আমি পেলের খেলা দেখিনি। লেখাটা যারা পড়ছেন হয়ত তাঁদেরও কেউই দেখে নাই। আমরা কেউ ডি স্টেফানো কিংবা পুসকাস এর খেলাও দেখি নাই। বুঝতে শুরু করার পর আমরা শুনেছি পেলেকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার বলা হয় এবং ম্যারাডোনার সাথে এক্ষেত্রে তার সাথে প্রবল প্রতিদ্বন্দীতা আছে।
১৯৯৮ সালের কথা, আমি প্রথম বিশ্বকাপ দেখলাম সে বছর। ম্যারাডোনার খেলা ছাড়ার মাত্র চার বছর হলো, আর তখনই পেলে নাকি ম্যারাডোনা বিতর্কটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। কমন সেন্স বলে, পেলে ম্যারাডোনা বিতর্কতা হয়ত ৮৬ বা ৯০ তেই শুরু হয়েছিল। পেলের আগমনের পর পেলে বনাম ডি স্টেফানো কিংবা পেলে বনাম পুসকাস বলে কিছু ছিলনা। ছিল না ইউসেবিও বনাম পেলে। তখন হয়ত সর্বকালের সেরা টার্মটাই আসে নাই।
১৯৭০ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্তও পেলের বিশ্বকাপ ছিল দুইটা, একটাতে খেলেছে শুধু এক ম্যাচ। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত গারিঞ্চার জাতীয় দলের অর্জন পেলের চেয়ে ঢের বেশি। যদিও ৬০’এর দশক পুরাটাই পেলে সান্তোসের হয়ে পুরা বিশ্ব রাজত্ব করেছে। দক্ষিণ আমেরিকাতো বটেই, ইউরোপেও পেলের সান্তোস সফল ছিল। কিন্তু তারপরও পেলের তখনো বিশ্বকাপ দুইটা। মাঝখানে দুই বিশ্বকাপে পেলের উল্লেখ করার মত তেমন কিছুই নেই। তাহলে কোন জিনিসটা পেলের শ্রেষ্ঠত্বকে এতটা প্রতিষ্ঠিত করেছে। আসলে এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে থিসিস করতে হবে।
অনেকে অনেক থিওরি তৈরি করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আজকেও যে শিশুটা জন্মগ্রহণ করল সে যখন ২০২৬ বিশ্বকাপ দিয়ে ফুটবলের উত্তাপে পা দিবে তখন সে জানবে পেলে-ম্যারাডোনা সর্বকালের সেরা ফুটবলার। আরো স্পেসিফিকভাবে, পেলে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়। আসলে এটা একটা কিংবদন্তি যে ‘পেলেই সর্বকালের সেরা’। পেলের চেয়ে আরো যোগ্য খেলোয়াড় থাকতে পারে ইতিহাসে, কিন্তু তাদের কেউ পেলে না। পেলে পুরা পৃথিবীর, মুহাম্মদ আলী যেরকম। পেলেই হয়ত ফুটবলের প্রথম সুপারস্টার।
১৯৫৮ সালের ব্রাজিল কিন্তু অনেকটা ৯৮-এর ক্রোয়েশিয়ার মত। আন্তর্জাতিক লেভেলে ব্রাজিল তখনো পরিচয়ের মাধ্যম খোজছে। একটা বিশ্বকাপই পারে সেই কাজটাকে সহজ করতে। ৫০ এর স্মৃতি তখনো একেবারে কাঁচা। একটুর জন্য হাতছাড়া হয়েছিল স্বপ্নের ট্রফি। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই অপূর্ণতা পূরণ হয় ৫৮ তে। আমার মনে হয় পেলের ‘সর্বকালের সেরা – পেলে’ হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে ৫৮ বিশ্বকাপ।
