রুপকথার নাম মরক্কো

এমনিতে আফ্রিকার দল হিসেবে মরক্কো বেশ শক্তিশালী একটা দল। কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আবার মরক্কো ঢের পিছিয়ে। সেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপে একবার তারা রাউন্ড অফ সিক্সটিনে নিজেদের নাম লিখিয়েছিল। সেটিই ছিল তাদের ইতিহাসের সেরা সাফল্য।

কাতার বিশ্বকাপ শুরুর তখন তিন মাস বাকি। মরক্কো ফুটবলে একদম টালমাটাল অবস্থা। মরক্কোর বসনিয়ান কোচ হালিলহোজিচের সাথে তখন সম্পর্কটা ঠিকঠাক যাচ্ছিল না মরক্কোর দুই তারকা ফুটবলার হাকিম জিয়েচ আর নুসাইর মাজরাউয়ির। হাকিম জিয়েচ তো জাতীয় দলকে সে সময় বিদায়ই বলে দিলেন। এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় কোচকে ছাঁটাই করা ছাড়া মরক্কোর আর বিকল্প কোনো রাস্তা খোলা ছিল না।

যেই ভাবনা সেই কাজ। হালিলহোজিচকে কোচের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। তাঁর জায়গায় আনা হলো ওয়ালিদ রেগুরাইকে। বিশ্বকাপ শুরুর তিন মাস আগে কোচ পরিবর্তন। রেগুরাইয়ের উপর তাই বাড়তি একটা চাপ এমনিতেই তখন তৈরি হয়েছিল। তবে তাঁর মূল চ্যালেঞ্জ ছিল হাকিম জিয়েচকে ফিরিয়ে আনা। সেই কাজটায় তিনি ভালভাবেই সফল হয়েছিলেন।

হাকিম জিয়েচ বিশ্বকাপের আগ দিয়েই দলে ফিরেছিলেন। আর শুধু ফিরেই ক্ষান্ত হলেন না। বিশ্বকাপে মরক্কোর একটি রূপকথার জন্ম দিলেন। কখনোই কোয়ার্টার ফাইনালে না খেলা মরক্কো এবার নিজেদের নিয়ে গেল শেষ আটে। এটাকে রূপকথা বলবেন না তো কী বলবেন!

এমনিতে আফ্রিকার দল হিসেবে মরক্কো বেশ শক্তিশালী একটা দল। কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আবার মরক্কো ঢের পিছিয়ে। সেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপে একবার তাঁরা রাউন্ড অফ সিক্সটিনে নিজেদের নাম লিখিয়েছিল। সেটিই ছিল তাদের ইতিহাসের সেরা সাফল্য। এ বাদে বিশ্বকাপে আরো চারবার অংশ নিলেও প্রতিবারই তাদের ফিরতে হয়েছে ঐ প্রথম রাউন্ডেই।

এবারও যে খুব আশা নিয়ে মরক্কো দলটা কাতারে এসেছিল, ব্যাপারটা তেমনও নয়। কারণ তাদের গ্রুপে ছিল বেলজিয়াম, ক্রোয়েশিয়া আর কানাডা। প্রত্যেকটি দলই ছিল তাদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। তাই ফুটবল বিশ্লেষক থেকে শুরু করে অধিকাংশ ফুটবল অনুরাগীরাই মরক্কোকে এ গ্রুপের সম্ভাব্য চতুর্থ স্থান ধরেই সমীকরণ সাজিয়েছিল।

কিন্তু মরক্কো সেই সব চুলচেরা বিশ্লেষণ, পরিসংখ্যানকে পাত্তা না দিয়ে হয়েছিল সেই গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দল। এফ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হওয়াতেও আবার একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ তাঁরা পায়নি। কারণ প্রত্যেকটি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দল রাউন্ড অফ সিক্সটিনে অপেক্ষাকৃত খর্বশক্তির দলের সাথে খেলার সুযোগ পেয়েছে, সেখানে মরক্কোর ক্ষেত্রে মিলেছে বৈপরীত্ব। কারণ ই গ্রুপের রানার্স আপ দল যে আবার স্পেন। যারা ইউরোপ তো বটেই, পুরো ফুটবল বিশ্বেই ভীতি জাগানিয়া এক দল। টিকিটাকা ফুটবল খেলা স্পেন এ বিশ্বকাপেরই অন্যতম এক ফেবারিট দল ছিল।

