সাল ২০১৬। মধ্য জুলাইয়ের কোন এক সন্ধ্যায় অনুশীলনের প্রথম দিনটা শেষ করে ঘরে ফিরলেন ছোট্ট ইতি খাতুন। দেখলেন বসার ঘরে দারুণ জনসমাগম। কারণ কী? ফুপুকে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর না দিয়ে বললেন সেজেগুজে অতিথিদের সামনে যেতে।
গুরুজনের আদেশ শিরোধার্য্য। সেজে গুজে যখন সবার সামনে গেলেন, বুঝতে বাকি রইলো না পাত্রপক্ষ এসেছে তাকে দেখতে! শৈশব পেরিয়ে সদ্যই কৈশোরে পা দেয়া ইতির মাথায় তখন রীতিমতো বিনামেঘে বজ্রপাত! বাল্যবিবাহের কারণ তো আছেই, ছিলো স্বপ্নভঙ্গের ভয়ও।
মাত্র কিছুদিন আগেই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রমে সবাইকে হারিয়ে হয়েছিলেন সেরা। ডাক পেয়েছিলেন টঙ্গীর আর্চারি ক্যাম্পে, যেখানে একই সঙ্গে অনুশীলন করে বাংলাদেশ জাতীয় দলও! ইতির সামনে তখন অবারিত সম্ভাবনার হাতছানি, তা কিনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবার জোগাড়!
স্বপ্নের ছিনতাই হওয়া ঠেকাতে পরদিনই ছুটলেন শ্রেণীশিক্ষক ‘সোহেল স্যার’ এর কাছে। ঘটনা জানাতেই স্কুলে ডাক পড়লো বাবা ইবাদত হোসেনের। সোহেল স্যারসহ বাকি সব শিক্ষক বোঝালেন ক্যাম্পে ডাক পাওয়ার গুরুত্ব আর সম্ভাবনা, বাবাও কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে মেয়েকে সম্মত হলেন ঢাকায় পাঠাতে।
ইতির আর্চারিতে আসা হতো না আরেকটা কারণেও। ছোট বেলা থেকেই ডানপিটে ইতি অ্যাথলেট হিসেবেও ছিলেন সবার সেরা। স্কুল পর্যায়ে ফি বছর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দৌড়, হাইজাম্প আর লংজাম্পের একটা করে পদক রীতিমতো নিজস্ব সম্পত্তিই ছিল তার। সে স্মৃতি রোমন্থনে ইতি বলেন, ‘সেই ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলায় ঝোঁক ছিল আমার। সে সময়ে কোন বছর পার করিনি যেবার স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌড়, হাইজাম্প আর লংজাম্পে একটা করে পদক জিতিনি। সেসব এখনো আমাদের শো-কেসে শোভা পায়।’
খেলতেন হ্যান্ডবলও! আর্চারির প্রতিভা অন্বেষণে নাম লেখানোর সপ্তাহ খানেক আগে স্কুলের হয়ে স্থানীয় এক টুর্নামেন্টে খেলে এসেছিলেন। তবে উচ্চতা পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলো তার। তাই আর দৌড়, হাইজাম্প, লংজাম্প কিংবা হ্যান্ডবল কোর্ট মাড়ানো হয়নি চুয়াডাঙ্গার মেয়ে ইতির। তার ভাষায়, ‘অ্যাথলেটিক্সে উচ্চতা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে ছিলাম বলে অ্যাথলেটিক্সে যাওয়া হয়নি।’ ভাগ্যিস সেসবে যাননি! নাহলে কি আর এসএ গেমসে দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী খেলোয়াড় হিসেবে তিন সোনা ঝুলিতে ভরা হতো?
অনিশ্চয়তা শেষ করে যখন ঢাকায় পা রাখলেন, তার পরের গল্পটা একের পর এক স্বপ্ন সত্যি হবার। টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে যতদিনে অনুশীলন শুরু করেছেন, জাতীয় দলও অনুশীলন করতো হাতছোঁয়া দূরত্বে। জাতীয় দলে ঢোকার স্বপ্নটা মনের কোণে বুনতে শুরু করেন তখন থেকেই। পায়ের তলায় শক্ত মাটি খোঁজার তাগিদটাও ছিল সমানভাবেই।
এ কারণেই হয়তো, পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। খুব তাড়াতাড়িই ধরা দেয় জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের পদক। ২০১৮ সালে নবম জাতীয় আর্চারিতে তীরন্দাজ সংসদের হয়ে নারী রিকার্ভ এককে জেতেন ব্রোঞ্জপদক; যে বাবা বছর দুয়েক আগে বিয়েই দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সে বাবাকে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে রেখেই!
