লঙ্কান ক্রিকেটার ভানুকা রাজাপাকশের চকলেট ভীষণ পছন্দ। চকলেট বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও আবার চুজি তিনি। ডার্ক চকলেট তেমন একটা পছন্দ করেন না, মিল্ক চকলেট পেলেই সব ভুলে যান। আর এমন অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যভাসের কারণেই লঙ্কান এ ক্রিকেটারের ফিটনেসের বেহাল দশা হয়েছিল।
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। শ্রীলঙ্কার কোচ তখন মিকি আর্থার। প্রোটিয়া এ কোচ বরাবরই খেলোয়াড়দের ফিটনেসের ব্যাপারে অতিমাত্রায় সচেতন। চকলেটপ্রিয় ভানুকা রাজাপাকশের তাই মিকি আর্থারের চক্ষুশূল হতেও সময় লাগলো না।
একবার তো প্রকাশ্যেই এ কোচ বলেই বসলেন, ‘আমার আসলে ফিটনেস নিয়ে অসচেতন ক্রিকেটারদের পছন্দ নয়। এই যেমন ভানুকা রাজাপাকশে। তাঁর অবস্থাটা দেখুন। শরীরে চর্বি জমেছে। আর এ কারণে ওর ফিল্ডিং স্ট্যান্ডার্ডও খুবই বাজে অবস্থায় রয়েছে।’
সে সময়েই মিকি আর্থারের কড়া হুশিয়ারিতে লঙ্কান বোর্ড দলে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে ফিটনেস টেস্টের একটা মানদণ্ড প্রকাশ করল। যেখানে ক্রিকেটারদের শরীরে ফ্যাট পার্সেন্টেজ পরিমাপ করার জন্য স্কিনফোল্ড টেস্ট করা হবে, আর দুই কিলোমিটার রানিং টেস্ট নেওয়া হবে। আর সেই দুটি টেস্টের ক্ষেত্রে, স্কিনফোল্ডের জন্য সর্বোচ্চ ৮০ স্কোর আর ২ কিলোমিটার রানিং শেষ করার জন্য ৮ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড সময় বেঁধে দেওয়া হল।
এমন শর্ত শুনে তো ভানুকা রাজাপাকশের মাথায় হাত! লঙ্কান এ ক্রিকেটারের তখন স্কিনফোল্ড টেস্টে স্কোর ১০৪! এমতাবস্থায় দলে জায়গা ধরে রাখতে হলে তাঁকে এক মাসের মধ্যে সেই স্কোর ৮০ তে উন্নীত করতে হবে। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে তা এক প্রকার অসম্ভবই বটে।
কিন্তু দলে জায়গা ধরে রাখতে হলে সেই অসম্ভব পথেই তো হাঁটতে হবে। তো সেই লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কার ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে ক্রীড়া প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করা নাইজেল অ্যারনের শরণাপন্ন হলেন রাজাপাকশে। প্রথম দেখাতেই বললেন, ‘আমাকে দিয়ে কি সম্ভব?’ নাইজেল অ্যারন খুব বেশি যে অনুপ্রাণিত করলেন তা নয়। বরং এক প্রকার সতর্কবাণী দিয়েই বললেন, ‘সম্ভব। তবে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। না হলে কিছুই হবে না।’
ভানুকা রাজাপাকশে এর আগে কখনোই দীর্ঘ সময়ের জন্য ফিটনেস ক্যাম্প করেননি। কিন্তু নিজের পায়ের তলার মাটিটা টিকিয়ে রাখতে হলে সেই দু:সাধ্য সাধন তো তাঁকে করতেই হবে। তাই রাজাপাকশে কোনো প্রকার ভাবনায় না গিয়ে নাইজেল অ্যারনের সাথে ফিটনেস ক্যাম্প করার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে শ্রীলঙ্কার জিম ফ্যাসিলিটিজ ব্যবহারের তখন সুযোগ নেই। তাই নিজের ফিটনেস ক্যাম্পটা অনেকটা ঘরোয়াভাবেই করতে হলো রাজাপাকশেকে।
নাইজেল অ্যারনের ভাষ্যমতে, ‘তাঁর বাড়িতে সব সরঞ্জাম ছিল না। তবে স্থুলকায় দেহ নিয়েও রাজাপাকশের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। সে সব সময় যে কুলিয়ে উঠতে পারতো তা নয়। তবে সময় নিয়ে হলেও দিনের সব এক্সারসাইজ সম্পন্ন করতো। ঐ এক মাসে আমরা মজাদার কিছু ড্রিলও করি। যেমন ভ্যান ধাক্কা দিয়ে নিয়ে যাওয়া, দৌড়ানো- সব কিছুই আমার নির্দেশনা অনুযায়ী ও করতো। হ্যাঁ। প্রথম দুইদিনে ও ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। তবে তাঁর চেষ্টার কমতি ছিল না।’
