেছেন, তিনি গোল করিয়েছেন। আর হাতে তুলে নিয়েছিলেন প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা। তিনি ভক্তদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। এমনকি ক্লাব কর্তৃপক্ষেরও বেশ পছন্দের একজন ছিলেন তিনি।

নব্বই দশকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের উত্থানের পেছনে তাঁর অবদান কোন ভাবেই হয়ত অস্বীকার করবার উপায় নেই। বরং সমর্থকরা তাঁকে নিজেদের রাজা বলেই আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি হয়ত খুব বেশি গোল করেননি ক্লাবটির হয়ে। কিন্তু তিনি খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। সে গুণের কারণেই তাঁকে রাজা আখ্যা দিতেও দ্বিধা করেনি রেড ডেভিল সমর্থকরা।

তবে সবাইকে খানিক চমকে দিয়ে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই ফুটবলকে বিদায় বলে দেন। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে নিজেদের এই রাজাকে বিদায় বলেছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সমর্থকেরা। এরপর তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন সিনেমা জগতে। কখনো অভিনেতা, কখনো পরিচালক আবার কখনো প্রযোজক হিসেবে ক্যান্টোনার জীবন কেটে যাচ্ছে ফুটবল থেকে বহু দূরে। থিয়েটার অব ড্রিম থেকে তাঁর ঠিকানা এখন সত্যিকারের রূপালি জগৎ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...