কয়েকটা ফ্যাক্টর, যেমন- প্রথম বারের মত ব্রাজিল বিশ্বকাপ জেতে, আর সেই জয়ের নায়ক ক্ষুদে পেলে। ১৭ বছর বয়স, ফাইনালে দুই গোল, সেমিফাইনালে হ্যাটট্রিক, কোয়ার্টারে দুই গোল এবং বিশ্বকাপ জয়। এই সব মিলিয়ে পেলের বিশ্বমঞ্চে আগমন সত্যিকার নক্ষত্রের বিস্ফোরণের মত। মানুষ জেনেছে ব্রাজিলকে জিতিয়েছেন পেলে।
সেই শুরু। পেলের সাথে গারিঞ্চার মূল পার্থক্য হল, পেলে তারা শ্রেষ্ঠত্বের সঠিক বিপণন করতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু একই লেভেলের খেলোয়াড় বা তর্কসাপেক্ষে ভাল খেলোয়াড় হয়েও গারিঞ্চা সেটা করতে পারেনি বলেই ৬২-তে পেলেবিহীন ব্রাজিলকে অনেকটা একক নৈপূণ্যে চ্যাম্পিয়ন করিয়েও পেলের পাশে গারিঞ্চার নাম আসেনা, কিন্তু ম্যারাডোনার নাম আসে কারণ হয়ত পেলের মত করে ম্যারাডোনাও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের বিপণনটা করতে পেরেছে।
সেটা যাই হোক। আজকে ২০১৭ সালে এসেও সেটাই হচ্ছে যেটা ১৯৯৮ তে দেখেছিলাম। পেলে ম্যারাডোনাই সর্বকালের সেরা, ওইটা একটা লেভেল। ওখানে যেতে হলে স্পেসিফিক অর্জন লাগে। যেগুলার কাছাকাছি হয়ত অনেকে গিয়েছে, কিন্তু ঠিক ওখানে যেতে নতুন কিছুই করতে হবে।
পেলের শুরুটা নিয়ে কথা বলছিলাম। এবার একটু ভিন্ন আলোচনা। জিদানের কথা মনে আছে কার? জিদান কিন্তু ২০০৪ ইউরোর পর অবসর নিয়েছিল জাতীয় দল থেকে। যাস্ট ক্যারিয়ারের একটা সাইকেল শেষ, তাই সে অবসর নিসে, বয়সও ৩২। কিন্তু দলের দূর্দিনে অবসর থেকে ফিরে স্মরণীয় একটা বিশ্বকাপ উপহার দিল জিজু আর সর্বকালের সেরার লিস্টে এক লাফে টপ টেন বা টপ ফাইভে চলে আসল ফ্রেঞ্চম্যান।
২০০৪ সালে অবসর নেয়া জিদান আর ২০০৬-এ অবসর নেয়া জিদানের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ওইবার যদি ফ্রান্স ইউরোও জিত তাও ২০০৬ এ অবসর নেয়া জিদানই আজকের জিদানকে ডিফাইন করে। মানুষের মনে শেষ দাগটা কেটেই ফুটবাল ত্যাগ করেন।
এবার সময়টাকে ১৯৭০ সালে নিয়ে যান। পেলে তাঁর ‘চতুর্থ’ বিশ্বকাপ খেলতে গেল। আগের দুই বিশ্বকাপে মানুষ সত্যিকার পেলে কে দেখেনি। অথচ ওই সময়টাতে পেলে ছিল সেরা ফর্মে। বিশেষ করে ৬২-এর পেলে ছিল সত্যিকারের সর্বকালের সেরা ফুটবলার। সেই পেলেকে বিশ্বকাপে খেলতে না দেখার আফসোসতো অনেক আগের।
মানুষ পেলের ব্যাপারে বিতর্ক তৈরি করতে তখনকার অফসাইড রুলের কথা নিয়ে আসে। কিন্তু কখনো এটা উঠে আসেনা যে তখন হলুদ কার্ড লালা কার্ডের প্রচলনও ঠিকমত ছিলনা। স্ট্রাইকারদের তখন অনেক বিপদজনক ট্যাকেল করতে পারত ডিফেন্ডাররা। আর সেই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় হয় ১৯৬৬ বিশ্বকাপে।
পর্তুগালের প্রচণ্ড ফিজিক্যাল ট্যাক্টিক্স ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেয় গ্রুপ থেকে, পেলেও মাঠ ছাড়ে দুই ফিজিওর কাঁধে চড়ে। এরপর পেলে সাময়ীকভাবে অবসরও জাতীয় দল থেকে ফিজিক্যাল খেলার উপর বিরক্ত হয়ে। কিন্তু বিশ্বকাপে পেলেকে আরেকবার না দেখলে মনে জীবনটা অপূর্ণ থেকে যাবে। আর সেজন্যই ১৯৭০ বিশ্বকাপটা ছিল পেলে সবার কাছে অনন্য হওয়ার পিছনে বড় কারণ।