কিন্তু সেই ট্যাগলাইনের প্রমাণটা তো করতে হয় মাঠে। আর সেই মাঠের জয়টা গিয়েছে মরক্কোর ঘরে। ম্যাচের সিংহভাগ বল স্পেনের দিকেই ছিল। কিন্তু ঐ যে, ম্যাচ জিততে হয় গোল করে। স্পেন সেই চূড়ান্ত নিশানা পেতেই ব্যর্থ হয়েছে। এতে অবশ্য তাদের ব্যর্থতার চেয়ে মরক্কোর ডিফেন্ডারদের তারিফ করাটাই শ্রেয়। তবে ম্যাচের নায়ক ছিলেন মরক্কোর গোলবার সামলানো ইয়াসিন বুনু। পুরো ম্যাচজুড়েই দারুণ সব সেভ দিয়েছেন।

সেই সাথে শেষের দাপটটা তিনিই দেখিয়েছেন। কারণ পেনাল্টি শ্যুটআউটে যাওয়া ম্যাচে কোনো স্প্যানিশ শ্যুটারই তাঁকে ভেদ করতে পারেনি। স্পেনের নেওয়া তিন শটের তিনটিই তিনি নিজের আগ্রাসনে সেভ করেছেন। কার্যত মরক্কোর জয়টা ওখানেই চলে আসে। মরক্কোর কাব্যগাঁথা লেখা হয় ঐ সব পেনাল্টি সেভের মাধ্যমেই। এমন সব কাব্যগাঁথায় প্রধান চরিত্র হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে যান গোলরক্ষক বুনু।

শুধু কি মরক্কোর ইতিহাসেই? না। বিশ্বকাপের ইতিহাসেও তো তিনি এক অনন্য কীর্তিতে নাম লিখিয়ে ফেললেন। পেনাল্টি শ্যুটআউটে তিনটি শট সেভ দেওয়ার রেকর্ড এতদিন পর্যন্ত তিনজনের ছিল। এবার সেই ছোট তালিকায় চতুর্থ গোলরক্ষক হিসেবে নিজের নাম লিখিয়ে ফেললেন ইয়াসিন বুনু।

মরক্কোর রাউন্ড অফ সিক্সটিন নিশ্চিত হওয়ার পর ছেলে আশরাফ হাকিমির কপালে মায়ের চুম্বনের একটি দৃশ্য পুরো বিশ্বেরই হৃদয় ছুঁয়েছিল। কারণ তখন সেটা মরক্কোর জন্য অভাবনীয় এক সাফল্য হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিল। স্পেনকে হারিয়ে এবার সেরা আট নিশ্চিত করায় সেই সাফল্যকেও যেন ছাপিয়ে গেল। বিশ্বকাপে মরক্কোর ইতিহাসের সেরা সাফল্যের মঞ্চটা তৈরি হলো এই কাতারেই।

তবে এই দলটার আরো দূর পথ পাড়ি দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবার মধ্যে সেই চেতণার বলয় রয়েছে। সবাই যখন তাদের গ্রুপ পর্বের চতুর্থ দল হিসেবে বিবেচনা করছিল, তখন তাঁরা চ্যাম্পিয়ন হয়ে একটা বার্তা দিয়ে রেখেছিল। এরপর সবাই যখন বলতে শুরু করলো, এবার আর মরক্কোর রক্ষে নেই, স্পেনের কাছে পাত্তাই পাবে না তাঁরা, তখন তারা আবার প্রমাণ করলো। একটা মাঝারি মানের দলের অপরাজেয় হয়ে ওঠার যাত্রা তো এমনই হয়।

তাই কাতার বিশ্বকাপে আর দুই ধাপ এগোনোও মরক্কোর জন্য এখন খুব অসম্ভব নয়। কারণ বিস্ময়ের প্রতিকূল রাস্তা পেরিয়ে তাঁরা এখন সবাইকে বাস্তমব করতে বাধ্য করেছে। তাই এই মরক্কো আরো দুই একটা রূপকথার জন্ম দিলে বিস্ময়ের কিছু নেই। তবে আজকের রাতটা মরক্কোর জন্য নিশ্চিতভাবেই রূপকথার এক রাত। পুরো মরক্কোবাসী সমস্বরে আজ বলতেই পারে, আজ রাতে রূপকথা আছে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...