ভানুকা রাজাপাকশের এই প্রবল চেষ্টার কারণেই তিনি পরবর্তীতে ফিটনেস পরীক্ষায় উতরে যান। এক মাসের মধ্যে তাঁর ওজন ১২ কেজি কমে ৯৪ থেকে ৮২ হয়। আর এরপরে স্কিনফোল্ড টেস্টে তিনি স্কোর তোলেন ৭১। একই সাথে নির্ধারিত ৮ মিনিট ৩৩ সেকেন্ডের মাঝেই তিনি ২ কিলোমিটার রানিং সম্পন্ন করেন। ফলত, আনফিট রাজাপাকশে ঐ এক মাসের পরিশ্রমে নিজের ফিটনেসে অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়ে ভারতের বিপক্ষে পরের সিরিজেই নিজের জায়গা ধরে রাখতে সক্ষম হন।
এরপরেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দারুণ এক মোড় আসে রাজাপাকশের। ক্রমেই ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের পরিচিত মুখ হতে শুরু করেন তিনি। এর মাঝে সংযুক্ত আরব আমিরাতে হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একটি ম্যাচের ম্যাচসেরাও হলেন তিনি। এরপর, আবু ধাবি টি টেন লিগে দেখান নিজের বিধ্বংসী রূপ। ছক্কার মারার সহজাত সক্ষমতায় নজরে পড়লেন দ্রুতই।
সেই ধারাবাহিকতায় আইপিএলের দল পাঞ্জাব কিংসের কোচ অনিল কুম্বলের চোখে পড়লেন রাজাপাকশে। লঙ্কান এ ব্যাটারের ছক্কার সৌন্দর্য্যে কুম্বলে এতটাই অভিভূত হলেন যে, পরের মৌসুমেই তাঁকে দলে ভেড়ানোর প্রস্তুতি নিলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন ব্যাটিং কোচ জুলিয়ান উড। তিনি বললেন, ওর ফিটনেস ঠিক আপ টু দ্য মার্ক নয়।
কিন্তু কুম্বলে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়ই থাকলেন। তিনি বললেন, ‘ওর ফিটনেস কেমন দেখার বিষয় না আমার। ও ছক্কা মারতে পারে, এটাই আমার দরকার।’
কুম্বলের এমন একরোখা সিদ্ধান্তে ভাগ্য খুলে গেল ভানুকা রাজাপাকশের। ২০২২ আইপিএলে সুযোগ পেলেন তিনি। আর সেই আইপিএল আরেকজনের সর্বনাশায় পৌষমাস হয়ে আসল রাজাপাকশের। ইংলিশ ক্রিকেটার জনি বেয়ারস্টো ইনজুরির কারণে সেবারের আইপিএল থেকে ছিটকে গেলেন। আর ঠিক সেই জায়গাতেই খেলার সুযোগ পেলেন রাজাপাকশে। জাতীয় দলে লোয়ার মিডল অর্ডার সামলানো আইপিএলের একাদশে সুযোগ পেলেন টপ অর্ডার হিসেবে।
আর সে সুযোগ পেয়েই লুফে নিলেন রাজাপাকশে। আইপিএল ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই খেললেন ২২ বলে ৪৩ রানের ইনিংস। ব্যাস। সেখান থেকেই পাঞ্জাব কিংসের সর্বেসবা হয়ে ওঠা শুরু রাজাপাকশের। ঐ আইপিএলে সব মিলিয়ে ৯ টা ম্যাচ খেললেন তিনি। তাতে প্রায় ১৬০ স্ট্রাইকরেট রেখে করলেন ২০৬ রান।
গত বারের মতো এবারও পাঞ্জাবের তিন নম্বরে আস্থার নাম ভানুকা রাজাপাকশে। যদিও ম্যাথিউ শর্টের সাথে এবারের আসরে এ পজিশন ভাগাভাগি করতে হয়েছে এ লঙ্কান ব্যাটারকে। তবে ঠিকই এর মধ্যে একটি ম্যাচে তুলে নিয়েছেন অর্ধ-শতক। কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে মাত্র ৩২ বলেই পৌঁছে যান ব্যক্তিগত অর্ধ-শতকে।
শ্রীলঙ্কার হয়ে এক টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট বাদে বাকি দুই ফরম্যাটে এখনও নিজের জায়গা পাকাপোক্ত নয় রাজাপাকশের। তবে জাতীয় দলের হয়ে ব্রাত্য এই ব্যাটার যেন লঙ্কানদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন পাঞ্জাব শিবিরে। ফিটনেস ইস্যুতে বরাবরই কোচিং স্টাফদের কাছে শঙ্কার কারণ হলেও নিজের ব্যাটিং দিয়ে সেই শঙ্কা কাটিয়ে ক্রমেই কোচের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠছেন এ ব্যাটার।
ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের অসম চাপ কাটিয়েও পারফর্ম করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়তই। অবশ্য রাজাপাকশে তো চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন, আবার সেটি জয়ের দিকেও তাঁর চোখ থাকে। এভাবেই তো তিনি ফিটনেস নামক গ্যাঁড়াকল ডিঙিয়ে কাঠিন্যকে জয় করে দলে ফিরেছিলেন। তাই রাজাপাকশের কাছে এমন চ্যালেঞ্জ জয় করা নতুন কিছু নয়, পুরনো অভ্যাসই বটে।