সেই কবে ৫৮-তে পেলেকে খেলতে দেখেছিল বিশ্ববাসী। এবার কি দেখা হবে আসল পেলে কে? পেলে তার সতীর্থদের কাছে আজীবন ঋণী হয়ে থাকবে ৭০ এর বিশ্বকাপের জন্য। এবার ২০০৬ এর জিদানের মত করে পেলে কে মিলিয়ে নিন। নিজের শেষ বিশ্বকাপ, বয়স ৩০ পার হয়েছে। দলের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য। এই অবস্থায় ব্রাজিলকে নিয়ে জিতলেন নিজের তৃতীয় বিশ্বকাপ। ১৭ বছর বয়সে যেই ছোকরা সবার আলো কেড়ে নিয়েছিল সে এবার অভিজ্ঞদের একজন হয়ে এসে জাতীয় দলকে উপহার দিলেন আরেকটি বিশ্বকাপ। আর সেই সাথে সবাইকে কাঁদিয়ে হলুদ জার্সিও পড়লেন শেষবারের মত।
কোনো খেলোয়াড়, যাকে অলরেডি সর্বকালের সেরা বলা যায়, সে বিদায় নিল বিজয়ী হয়ে। আমার মনে হয়, ৭০ এর আগ পর্যন্ত পেলেকে নিয়ে যে হাইপ সৃষ্টি হয়েছিল সেটার সত্যিকার বাস্তবায়ন হয় ৭০ এ, আর এই কারণে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে পেলের কোন বিকল্প কেউ তৈরি করতে পারেনি ফুটবল বিশ্ব। বর্তমানে মেসি কিংবা রোনালদো এখন এমন একটা পজিশনে আছে – যদি তারা একটা বিশ্বকাপ জিতাতে পারে নিজ দলকে তারা অনায়াসে পেলে ম্যারাডোনার জায়গাটা নাড়িয়ে দিবে। পেলের ৫৮ আর ৭০ এর বিশ্বকাপ ছিল ওইরকম দুইটা ঘটনা।
আমাদের সৌভাগ্য আমরা পেলেকে জীবিত দেখেছি। ফুটবলের প্রতিশব্দ পেলে। পেলে কে বাদ দিয়ে ফুটবল অস্পূর্ণ। এতক্ষণ যা লিখেছি তাতে একটা সাধারণ ফুটবল ভক্তের দৃষ্টকোণ থেকে পেলের সর্বকালের সেরা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের একটা থিওরি উপস্থাপন করলাম। খেলোয়াড় হিসেবে পেলে কেমন সেটা আসলে আর্টিকেল পড়ে বা ভিডিও দেখে সত্যিকারভাবে আমরা কখনোই বুঝতে পারবনা। তবে পেলেকে নিয়ে পেলের সময়ের বা তার পরের বেশ কিছু ফুটবল কিংবদন্তির কিছু উক্তির দিকে তাকালেই আন্দাজ করতে পারব খেলোয়াড় হিসেবে পেলে আসলে কেমন ছিলেন।
‘আমার দেখা সবচেয়ে পরিপূর্ণ খেলোয়াড় পেলে।’
– ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, জার্মানির বিশ্বকাপজয়ী কোচ-অধিনায়ক
‘খেলা শুরুর আগে আমি নিজেকে বলেছিলাম, সে সবার মতোই রক্তমাংসে গড়া মানুষ – কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।’
– তারসিসিও বুর্জনিখ, ১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালে যিনি পেলেকে মার্ক করেছিলেন