বাবাকে সন্তুষ্ট করেছিলেন বটে, কিন্তু যার চোখে দেশের নাম অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন, তার মন এতো অল্পেতে তুষ্ট হয় কী করে? ইতিরও হলো না। দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতা এসএ গেমস পদকের স্বপ্নকে সামনে রেখে প্রস্তুতির পালে দিলেন জোর হাওয়া। ইতির কথায়, ‘জাতীয় আর্চারিতে যখন ব্রোঞ্জ জেতার পর বাবার কাছে এসে দেখি তিনি আবেগাপ্লুত! পরে এলাকায় গিয়েও দেখলাম রীতিমতো তারকাখ্যাতি পেয়ে গেছি। তবে তখন থেকেই আমার মনে এসএ গেমসের স্বপ্ন ছিল, সেটা মাথায় রেখেই নিজেকে একটু একটু করে প্রস্তুত করে নিচ্ছিলাম।’
তবে এসএ গেমস স্বপ্ন সত্যি করতে আগে জাতীয় দলে ঢোকার চ্যালেঞ্জ ছিল, সে চ্যালেঞ্জে উতরে গেলেন। এসএ গেমসের আগে থাইল্যান্ডে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ আর্চারিতেও গেলেন। তবে তাতে হিতে বিপরীতই হয়েছিলো।
ইতি বলেন, ‘থাইল্যান্ডে গিয়ে যতোটা অনুশীলনের সুযোগ পাওয়া গিয়েছিলো তা পর্যাপ্ত ছিল না একদম। তার উপর ছিল আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার পরীক্ষা। সবকিছু মিলিয়ে পারফর্ম্যান্স পড়ে গিয়েছিলো। যার ছাপ পড়েছিলো গেমসের শুরুর দিকেও।’
তবে ইতি মানিয়ে নিলেন। রিকার্ভ এককের প্রথম বাছাইপর্বে আশানুরূপ ফল না পেলেও চূড়ান্ত বাছাইয়ে হয়ে গেলেন প্রথম। স্বপ্নের পালে জোর হাওয়া লাগে তখন।
এরপর গেমসে তুলে নিলেন নারী দলগত আর মিশ্র দলগত’র স্বর্ণপদক। তবে ব্যক্তিগত এককের ফাইনালে হল বিপত্তি। বড় আসরে একক ফাইনালে সেটাই ছিল এ আর্চারের প্রথম। ইতির ভাষায়, ‘কিছুটা স্নায়ুচাপ ছিল। শুরুর দিকে তাই হারার পর্যায়েই চলে গিয়েছিলাম। তবে এরপর জিয়া স্যার (সহকারী কোচ জিয়াউল হক) এসে বললেন আমার নিজস্ব পদ্ধতিটাই অনুসরণ করতে। সেটাই কাজে দিলো।’
বাঁধা পেরিয়ে তৃতীয় স্বর্ণপদকটাও জিতলেন ইতি। সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসও এসে লুটিয়ে পড়ে তার পায়। দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী খেলোয়াড় হিসেবে কোন গেমসে তিনটি স্বর্ণপদক জয়ের কীর্তি গড়েন তিনি।
জাতীয় দলে ঢোকার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, এরপর এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জয়ের লক্ষ্যও পূরণ হয়ে গেছে। এবার আরও বড় লক্ষ্য সামনে, অলিম্পিকে উত্তরণ। রোমান সানার দেখানো পথ ধরে প্রথম নারী আর্চার হিসেবে অলিম্পিকে সরাসরি খেলার স্বপ্নে বিভোর ইতি। বললেন, ‘এখন আমার লক্ষ্য অলিম্পিকে খেলার। রোমান ভাই যেটা করে দেখিয়েছেন সেটা আমাদের জন্য একটা বড় অনুপ্রেরণা। তবে নারীর একক থেকে এখনো কেউ অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করতে পারেনি। আমি এক্ষেত্রে প্রথম হতে চাই। দেশের প্রথম নারী খেলোয়াড় হিসেবে অলিম্পিকে নাম লেখাতে চাই।’
অল্প বয়সেই পরিবারের সিদ্ধান্ত, সমাজের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে যিনি ভবিষ্যৎ গড়তে পারেন, তার কণ্ঠে এমন আশাবাদ, অমূলক কিছু বলে মনে হয়না মোটেও।