‘আমার চোখে শিল্পি হচ্ছে সে যে একটি অন্ধকার ঘরকে আলোকিত করতে পারে। আমি কখনো এবং কোনভাবেই ১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালে কার্লোস আলবার্তোকে দেয়া পেলের পাসের সাথে তরুণ রিমবুডের কবিতার কোন পার্থক্য খোঁজে পাইনা। এই মানুষগুলোর প্রতিটি সৃষ্টিই ছিল সৌন্দর্যময় যা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় এবং আমাদের মধ্যে একধরণের অমরত্বের অনুভূতি জাগায়।’
– এরিক ক্যান্টোনা, ফ্রান্স
‘আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ফুটবল এই যাদুকরি খেলোয়াড়ের জন্য আবিষ্কৃত হয়েছেI’
– স্যার ববি চার্লটন, ইংল্যান্ড
‘পেলে একমাত্র ফুটবলার যে যুক্তির গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছিলেন।’
– ইয়োহান ক্রুইফ, নেদারল্যান্ডস
‘সর্বকালের সেরা কে? পেলে। মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো দুজনেই কিছু নির্দিষ্ট গুণে সেরা প্লেয়ার, কিন্তু পেলা বেটার।’
– আলফ্রেড ডি স্টেফানো, আর্জেন্টিনা-স্পেন
‘আমরা একসাথেই বলটাকে হেড করতে লাফ দিয়েছিলাম। আমি ওর চেয়ে লম্বা ছিলাম, আমার দমও ভাল ছিল। আমি যখন নিচে পড়ে তাকালাম তখন অবাক হয়ে গেলাম। পেলে তখনো বাতাসে ছিল, বলে হেড করছিল। মনে হচ্ছিল সে বাতাসে যতক্ষণ খুশি ভেসে থাকতে পারতো।’
– জিয়াসিন্তো ফাচেত্তি, সাবেক ইতালিয়ান ডিফেন্ডার
‘যখন আমি পেলেকে খেলতে দেখলাম, আমি অনূভব করছিলাম আমার বুটজোড়া তুলে রাখা উচিত।’
– জাঁ ফন্টেইন, ১৯৫৮ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা
‘পেলে ছিল সবার সেরা, যে ছিল স্টেফানো, ম্যারাডোনা, ক্রুইফ এবং মেসির মিশ্রণ।’
– সিজার লুই মেনত্তি – আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী কোচ
‘পেলে ছিল আমার দেখা সবচেয়ে পূর্নাঙ্গ খেলোয়াড়। দুই পায়েই দুর্দান্ত। বাতাসে ছিল যাদু। দ্রুতগতির। শক্তিশালী। অন্যকে স্কিল দিয়ে পরাস্ত করতে পারতো। অন্যকে ছাপিয়ে যেতে পারতো। মাত্র ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা, তারপরও তাকে দেখে মনে হতো মাঠে যেন এক দানব। নিখুঁত ভারসাম্য এবং অবিশ্বাস্য ভিশন। ’
– ববি মুর, ইংল্যান্ড
‘আশা করেছিলাম যে আমি বোধয় একজন মহান খেলোয়াড়কে থামাতে এসেছি, কিন্তু আমি নিজেকে আশ্বস্ত করেছি যে আমি এমন একজনের কাছে পরাজিত হয়েছি যে কিনা এই গ্রহের কেউ না।’
– বেনফিকা গোলরক্ষক কস্তা পেরেইরা, পেলের সান্তোসের কাছে ৫–২ এ হারের পর।
‘পেলের একটা রূপ ছিল মানুষ, আরেকটা ছিল খেলোয়াড়। এবং পেলের মতো খেলা মমানে ছিল ঈশ্বরের মতো খেলা।’
– মিশেল প্লাতিনি, ফ্রান্স
‘মেসির সেরা হবার সবগুলা গুণই রয়েছে, তাকে আগে ম্যারাডোনা, রোমারিওকে হারাতে হবে, এরপর আসবে পেলে।’
– রোমারিও, ব্রাজিল
‘পেলের ফুটবল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়, এবং পৃথিবীতে শুধু একজন পেলেই থাকবে।’
– ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, পর্তুগাল